ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা জব্বার

প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৯ এপ্রিল ২০১৭

প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সোনালি দিন

॥ দ্বিতীয় পর্ব ॥ যন্ত্রে বাংলা ভাষা ॥ সীসা ও ফটোটাইপসেটার ১৪৫৪ সালে জার্মানির গুটেনবার্গ মুভেবল টাইপ দিয়ে মুদ্রণের সূচনা করার আগেও নানা ধরনের মুদ্রণ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। বাংলা মুদ্রণের ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা হরফ তৈরির কাজটি অত্যন্ত কঠিন ও জটিল ছিল। বাংলা মুদ্রণের জন্য এটি দুঃখজনক যে, জার্মানির মুদ্রণ প্রযুক্তি ১৫৫৬ সালে ভারতের গোয়ায় এলেও বাংলায় আসে ১৭৭৮ সালে। মুদ্রণ যন্ত্র আসার বিলম্বের পাশাপাশি বাংলা হরফ বানানোর চ্যালেঞ্জটাও বেশ বড় ছিল। ব্রিটিশ নাগরিক ‘উইলেম বোল্টসন এক ফন্ট (কোন ভাষার সকল বর্ণ ও চিহ্ন যা মুদ্রণে ব্যবহৃত হয় তাকে ফন্ট বলে) বাংলা হরফ নির্মাণের কাজে লন্ডনের বিখ্যাত শিল্পীদের নিযুক্ত করেন। কিন্তু বাংলা টাইপ তৈরির কাজ অত্যন্ত দুরূহ ও জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ বলে বোল্টসনের বাংলা হরফ নির্মাণের কাজ বেশি দূর অগ্রসর হয়নি।’ (কম্পিউটারে প্রকাশনা, দ্বিতীয় সংস্করণ, মোস্তাফা জব্বার পৃ: ৪১) বোল্টসনের ব্যর্থতার কথা বলা হলেও তিনি ও জ্যাকসন বাংলা হরফ তৈরির প্রাথমিক পদক্ষেপে সফল হন। তবে যার ডিজাইন করা বর্ণমালা দিয়ে বাংলা বই প্রথম মুদ্রিত হয় তার নাম চার্লস উইলকিনস। এতে পঞ্চানন কর্মকার নামক এক বাঙালীরও অসাধারণ অবদান ছিল। মুদ্রণ প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বহুজাতিক কোম্পানি লাইনোটাইপ ও মনোটাইপ বাংলা হরফ তৈরির কাজ করেছে ফটোটাইপসেটারের যুগ অবধি। বিশেষত এই দুটি কোম্পানির হাতে লাইনো ও মনো কাস্টিং মেশিন তৈরি হওয়ার ফলে বাংলা মুদ্রণের টাইপোগ্রাফিক পশ্চাৎপদতা অনেকটা কেটে যায়। একইভাবে বিশেষত লাইনোটাইপ তাদের তৈরি ফটোটাইপসেটারে বাংলা হরফের অসাধারণ সৌন্দর্য বিকশিত করে। বাংলা টাইপোগ্রাফির ক্ষেত্রে ইংরেজ রমণী ফিয়োনা রসের কথা না স্মরণ করলে সেটি অন্যায় হবে। ফটোটাইপসেটারের অসাধারণ বাংলা ফন্টটি তারই তৈরি করা। যন্ত্রে বাংলা ভাষা ॥ টাইপরাইটার অন্যদিকে রোমান হরফের জন্য ১৮৭০ সালে টাইপরাইটার প্রচলিত হলেও বাংলাদেশে বাংলা টাইপরাইটার প্রচলিত হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৬৯ সালে শহীদ মুনির চৌধুরী যে কীবোর্ডটি প্রণয়ন করেন তারই আলোকে পূর্ব জার্মানির অপটিমা কোম্পানি অপটিমা মুনির টাইপরাইটার তৈরি করে, যার সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার অফিস-আদালতে বাংলা ভাষা চালু করে। রোমান কীবোর্ডের পেটেন্ট রেমিংটন কোম্পানির থাকার সুবাদে তারা বাংলা টাইপরাইটার তৈরি করেছিল, যা দিয়ে ৭০ দশকে লন্ডন থেকে জনমত নামক একটি সাপ্তাহিক প্রকাশের খবর জানা যায়। ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও একটি রেমিংটন বাংলা টাইপরাইটার ছিল। ভারতে রেমিংটন টাইপরাইটার প্রচলিত ছিল বলেও জানা যায়। পাকিস্তান সরকার অফিসে বাংলা ব্যবহার করেনি বলে সেটি ভারত থেকে ব্যাপকভাবে ঢাকায় আসেনি। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ও বর্ণমালা প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। বিটস পত্রিকায় (এপ্রিল ’৮৮) প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৮২ সালে তাঁর বিভাগে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য গবেষণার কাজ শুরু হয়। এরপর গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ের অগ্রগতির বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, “বিভিন্ন চওড়ার অক্ষর প্রদর্শনের জন্য ইলেকট্রনিক সার্কিট তৈরির কাজ আমরা ১৯৮৫ সালের শেষার্ধে সমাপ্ত করেছি। ...