ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

অভিযোগটি গুরুতর বাংলাদেশ ব্যাংককে এখনই তৎপর হতে হবে

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৯ এপ্রিল ২০১৭

অভিযোগটি গুরুতর বাংলাদেশ ব্যাংককে এখনই তৎপর হতে হবে

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ জালিয়াতির এক বছরের অধিক সময় পার হয়ে গেলেও এর অধিকাংশ অর্থ উদ্ধারে তেমন কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর পরিবর্তন এবং তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা আমরা শুনিনি। সেই তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের নিজেদের উপকারে না আসলেও প্রতিপক্ষের বিশেষ করে আরসিবিসি (রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন) ব্যাংকের জন্য ভাল ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কেননা আরসিবিসি ব্যাংক এই তদন্ত প্রতিবেদনের অজুহাত দিয়েই অর্থ জালিয়াতির সমস্ত দোষ বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে অর্থ ফেরত না দেয়ার বাহানা করে চলছে। তবে খোয়া যাওয়া অর্থ আদায়ে অগ্রগতি না হলেও বিষয়টি নিয়ে কথার জোয়ার বয়ে গেছে অনেক এবং এখনও বয়ে চলছে। এমনকি কখনও কখনও অতিকথন হয়েছে অবলীলায়। এই অতিকথন যে অনেক সময় আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে তাও আমরা ভুলে যাই। আশার কথা এই যে, আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি এখন গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন এবং এই চুরি যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। অর্থমন্ত্রী অবশ্য এরকম আশার বাণী এর আগেও অনেক শুনিয়েছেন। কিন্তু অর্থ উদ্ধারের ব্যাপারে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা তাকে নিতে দেখিনি। অর্থমন্ত্রী যখন এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও দুটো মন্তব্য এসেছে। আমেরিকার এফবিআইয়ের কর্মকর্তা ল্যামনট শিলার এই অর্থ কেলেঙ্কারির তদন্ত কাজের সঙ্গে নিয়োজিত ছিলেন বলে দাবি করেছেন এবং বর্তমানে ফিলিপাইনের আমেরিকার এ্যামবেসিতে লিগ্যাল এ্যাটাসি হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি সম্প্রতি ম্যানিলায় সরাসরি বাংলাদেশকে দোষারোপ করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মদদে এই অর্থ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর কয়েকদিন আগেই আমেরিকার ওয়াশিংটনের এক সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়Ñ বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অর্থ হ্যাকিংয়ের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা জড়িত। এই অভিযোগ দুটো খুবই গুরুতর এবং সুদূরপ্রসারী এক চক্রান্তেরই অংশ বলে মনে হয়। কেননা কোন এফবিআই কর্মকর্তা কখনই এভাবে জনসমক্ষে খোলামেলা মন্তব্য করেন না। তার ওপর যদি সরাসরি তদন্ত কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে তো মুখই খোলেন না। সেখানে ম্যানিলায় এভাবে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পিছনে কোন দুরভিসন্ধি বা রহস্য থাকা মোটেই অমূলক নয়। আরেক অভিযোগে এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নাম জুড়ে দেয়া হয়েছে স্বয়ং আমেরিকা থেকেই। অথচ দুনিয়ার সবাই জানে উত্তর কোরিয়ার ওপর সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন আরোপ করা আছে। পৃথিবীর যে দু-একটি দেশের ওপর সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি আছে তার মধ্যে উত্তর কোরিয়া অন্যতম। এই নিষেধাজ্ঞা এমনই কঠোর যে, উত্তর কোরিয়া এবং সেই দেশের কোন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনরকম লেনদেন করা যাবে না। যদি কোন সংঘটিত লেনদেনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া বা সেই দেশের নাগরিকের কোনরকম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাহলে সেটা নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের পর্যায় পড়বে এবং এজন্য সেই লেনদেনের সঙ্গে জড়িত দেশ ও প্রতিষ্ঠানকে চরম মূল্য দিতে হবে। অতীতে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগে বিশ্বের অনেক ক্ষমতাধর দেশের বৃহৎ ব্যাংকগুলোকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে। একথা সবাই জানে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮১ মিলিয়ন ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে ফিলিপিন্সে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই অর্থের চূড়ান্ত লেনদেনও সম্পন্ন করা হয়েছে ফিলিপিন্সের বাণিজ্যিক ব্যাংক রিজ্যাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের এক শাখায়। মূলত আরসিবিসি ব্যাংক জালিয়াতির এই অর্থ তাদেরই এক শাখা থেকে প্রদান করেছে। যদি আমেরিকার ওয়াশিংটন থেকে উত্থাপিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের জড়িত থাকার অভিযোগ সত্য হয় তাহলে তো এটা প্রমাণিত যে, ফিলিপিন্সের আরসিবিসি ব্যাংক সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশন অমান্য করেছে। কেননা ফিলিপিন্সের এই ব্যাংকই উত্তর কোরিয়ার হ্যাকারদের উক্ত অর্থ প্রদানে সহায়তা করেছে। সুতরাং ফিলিপিন্সের সেই বাণিজ্যিক ব্যাংক, আরসিবিসি ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দেশ ও সংস্থা কর্তৃক আরোপিত অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। আমেরিকাসহ নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশ এবং সংস্থার উচিত ছিল এই আরসিবিসি ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা অমান্যের অপরাধে চরম শাস্তি প্রদান করা, যেমনটা তারা ইতোপূর্বে বিশ্বের অনেক বৃহৎ ব্যাংকের ওপর করেছে। অথচ সেদিকে অগ্রসর না হয়ে প্রথমে উত্তর কোরিয়ার নাম জুড়ে দিয়ে এখন বাংলাদেশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশের