ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়ায় বৈশাখী মেলায় এবারের আকর্ষণ মোরগ লড়াই

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৩ এপ্রিল ২০১৭

বগুড়ায় বৈশাখী মেলায় এবারের আকর্ষণ মোরগ লড়াই

সমুদ্র হক ॥ বৈশাখের দিনে উৎসবের আনন্দে মোরগকে তেজি করে লড়াইয়ের প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। গ্রামীণ জীবনের বৈশাখী উৎসবের স্রোতধারা এভাবেও বিস্তৃত পাচ্ছে চারদিকে। উৎসবের অন্যতম একটি আকর্ষণ মোরগ লড়াই। বৈশাখী মেলায় মোরগের লড়াই প্রদর্শনের লক্ষ্যে মেলার আয়োজকরা গ্রামে গিয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে কোন গৃহস্থ বা কৃষকের তেজি মোরগ আছে। মোরগের লড়াই প্রতিযোগিতায় কোন মালিকের মোরগ কত তেজি তারও পরীক্ষা হয়। সবচেয়ে মজার বিষয়, প্রতিযোগিতা শুরু হলে দর্শকরা দুই মোরগের পক্ষ নিয়ে করতালি ও মুখে নানা ধরনের শব্দ করে উৎসাহ দেয়। কেউ আবার বাজি ধরে। কুককুড়ুক কুউউ ডাক দিয়ে প্রকৃতিতে প্রত্যুষের ঘোষণা দেয় মোরগ। গ্রামে আজও মোরগের এই ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গে। সুরের এই ডাক ভোরের নীরবতা ভেঙ্গে দেয়। মোরগ-মুরগি নিয়ে পুরাণে কতই না কথা আছে। গ্রিক মাইথোলজিসহ অনেক মিথে মোরগকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। লাল মোরগ অরুণ রাগ ও সাদা মোরগ উদিত সূর্যের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্য দেবতা এ্যাপলের প্রিয় পাখি মোরগ। জাপানের ইসিতে (ওসাকা নগরীর কাছে) সূর্যদেবী এ্যামেতারেসুর মন্দিরের বেদিতে মোরগ যুক্ত করে রাখা হয়েছে। ভারতের আসামের একটি উপজাতির বিশ্বাস মোরগ বুবু করে ডাকলে সূর্য ওঠে নক নক করে ডাকলে সূর্য অস্ত যায়। পুরাণে মোরগ-মুরগি নিয়ে যাই বলা থাক এই মোরগ বাঙালীর শেকড়ের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করতেও অবদান রাখছে। বাঙালীর সংস্কৃতিতে উৎসব-পার্বনে নানা অনুষঙ্গে সুস্থ বিনোদনের বড় অধ্যায় হয়ে আছে আদিকাল থেকেই। বৈশাখী মেলায় খিলাড়িরা দূরের গ্রাম থেকে নগরীর কোন মেলায় মোরগ নিয়ে যায়। অনেক গৃহস্থ ও কৃষক প্রতিযোগিতার জন্য মোরগকে পোষ মানিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। যমুনা তীরের রফিকুল ইসলাম বললেন, গৃহে লালনপালন করার পর প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত জাতের যে লড়াকু মোরগ তৈরি করা হয়েছে বর্তমান বাজার দর ১৫ হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশি দামেরও আছে। নির্দিষ্ট সময়ে এদের খাওয়ানো হয়। আহারেও বাছ-বিচার আছে। সবই খেতে দিলে মোরগ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। লড়াইয়ে শরীর ভারি হলে টিকতে পারবে না। লড়াকু মোরগকেও সময় মেনে গোসল করানো হয়। চিকিৎসাও দিতে হয়। অনেকে মনে করে মোরগ-মুরগির বুদ্ধি নেই। এদের বুদ্ধি অনেক পাখির চেয়েও বেশি। রূপ লাবণ্য আছে। মোরগের গলা পেখম ঠোঁট ও পা লড়াইয়ে একসঙ্গে ব্যবহার করে। চিত্তবিনোদনের এই খেলায় উভয় পক্ষের লড়াকু মোরগ প্রথমেই ঝুঁটি ফুলিয়ে প্রস্তুত হয়। এরপর উড়ে আক্রমণ করার দৃশ্য হৃদয় ভরে দেয়। একজন মোরগওয়ালা জেতার একটি গোপন কথাও বললেন, লড়াই শুরুর আগে মোরগের পায়ে কৌশলে ছোট্ট চাকু বেঁধে দেয়া হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তা ব্যবহার করে। মোরগের পা দেখে এমন কিছু করা হলে চাকু খুলে নেয়া হয়। কখনও নক আউট হয়ে যায়। মোরগ লড়াইয়ের অনুকরণে শিশুকিশোরদের একটি খেলার নাম হয়েছে ইংরেজীতে ‘কক ফাইট’। ১০-১২ জন ছেলে বৃত্তকায় দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে পা গুটিয়ে গোড়ালি ধরে রাখে। অথবা দুই হাত পরস্পরে বুকে গুটিয়ে নিয়ে এক পা পেছনের দিকে ভাঁজ করে আরেক পায়ে প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে ডানা দিয়ে আঘাত করে। নির্দিষ্ট বেষ্টনীর মধ্যে উভয় পক্ষের আক্রমণে বিপর্যস্ত হওয়ার পর যার ভঙ্গি অটুট থাকে সেই হয় বিজয়ী। মোরগ-মুরগির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। আর যে মোরগটি লড়তে পারে তার কদর তো আলাদা। লড়াকু মোরগ-মুরগি দেখলেই লোকজন বাহবা দেয়। এবারের বৈশাখী আয়োজনে মাঠ পর্যায়ে অন্যতম আকর্ষণ মোরগ লড়াই। বগুড়া শহরের এ্যাডওয়ার্ড পার্কের একাংশে বগুড়া থিয়েটারের উদ্যোগে বৈশাখী মেলায় মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানালেন, লড়াইয়ের জন্য মোরগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সার্কাসের বড় কাঠের খাঁচায় যেমন জীবজন্তু আনা হয় মেলায় খেলা দেখানোর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মোরগও খাঁচায় ভরে আনা হয়। মোরগ লড়াই বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, গ্রিস, তুরস্ক, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়াতেও জনপ্রিয়। এই লড়াই ঘিরে অনেক জায়গায় বাজিকরও আছে। একটা সময় হাওড় বিল অঞ্চলে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হতো। দুর্দান্ত এই লড়াইয়ে ভারতের কলকাতা থেকেও শৌখিন মোরগওয়ালারা রংবেরঙের লড়াকু মোরগ নিয়ে আসতেন।
×