ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আটক ৬ জঙ্গীর তথ্য

জঙ্গীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের স্বজনরা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৯ মে ২০১৭

জঙ্গীদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের স্বজনরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বঙ্গবন্ধুর খুনীরা জঙ্গীদের সংগঠিত হতে মদদ যোগাচ্ছে। পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রীমহল। এখাতে খরচ করছে বিপুল অর্থ। শুধু অর্থ নয়, জঙ্গীদের প্রয়োজনীয় অস্ত্রগোলাবারুদও সরবরাহ করার আশ্বাস দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনী, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের দেয়া অর্থে জঙ্গীদের পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় পাঠিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষিতদের দিয়ে ভয়াবহ নাশকতা চালিয়ে দেশে চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। রবিবার রাতে র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে গ্রেফতারকৃত ছয় জঙ্গীর বরাত দিয়ে এমন তথ্যই জানালেন দায়িত্বশীল উর্ধতন কর্মকর্তারা। গত ৭ মে রাতে র‌্যাবের অভিযানে সাভারের আশুলিয়া থেকে মোঃ ইমরান হোসেন ওরফে ইমরান ওরফে এমরান (৩৪) ও মোঃ রফিকুল ইসলাম ওরফে জুনায়েদ ওরফে রফিককে (৪০) গ্রেফতার হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ২ বোতল সালফিউরিক এসিড, বিভিন্ন ধরনের স্পিøন্টার ও নানা প্রকারের বিস্ফোরক তৈরির উপযোগী রাসায়নিক পদার্থসহ অন্যান্য সামগ্রী। সোমবার কাওরান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক উইং কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, গত ১০ এপ্রিল র‌্যাব-১৪ এর একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নব্য জেএমবির এক নারী সদস্যকে গ্রেফতার করে। ওই নারী রিমান্ডে জানায়, নব্য জেএমবি বর্তমানে দলের নারী সদস্যদের দিয়ে বিস্ফোরক স্থানান্তরের কাজটি করছে। কারণ নারীরা নানা কারণেই কিছুটা হলেও সন্দেহের বাইরে থাকে। এছাড়া নারীদের সার্চ করাও যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নারী সদস্যদের দিয়েও, নারী জঙ্গীদের শতভাগ নিশ্চিতভাবে তল্লাশি করা খানিকটা কঠিন। এমন সুযোগে নারী জঙ্গীরা বিস্ফোরক স্থানান্তর করছে। ওই নারী জঙ্গীর তথ্যমতে আশুলিয়া থেকে দুই জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ইমরান মূলত বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থগুলো বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রির দোকান ও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে থাকে। রফিক তার সহযোগী হিসেবে কাজ করে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা কয়েকজন বিস্ফোরক ও রাসায়নিক পদার্থ বিক্রয়কারীর নাম প্রকাশ করেছে। যারা বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিস্ফোরক বিক্রি করে থাকে। ইমরান হোসেন ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কেমিক্যাল নির্ভর বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল। ২০০১ সালে ফরিদ নামে একজনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হুজিতে যোগ দিয়েছিল। তার মত আরও অন্তত ২৫ জন হুজিতে যোগ দিয়ে ময়মনসিংহের বুড়িরচরে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। প্রাথমিক প্রশিক্ষণে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ইমরানকে চট্টগ্রামে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। শহিদুল্লাহ ও রুম্মন নামে দুইজন প্রশিক্ষক তাদের শারীরিক ও জঙ্গী মতাদর্শের ওপরে প্রশিক্ষণ দিত। ইমরান সংগঠনের জন্য চাঁদা আদায় করত। আদায়কৃত চাঁদা ময়মনসিংহ জেলার হুজির কোষাদক্ষ তারিক ওরফে আব্দুল্লাহর কাছে গচ্ছিত থাকত। এরপর ইমরান হুজি ছেড়ে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। কেমিক্যাল কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে সে কেমিক্যাল সংগ্রহ ও সরবরাহ করার চ্যানেলটি সম্পর্কে অবহিত ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় কেমিক্যাল ও রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করে নারী জঙ্গীদের মাধ্যমে এবং কুরিয়ারে করে চট্টগ্রামের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠাত। আর গ্রেফতারকৃত রফিক চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। রফিক ও ইমরান প্রায় একই সময়ে হুজিতে যোগ দিয়েছিল। রফিক বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়। ইমরানের মাধ্যমে রফিক ২০১৫ সালে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। রফিক চট্টগ্রামের জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বিস্ফোরক সরবরাহ করতো নারীদের মাধ্যমে। বিস্ফোরক সরবরাহের কাছে তার দুই স্ত্রীও জড়িত। তার প্রথম স্ত্রী জয়নাব বিবি পলাতক। দ্বিতীয় স্ত্রী নারী জঙ্গী তহুরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে প্রথমে নিখোঁজ হয়। এরপর রফিককে বিয়ে করে আবার প্রকাশ্যে আসে। বিয়ে করার পরেও তহুরা