ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভাসমান শাকিলের অনন্য কৃতিত্ব

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ৭ মে ২০১৭

ভাসমান শাকিলের অনন্য কৃতিত্ব

নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর, ৬ মে ॥ আমার বাবা মা আমার খোঁজ নেয় না। তারা বেঁচে থেকেও মৃত। পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়া ছিল না। টাকার জন্য বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে ‘আমার কেউ নেই, আমি তোমাকে চিনি না’ বলে মুঠোফোন রেখে দেন আমার বাবা বলতে বলতে চোখের কোণে জল ছল ছল করে শাকিলের। বাবা মায়ের কথা উঠতেই কান্নাজড়িত কন্ঠে শাকিল বলে, আমি এমন দুর্ভাগা সন্তান, আজ আমার বাবা-মা বেঁচে থেকেও নেই। তারা আমার আর আমার ছোট বোনের কোন খবর নেয় না। নিজেদের ইচ্ছেমতো তারা তাদের নতুন সংসার পেতেছেন। নতুন করে আলাদা আলাদা সংসার গড়েছেন। আমাকে আর আমার বোনকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে গেছেন। পরিচয় থাকতেও আজ আমরা পরিচয়হীন হয়ে পড়েছি। কি দোষে কি অপরাধে আজ তারা বাবার আদর, মায়ের ভালবাসা আর স্নেহ থেকে বঞ্চিত, সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই শাকিলের। শাকিল হোসেন এবারের এসএসসি পরীক্ষায় উজ্জ্বল কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। নাটোর সদর উপজেলার মির্জাপুর দীঘা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪.৯৫ পয়েন্ট পেয়েছে। সদর উপজেলার মাঝ আগদীঘা গ্রামে জন্ম তার। নিজেদের কোন জায়গা জমি না থাকায় সে তার সাত বছরের ছোট বোন জাহিদা এবং তার দাদি শরীফা বেওয়া ভাসমান অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। কখনও এর ঘরে তো কখনও আরেকজনের ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়ান। খেয়ে না খেয়ে চলে তাদের জীবন। এমনকি পরীক্ষা চলাকালে শাকিলকে পাড়া প্রতিবেশীর বাড়িতে তিনতিনবার জায়গা বদল করে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এতে পরীক্ষা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কিছুই করার ছিল না তার। নিজের আর ছোট বোনের পেটের আহার যোগাড় করতে বিদ্যালয়ের ক্লাস বাদ দিয়ে দিনমজুর, রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে হয়েছে। আবার কখনও ধরতে হয়েছে অটোরিক্সার হ্যান্ডেল। তবু থেমে থাকেনি সে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার অদম্য ইচ্ছা নিয়ে চালিয়ে গেছে লেখাপড়া। শাকিল জানায়, ৬ বছর আগে তার বাবা-মা তাদের ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমায়। সেখানে গার্মেন্টসে কিছুদিন কাজ করার পর তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরে কিছুদিনের ব্যবধানে দুজনেই তাদের নতুন সঙ্গী খুঁজে সংসার পেতেছেন। সেই থেকে শাকিল ও তার বোন এতিম। মেধাবী লাবণ্য আইনজীবী হতে চায় তাহমিন হক ববী, নীলফামারী ॥ দরিদ্র ঘরের অদম্য মেধাবী লাবণ্য। নামের আবেগময় শব্দে মুক্তোর ভেতর মোহময় সুন্দরের এই মেধাবী মেয়েটি গরিব ঘরের সন্তান হয়ে আইনজীবী হতে চেয়েছে। সে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে না, স্বপ্ন দেখছে জেগে। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণ করা গরিব বাবা-মার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই লাবণ্য কোন লাজ লজ্জা না রেখে অকপটে বলে আমাদের দেশে অনেক হৃদয়বান ব্যক্তি আছেন তারা কি আমার শিক্ষা জীবনের দায়িত্ব নিতে পারেন না? এমন কেউ এগিয়ে এলে হয়তো আমি আমার স্বপ্নটি পূরণ করতে পারতাম। লাবণ্যের পুরো নাম লিমানা খন্দকার। সে এবার এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর বোর্ডে নীলফামারী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে মানবিক বিভাগ হতে। শনিবার সকালে নীলফামারী শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দেখা যায় টিনের ছাপড়ার ঘরে বসবাস বেসরকারী কোম্পানীর কর্মচারী লোটন খন্দকার ও স্ত্রী মঞ্জুয়ারা বেগমের সংসার। একটি টিনের ভাঙ্গা ঘরেই পরিবারের চার সদস্যের বসবাস। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলাই ভার, সেখানে লেখাপড়াতো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ারই মতো। তবুও অদম্য মেধা ও ইচ্ছা শক্তিকে পুঁজি করে দারিদ্র্যতার কড়াল গ্রাসে নিজেকে ভাসিয়ে না দিয়ে অন্যের কাছ থেকে বই সংগ্রহ আর বাড়িতে বসে ছোট ছোট শিশুদের কাপড় জামা সেলাই করে খরচ জুগিয়ে লেখাপড়া চালিয়েছে লাবণ্য। দীপান্বিতার স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হবে না তো? স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডের অধীন মণিরামপুর উপজেলার নাগোরঘোপ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে দীপান্বিতা পাল। সে চিনাটোলা গ্রামের হতদরিদ্র জয়ন্ত পাল ও বাসন্তী পালের মেয়ে। ভাল ফলাফলে দীপান্বিতা খুশি হলেও ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা তার। বাবা-মায়ের তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দীপান্বিতা বড়। হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়ায় দুঃখ কষ্টই যার নিত্যসঙ্গী। তবুও শত দুঃখ-কষ্ট, বাধা-বিপত্তি তাকে লেখাপড়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় মনোবলের কাছে হার মেনেছে দারিদ্র্যতা। সে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় বৃত্তিলাভ করেছিল। জমিজমা বলতে ছয় শতকের ভিটেটুকু ছাড়া কিছুই নেই তাদের। দিনমজুর বাবার টানাটানির সংসারে দুঃখ কষ্ট দেখে প্রতিবেশীর ছেলে- মেয়েদের টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ কিছুটা পুষিয়ে নেয় দীপান্বিতা। ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে মা বাসন্তী পাল কখনও মাটির কাজ, কখনও কুটির শিল্পের কাজ, আবার কখনও বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে স্বামীর দুঃখ-কষ্টের সংসারে হাল ধরে আছেন। ভাল ফলাফলে দীপান্বিতা খুশি হলেও ভবিষ্যত জীবন নিয়ে শঙ্কা তার। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাল ফলের খবর শুনে কেঁদে ফেলে দীপান্বিতা। আনন্দাশ্রু কন্ঠে সে জানায়, ‘আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।
×