ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঐক্যের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা না যেতেই উল্টো চিত্র

সুইমিংপুল নির্মাণ প্রকল্পে মহিউদ্দিন সমর্থিত ছাত্রলীগের হামলা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

সুইমিংপুল নির্মাণ প্রকল্পে মহিউদ্দিন সমর্থিত ছাত্রলীগের হামলা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সরকারদলীয় চট্টগ্রামের সাবেক ও বর্তমান মেয়রের প্রায় দুই সপ্তাহের বাগযুদ্ধের অবসান ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টা পেরুনোর আগেই মঙ্গলবার নতুন করে অবতারণা হয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়াম সংলগ্ন মাঠে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উদ্যোগে সুইমিংপুল নির্মাণ প্রকল্পে হামলা চালিয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মৃদু সংঘর্ষ হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। ছাত্রলীগ কর্মীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে। এ ঘটনায় ২ পুলিশ ও ছাত্রলীগের ১৫ কর্মী আহত হয়। পুলিশী তাড়া খেয়ে ছাত্রলীগ কর্মীরা কাজির দেউড়ি, আশকারদীঘির পাড়, মেহেদীবাগ, জিইসি মোড়, প্রবর্তক মোড়সহ বিভিন্ন এলাকায় ভাংচুর চালিয়ে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আগে ছাত্রলীগের পক্ষে সেøাগানমুখর মিছিল নিয়ে কাজির দেউড়ি মোড়ে সমবেত হয়ে সমাবেশ করে। এরপর সুইমিংপুল প্রকল্প এলাকায় টিনের ঘেরার ওপর হামলা চালায়। খবর পেয়ে পুলিশ আসার পর তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনাটি নিয়ে আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার মধ্যকার সৃষ্ট উত্তাপের অবসান আদৌ ঘটেছে কিনা তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। উল্লেখ্য, সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন। উল্লেখ্য, গত সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত ঐতিহাসিক মুজিব নগর দিবসের আলোচনায় এক মঞ্চে উঠেছিলেন সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। মহিউদ্দিন চৌধুরী নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আ জ ম নাছির সাধারণ সম্পাদক। চট্টগ্রামে বর্ধিত হারে চসিকের হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের প্রক্রিয়া, চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন অনিয়ম, ফিরিঙ্গীবাজার এলাকার মৎস্য আড়ত স্থানান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম করে রেখেছিলেন। এছাড়া আউটার স্টেডিয়ামে একনেক অনুমোদিত সুইমিংপুল প্রকল্পের বিরোধিতায় নামে মহানগর ছাত্রলীগ। তারা ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় এ প্রকল্প বন্ধের। এসব নিয়ে মহিউদ্দিনের বক্তব্য, নাছিরের পাল্টা বক্তব্য এবং তাদের স্ব স্ব অনুসারীদের নগরজুড়ে বিক্ষিপ্ত সভা সমাবেশ দুই নেতার প্রতি অশ্লীল ও অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দের ঘটনা নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। গত সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে নগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে দুই পক্ষের সোডাউনের পাশাপাশি রক্তরক্তির ঘটনাও ঘটে যেতে পারে বলে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। বিকেল ৪টা নাগাদ সভা শুরু হওয়ার আগে দুই নেতাই মঞ্চে উপস্থিত হন। মহিউদ্দিন গ্রুপ সমর্থকরা সেøাগানমুখর হয়ে সোডাউন করলেও নাছির সমর্থকরা ছিল নীরব। সমাবেশ শুরু হওয়ার পর আকস্মিকভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী ঘোষণা দেন তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, সাংবাদিকরাই অতিরঞ্জিত করে সংবাদ প্রকাশের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি নাছিরকে ডেকে মঞ্চে হাত মেলান এবং একে অপরের দু’হাত একসঙ্গে তুলে ঘোষণা দেন যে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবেন। এ পরিস্থিতিতে মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে সমাবেশের সমাপ্তি ঘটে। ধারণা করা হয়েছিল হাইকমান্ডের চাপে বা নিজেদের মধ্যে বোধদয় ঘটার কারণে ঐক্যের এ ঘোষণা এসেছে। ফলে রাজনৈতিক মহলসহ সর্বত্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। সোমবারের ঐক্যের ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মহিউদ্দিন সমর্থক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলে পড়ে চসিকের উদ্যোগে গৃহীত সুইমিংপুল নির্মাণ প্রকল্পের ওপর। তারা প্রকল্পের টিনের ঘেরা ভেঙ্গে দিতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাদের বিতাড়িত করে। এর আগে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। কাজির দেউড়ি এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মীরা টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। থেমে থেমে ধাওয়াপাল্টা ধাওয়ার ঘটনার মধ্যে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রকল্প এলাকায় ঢুকে বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং আশপাশের দোকানে ভাংচুর চালায়। এ সময় এলাকাজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কাজির দেউড়িসহ বিভিন্ন পয়েন্টে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের সম্মেলন কক্ষে ‘সুইমিংপুল নির্মাণে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দাঁড়াও’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি ও সুইমিংপুল বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক আলী আব্বাস। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সকল নিয়মনীতি মেনে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সুইমিংপুল নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প অনুমোদন করেছেন। টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়েছে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে জেলা ক্রীড়া সংস্থার মালিকানার জায়গাতেই অনুরূপ সুইমিংপুল নির্মিত হয়েছে। ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭০ হাজার ৩৮০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এই সুইমিংপুল নির্মিত হলে ক্রীড়াবিদদের উৎকর্ষ সাধন ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের সাঁতারু তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খেলার মাঠ আর সুইমিংপুল মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যারা সুইমিংপুলকে খেলার মাঠ থেকে আলাদা বিষয় মনে করে তাদের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে ন্যূনতম ধারণা নেই। চট্টগ্রাম একটি বিভাগীয় শহর হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পরও এ শহরে একটি সুইমিংপুল নেই। যারা বিরোধিতা করছেন তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন তোলার আহ্বান জানানো হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাহাব উদ্দিন শামীম, চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অহিদ সিরাজ চৌধুরী স্বপন। এ ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সিটি মেয়র ও চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন জনকণ্ঠকে জানান, যারা হামলা চালিয়েছে তারা সকলেই চিহ্নিত। গত ১৬ এপ্রিল সরকার অনুমোদিত এই সুইমিংপুল প্রকল্প বন্ধ করতে ছাত্রলীগের একাংশ ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছিল। মেয়র জানান, পরিকল্পিতভাবে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেক সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন রয়েছে। সোমবার শহীদ মিনার চত্বরে ঐক্যের ঘোষণা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, কারও সঙ্গে তার কোন বিরোধ নেই। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে যে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়নে তিনি তৎপর রয়েছেন। সুইমিংপুল প্রকল্পটি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উদ্যোগে বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ প্রকল্পের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও সিজেকেএসের কোন সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু ছাত্রলীগ কেন এ প্রকল্প নিয়ে আল্টিমেটাম দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত হামলা চালিয়েছে সেটা তারাই জানে এবং নেপথ্যে কারা কলকাঠি নাড়ছে তাও সকলেরই জানা। অর্থাৎ তিনি নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চলমান কর্মকা-ের বহির্প্রকাশ বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। চট্টগ্রামে সরকার সমর্থিত দলের দুই শীর্ষ নেতার এহেন কর্মকা-ে সংগঠনের ভাবমূর্তি একদিকে যেমন প্রচ-ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি অপরদিকে সাধারণ নেতাকর্মী ও সমর্থক মহলে হতাশা সৃষ্টি করেছে। সোমবার দুই নেতার ঐক্যের ঘোষণার পর সাধারণ মানুষ শঙ্কামুক্ত হওয়ার যে আশা করেছিল মঙ্গলবারের ঘটনা ঠিক তার উল্টোই হয়েছে। পুরো ঘটনা সরকারী দলের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনছে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে।
×