জঙ্গীবাদের পথ ছাড়তে পারেনি। বরং নব্য জেএমবির সক্রিয় জঙ্গী রফিককে বিয়ে করার পর আরও বেপরোয়াভাবে জঙ্গী তৎপরতা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তহুরা গ্রেফতার হওয়ার পর তারই তথ্যমতে গ্রেফতার হয় তারই স্বামী জঙ্গী রফিক। বিস্ফোরক সরবরাহের সঙ্গে প্রায় সকল নারী জঙ্গী জড়িত। র‌্যাবের এই কর্মকর্তা গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে বলছেন, আরাকানের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গ্রেফতারকৃ জঙ্গীদের একটি বিশেষ সখ্যতা রয়েছে। শুধু গ্রেফতারকৃত জঙ্গী নয়, দেশের সব জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গেই আরাকান রোহিঙ্গাদের যোগাযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় জঙ্গীদের। জঙ্গীরা তাদের কাছ থেকে অস্ত্রগোলাবারুদও সংগ্রহ করে। শুধু আরাকান রোহিঙ্গা নয়, জঙ্গীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পরিবারের অনেক সদস্যদের যোগাযোগ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পরিবারের সদস্যরা জঙ্গীদের নতুন করে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। তারা জঙ্গীদের অর্থায়ন করছে। শুধু অর্থ নয়, জঙ্গীদের অস্ত্রগোলবারুদ সরবরাহ করারও আশ্বাস দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পরিবারের অনেকেরই দেয়া অর্থের অনেকটাই ব্যয় হচ্ছে অস্ত্রগোলাবারুদ কেনার জন্য। গ্রেফতারকৃতরা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মধ্যে কারও কারও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে। জঙ্গীরা তাদের নামও প্রকাশ করেছে। জঙ্গীদের মদদদাতা বঙ্গবন্ধু খুনীদের পরিবারের ওইসব সদস্যদের ওপর নজরদারি চলছে। যেকোন সময় তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে এই র‌্যাব কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মধ্যে কার কার পরিবারের সদস্যরা জঙ্গীদের সংগঠিত করতে অর্থায়ন করছে, তা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, অচিরেই তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। জঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগকারী বঙ্গবন্ধুর খুনীদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। আবার অনেকেই বিদেশে রয়েছে। তারা জঙ্গীদের সংগঠিত করে দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর চেষ্টা করছে। এদিকে রবিবার রাতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক অভিযানে মতিঝিলের পীর জঙ্গী মাজার এলাকা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য এবিএম সোহেল-উদ-দৌলা ওরফে সোহেল, আহাদুল ইসলাম সাগর, জগলুল হক মিঠু ও তোয়াসিন রহমান নামের চার জঙ্গী গ্রেফতার হয়। তারা আনসার আল ইসলাম নামে তৎপরত ছিল। সোমবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃত সোহেল ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় অবস্থিত আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গী সংগঠনটির অন্যতম সংগঠক। অন্য তিন জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে দুইটি ল্যাপটপ, দুটি নোটবুক, দুটি মোবাইল ফোন, একটি পাসপোর্ট, আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ও আনোয়ার আল আওলাকির লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ উদ্ধার হয়েছে। মনিরুল ইসলাম বলছেন, ২০১৪ সালে জঙ্গী হাসান ওরফে রেজার মাধ্যমে তারা জঙ্গীবাদে জড়ায়। হাসানকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গ্রেফতারকৃত সোহেল মূলত সংগঠক। অন্য তিন জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ওই তিন ছাত্রকে সিরিয়ায় পাঠানোর পাশাপাশি নিজেও সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করছিল। গ্রেফতারকৃতদের সঙ্গে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার যোগাযোগ ছিল। গ্রেফতারকৃতরা সিরিয়ায় গিয়ে আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন জামাত-আল-নুসরা ফ্রন্টে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। তাদের বিশ্বাস, জিহাদ করতে হলে প্রথমেই নিজেকে জিহাদী হিসেবে তৈরি করতে হবে। আর নিজেকে জিহাদী হিসেবে তৈরি করার উপযুক্ত দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়া। তারা এসব দেশে গিয়ে প্রথমে জঙ্গী ট্রেনিং নিতে হবে। এরপর দেশে ফিরে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। পাসপোর্টে বিভিন্ন দেশের ভিসা থাকলে ইরাক ও সিরিয়া যাওয়া সহজ হবে। এজন্য গ্রেফতারকৃতরা পাসপোর্টে অন্যান্য দেশের ভিসা লাগানোর চেষ্টা করছিল। তারই অংশ হিসেবে সোহেল ভারত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া সফর করেছে। যাতে পর্যটক হিসেবে সিরিয়ায় যাওয়া সহজ হয়। মনিরুল ইসলাম জানান, সিরিয়া থেকে জঙ্গী প্রশিক্ষণ শেষে তাদের দেশে ফেরার কথা ছিল। দেশে ফিরেই তারা জঙ্গী কর্মকা- চালাবে। দেশে বড় ধরনের নাশকতা (সশস্ত্র জিহাদ) চালিয়ে খেলাফত কায়েম করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। শুধু তাই নয়, গ্রেফতারকৃতরা ব্লগার হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত।
×