হেতু কি হতে পারে? তাহলে কি ক্রমান্বয়ে এই অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে বাংলাদেশ ও উত্তর কোরিয়াকে জড়িয়ে একটি চক্রান্তের জাল বিস্তার করার চেষ্টা চলছে, যাতে করে খুব সহজেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা যায়? আর এই অভিযোগ এনে খুব সহজেই বাংলাদেশের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পথও প্রশস্ত হয়ে থাকবে। এই চক্রান্তের জাল বিস্তারের সময়টাও খুবই বিবেচ্য বিষয়। কেননা, আর মাত্র বছর দেড়েক পরেই বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবার সকল দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলেই সকলের প্রত্যাশা। সেই নির্বাচনে যদি উন্নত বিশ্বের বিশেষ করে আমেরিকার পছন্দের কোন দল ক্ষমতায় না আসে তাহলে সেই সরকারকে কাবু করার জন্য তথাকথিত এই নিষেধাজ্ঞা অমান্যের অস্ত্রটি সুন্দরভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমনটা ইতোপূর্বে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ক্ষেত্রে হয়েছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ভিতর থেকে যে দুটো অভিযোগ তোলা হয়েছে তা খুবই গুরুতর এবং ভয়াবহ। এটিকে হালকাভাবে নেয়া বা এড়িয়ে যাওয়া মোটেই সমীচীন হবে না। তাই আর কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই রিজার্ভ জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি; কিন্তু অর্থ উদ্ধারের জন্য কোনরকম আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন আইনজীবীও নিয়োগ করিনি। বিশ্বে আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা মোটেই নতুন নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নতুন হলেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ জালিয়াতির মাধ্যমে খোয়া যাওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। আর এসব খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারও হচ্ছে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। এমনকি আমাদের ব্যক্তিজীবনে সামান্য অর্থও যদি কোন কারণে ব্যাংকের হিসাব থেকে এদিক-ওদিক হয় তাহলে সেই অর্থ ফিরে পেতে আইনী লড়াইয়ের হুমকি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে হয়। আইনী লড়াই ছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার নজির খুব একটা নেই। অথচ এই অমোঘ সত্যটি বাংলাদেশ ব্যাংক কেন যেন বুঝতে চাইছে না। আজ প্রায় দেড় বছর হতে চলল বাংলাদেশ ব্যাংক এদিকে একেবারেই অগ্রসর হয়নি। আর এই কারণেই আরসিবিসি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর দোষ চাপিয়ে এই অর্থ ফেরত না দেয়ার হুমকি দেয়ার সাহস পেয়েছে। একইভাবে এফবিআইয়ের কর্মকর্তা বলতে সাহস পেয়েছেন যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মদদে অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। কেননা সংক্ষুব্ধ পক্ষ যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনের আশ্রয় না নেয় তাহলে তাদের নিজের দুর্বলতাই প্রকাশ পায় এবং অন্যরা সেই সুযোগ নিবে এটাই স্বাভাবিক। এই বাস্তবতা যেমন ব্যক্তিজীবনে, তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবনেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমি ইংরেজী ও বাংলা পত্রিকায় প্রায় এক ডজনের বেশি কলাম লিখেছিলাম। আমেরিকাভিত্তিক এ্যান্টি মানিলন্ডারিং বিশেষজ্ঞ সংস্থার একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে এবং নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি সেসব কলামে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছিলাম যে, এই অর্থ জালিয়াতির ঘটনার জন্য কার কার দায়িত্ব কতটুকু এবং কারা কতটুকু দায়ী। এটাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলাম যে, এই ঘটনার কারণে আমেরিকার প্রচলিত ইউএস প্যাট্রিয়ট এ্যাক্ট ২০০১ এবং ইউএস ক্রিমিনাল মানি লন্ডারিং এ্যান্ড সিভিল ফরফিচার এ্যাক্ট ১৯৮৬-এর কোন কোন ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমেরিকার আদালতে মামলা করে যথাযথ প্রতিকার পেতে পারে। লেখাগুলো পাঠ করে অনেক সাধারণ পাঠক আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ইমেইল পাঠালেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে লেখাগুলো এসেছিল কিনা জানা নেই। ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই আর মোটেই কালবিলম্ব নয়। কেননা আমেরিকার দিক থেকে যে অভিযোগের অঙ্গুলি বাংলাদেশের দিকে নির্দেশ করা হয়েছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব খুবই খারাপ হতে পারে। তাই অন্যদের আর এক কদমও অগ্রসর হওয়ার সুযোগ না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে দ্রুত আমেরিকার আদালতে এই অর্থ জালিয়াতির প্রতিকার চেয়ে মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। মনে রাখতে হবে উন্নত বিশ্বে মানুষ ভয় পায় একমাত্র আইনজীবী ও আদালতকে, অন্য কাউকে নয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার কয়েকমাস আগে অনুরূপ একটি অর্থ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছিল। সেখানেও একই কায়দায় ভুয়া সুইফট মেসেজ জালিয়াতি করে আমেরিকার একটি ব্যাংকে ইকুয়েডরের এক ব্যাংকের রাখা গচ্ছিত অর্থ থেকে ১২ মিলিয়ন ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে সরিয়ে হংকং নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইকুয়েডরের সেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক চুরি হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমেরিকা এবং হংকং উভয় দেশের আদালতে মামলা দায়ের করেছে, যা এখনও বিচারাধীন আছে। বিষয়টি নিয়ে অন্য পরিসরে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। লেখক : ব্যাংকার, টরেনটো, কানাডা [email protected]
×