কীবোর্ড এবং কোড তৈরির কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৮৬ সালে। রহমানের বর্ণনা মতে, কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহারের সব কাজই তাঁরা শেষ করেছেন। কিন্তু শেষ করে কি করেছেন তা জানা যায়নি। তাঁদের সে কীর্তি কেউ দেখতে পায়নি।” (সূত্র: মুহম্মদ জালাল, মাসিক সাঁকো, ডিসেম্বর ২০০৪) তবে আমার জানা মতে ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত শহীদলিপিই হচ্ছে প্রথম বাংলা সফটওয়্যার, যা দিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে কম্পিউটারে বাংলা লেখালেখি করা যেত। এটি ছিল এ্যাপল কম্পিউটারের তৈরি মেকিন্টোশ কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম এবং ম্যাকরাইট নামক এপ্লিকেশন প্রোগ্রামের বাংলা অনুবাদ। শহীদ সাহেব প্রথমে ডট মেট্রিক্স ও পরে লেজার প্রিন্টারের বাংলা ফন্টও তৈরি করেন। ১৯৮৪ সালের ২০ জানুয়ারি বাজারজাতকৃত মেকিন্টোশ কম্পিউটারের জন্য সাইফুদ্দাহার শহীদের তৈরি এই সফটওয়্যারটি প্রথম ১৯৮৬ সালে ব্যবহার করে জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট। এরপর শহীদ সাহেবের শহীদলিপি দৈনিক আজাদ, পাক্ষিক তারকালোক ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র নামক প্রতিষ্ঠানে প্রকাশনার জন্যও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু সফটওয়্যারটি ম্যাক ও.এস পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আপডেট না হওয়ায় এবং উইন্ডোজ সংস্করণ প্রকাশিত না হওয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগের আজকের যে প্রবহমান ধারা তার সূচনা ১৯৮৭ সালের ১৬ মে, আমি যখন আমার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক আনন্দপত্র প্রকাশ করি তখন থেকে। আমি কলকাতার রাহুল কমার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের গৌতম সেন ও স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৈরি বঙ্কিম ফন্ট এবং জব্বার কীবোর্ড অনুসারে সৈয়দ মাইনুল হাসানের সম্পাদিত মাইনুললিপি দিয়ে আনন্দপত্র প্রকাশ করি। মাইনুল হাসান আমার অনুরোধে বঙ্কিম ফন্টের কী-ম্যাপিং বদল করে মুনীর কীবোর্ড-এর প্রথম দুটি স্তর এবং আমার তৈরি তৃতীয় ও চতুর্থ স্তর অনুযায়ী মাইনুললিপি তৈরি করেন। আমি সেই কীবোর্ডের নাম রেখেছিলাম জব্বার কীবোর্ড। চার্লস উইলকিন্সের হাতে তৈরি বাংলা হরফের পর ফটোটাইপসেটারে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর তৈরি করা চমৎকার যে বাংলা হরফ আমরা পেয়েছিলাম- তারপর গৌতম-স্বাতী বা মাইনুলের বঙ্কিম/মাইনুললিপি ফন্ট ছিল হতাশাজনক। মাত্র ৩০০ ডিপিআই লেজার প্রিন্টার ফন্টটির অদ্ভুত (অথবা কুৎসিত) চেহারা কোনমতেই বাঙালীর মনের ক্ষুধা মেটাতে পারেনি। কিন্তু বিস্ময়করভাবে সেই ফন্টটি ২৫৬ কোডের কম্পিউটারে ১৮৮টি কোড ব্যবহার করে বাংলা লিপিকে প্রায় অবিকৃত করে প্রকাশ করেছিল। যদিও ডিজাইনে ত্রুটি ছিল এবং সেই হরফে মোটেই পেশাদারিত্ব ছিল না, তবুও মুদ্রক বা প্রকাশকরা সেই ফন্ট দেখে ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী হতে পেরেছিলেন। সেই ঘটনার মাত্র ৪ মাসের মাথায় আমি আমার হাতে তৈরি প্রথম ফন্ট আনন্দ প্রকাশ করি। এই ফন্টটি আশ্চর্যজনকভাবে বঙ্কিম ফন্টের ডিজাইন ত্রুটি কাটিয়ে উঠে এবং সাপ্তাহিক-মাসিক তো বটেই, দৈনিক পত্রিকার বাহন হয়ে যায়। দেশের অন্যতম প্রাচীন দৈনিক পত্রিকা আজাদ তাকে গ্রহণ করে এবং একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, সেই ফন্টটির ডিজাইনার ছিল ¯েœহভাজন হামিদুল ইসলাম। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হামিদুল ইসলামের পর বিজয়-এর জন্য ফন্ট ডিজাইন করেছেন যারা তদের মাঝে উজ্জল কুমার দত্ত ও শিব নারায়ণ দাশও আছেন। তবে আজকের দিনের কম্পিউটারে বাংলার জন্ম প্রকৃতার্থে ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ঐদিন আমি ‘বিজয়’ কীবোর্ড এবং তন্বী সুনন্দা ফন্ট প্রকাশ করি। বিজয় কীবোর্ডের সুবাদে আমি ১৮৮টির বদলে ২২০টি বর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম হই। ফলে বাংলা ভাষা আরও চমৎকারভাবে কম্পিউটারের পর্দায় উপস্থিত হয়। তবে এই সময়কালে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রয়োগের প্রচেষ্টা আরও অনেক হয়েছে। মেকিন্টোশ কম্পিউটারের গ্রাফিক্স সুবিধা কাজে লাগিয়ে এতে ফন্ট তৈরি করেন মাহমুদ হোসেন রতন ও মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানির মেকিন্টোশ কম্পিউটারের আগে বাজারজাতকৃত এ্যাপল সিরিজের কম্পিউটারের জন্য গুটেনবার্গ নামক একটি সফটওয়্যার প্রচলিত ছিল, যাতে বাংলা লেখা যেত। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাঙালী হেমায়েত হোসেনও কম্পিউটারে বাংলা নিয়ে কাজ করেন। অন্যদিকে পিসিতে ডসের অধীনে দোয়ান জান, আবহ, বর্ণ, অনির্বাণ ইত্যাদি সফটওয়্যারের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যেহেতু প্রায় সকল অফিস-আদালতেই পিসি ব্যবহৃত হতো, সেহেতু ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এসব জায়গায় টাইপরাইটারের মানের এসব সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে যেহেতু মুদ্রণ মানটি চিঠিপত্রের মানের সঙ্গে কোনমতেই খাপ খায় না, সেহেতু মুদ্রণ, প্রকাশনা, সাময়িকী ও সংবাদপত্রে বিজয়-মেকিন্টোশের একচেটিয়া রাজত্ব চলতে থাকে। কার্যত ২৬ মার্চ ১৯৯৩তে পিসির উইন্ডোজে বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ম্যাক ও পিসির বাংলা সুস্পষ্টভাবে বিভাজিত ছিল। মুদ্রণ ও প্রকাশনায় সচরাচর পিসি ব্যবহৃত হতো না। কিন্তু উইন্ডোজের বিজয় বার্লিন দেয়ালের মতো ঐ বিভাজন রেখাটি ভেঙ্গে দেয়। একই ফন্ট, একই কীবোর্ড, একই উপায়ে বাংলা লেখা- এমনকি একই এনকোডিং ম্যাক পিসির পার্থক্য ঘুচিয়ে দেয়। ম্যাক ও উইন্ডোজে বাংলা প্রচলিত হওয়ার পর মুক্ত ও.এস লাইনাক্সেও বাংলা প্রচলিত হয়। পরবর্তীতে নতুন শতকে ইউনিকোড এনকোডিং বিশেষত ইন্টারনেটে আসকিকে স্থলাভিষিক্ত করে এবং ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এর চতুর্থ সংস্করণ থেকে বাংলা ভাষার ইউনিকোড এনকোডিং ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে এবং ২০০৪-এর শেষ প্রান্তে এসে আমাদের বিজয় ইউনিকোডকেও একটি ভিন্ন এনকোডিং পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করে। ডাঃ মেহদী হাসান খান নামক এক তরুণ ২০০৩ সালে ইউনিবিজয় নামক ইউনিকোডভিত্তিক একটি বাংলা সফটওয়্যার তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে অভ্র নামে পরিচিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর নাজনীন সুলতানা একটি বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসর তৈরির চেষ্টা করেন, যা আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। অন্যদিকে শামীম হাসনাত রিদমিক নামক একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছেন, যা এন্ড্রয়েড-এ চলে। মায়াবী নামে আরও একটি সফটওয়্যার দিয়ে স্মার্টফোনে লেখা যায়। ঢাকা, ৩১ মার্চ, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েপ পেইজ www.bijoyekushe.net
×