ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

‘গণতান্ত্রিক দুনিয়ায়’ আই পি ইউ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৫ এপ্রিল ২০১৭

‘গণতান্ত্রিক দুনিয়ায়’ আই পি ইউ

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আই পি ইউ)-এর সম্মেলন থেকে যখন বলা হচ্ছে ‘সার্বভৌম ছোট রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ইন্টারভেনশন মেনে নেয়া হবে না।’ তখন চোখের সামনে আরও একবার ঝলসে ওঠে অগ্রসর পুঁজির দেশগুলোর চিত্র। সেখানে ব্যাংক মালিক বা কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা কোনরকম রাখঢাক না করেই সরকার রদবদল করছে। যাকে সেসব দেশেই উল্লেখ করা হচ্ছে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হিসেবে। কখনও কখনও অভ্যুত্থান হিসেবে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যেভাবে শর্তের পর শর্ত চাপিয়ে দেয়া হত তার চেয়েও কঠোরভাবে শর্ত চাপানো হচ্ছে অগ্রহসর পুঁজিবাদী নানা দেশে। বিশ্ব ব্যবস্থার আর্থিক সঙ্কট, ব্যাংক ও ঋণসঙ্কট মূলত এর জন্য দায়ী। একে আড়াল করতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো আপোষ করছে পাশ্চাৎপদ, মধ্যযুগীয় নানা ধারনা ও ভাবাদর্শের সঙ্গে। এগুলোর লালন ও পরিচর্যা করে নানান মোড়কে উপস্থাপন করছে। যার আসল উদ্দেশ্য গণতান্ত্রিক জীবন গড়ার জন্য জনগণের সংগ্রামকে বাধা দেয়া। বিশ্বের সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ফোরাম আই পি ইউ তার একশ’ ছত্রিশতম সম্মেলনে যখন বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্থায়ী করার কথা বলছে তখন বর্তমান বিশ্বের উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে না তাকিয়ে পারা যায় না। এ ব্যবস্থাই সৃষ্টি করেছে এক শতাংশ বনাম নিরানব্বই শতাংশের বৈষম্য। গণতান্ত্রিক জীবন গড়ার পথে যা সবচেয়ে বড় বাধা। বর্তমান বিশ্বের তথাকথিত বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য এত প্রকট যে অর্থনীতিবিদ পিকেটি, সায়েজ ও জুকম্যান একে বলেছেন, ‘যেন যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই দুটি দেশÑএকদিকে অতি ধনীদের অন্য দিকে অতি গরিবদের’। আই পি ইউর বয়স একশ আটাশ বছর। এর মধ্যে গণতন্ত্র রক্ষায় তাদের অবদান কতখানি তা সংগঠনটির নিউইয়র্কভিত্তিক প্রধান কার্যালয়ই ভাল বলতে পারবে। ॥ দুই ॥ উপনিবেশ-উত্তর দেশগুলোতে বা ‘নতুন উপনিবেশ’গুলোতে সামরিক শাসন চাপিয়ে দেয়ার পুরনো কৌশলের জায়গায় নতুন ব্যবস্থা হিসেবে যা চাপানো হয়েছে তা পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রকদের ডিজাইন করা গণতন্ত্র। বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মতো প্রান্তের দেশগুলো মূলত সে লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। জেনারেল মটরস, ওয়ালমার্ট, এক্সন-মবিল, ফোর্ড এবং ডাইমলার- ক্রাইসলারের সামগ্রিক বিক্রি পৃথিবীর একশ’ বিরাশিটি দেশের জিডিপির চেয়ে বেশি। আর মাইক্রোসফট, কোকা-কোলা এবং আইবিএম কোম্পানির বার্ষিক বিক্রি তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সম্মিলিত জিডিপি ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। এদের কাছে অন্য সব কিছুর মতো গণতন্ত্রও একটি পণ্য। এ পণ্য বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। বিশেষ করে যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এসব দেশ বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে নানান আইন ও চুক্তিতে জড়িয়ে নিজেদের সম্পদ ওসব কোম্পানির হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দেয়। বৃহৎ পুঁজিকে সার্ভিস দিতে এসব দেশ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যুত সরবরাহ আর্থিক লেনদেনের আধুনিকায়ন ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোযোগী হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে আছে মার্কিন কর্পোরেশনগুলো। মার্কিন গবেষক হাওয়ার্ড জিমের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ষাটভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলো নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এবং তা এই ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়ায়। গত শতকের আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বাজার সম্প্রসারণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্র বদলের সঙ্গে এরপর ধীরে ধীরে আমদানি হয় গণতন্ত্র। কেননা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে লুটপাট ও দখলদারিত্ব ভদ্রস্থ গ্রহণযোগ্যতা পায়। বাংলাদেশের দিকে তাকালেও এ চিত্র দেখি। উনিশ শ’ একানব্বই সালে গ্যাট চুক্তি থেকে শুরু করে দু’হাজার তেরোর টিক্্ফাÑ সব চুক্তি সই হয়েছে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়। গ্যাট চুক্তির মধ্যদিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোর তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির হাতে চলে যাওয়ার সহজ পথ তৈরি করেছিল। স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষা, শিল্প ও কৃষিনীতির পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি এখন বিক্রয়যোগ্য একেকটি পণ্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থানÑপ্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও এগুলো চড়াদামে বিক্রি হয় বলে বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ থেকে প্রায় বঞ্চিত। ইংল্যান্ডের দ্যা ইকোনমিস্ট পত্রিকা দু’হাজার আট-এ বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ গণতন্ত্রের নামে এখনও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় বাস করেন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র বা বহুদলীয় গণতন্ত্রের ঢাকঢোল পেটানো হয় এই জনগণের নামে। তাদের নামে নির্বাচন হয়। সংসদ বসে, উন্নয়নের নানান পরিসংখ্যানের প্রজেকশন হয়। অথচ প্রাকৃতিক যে সম্পদের মালিক জনগণ তা যখন বিভিন্ন চুক্তির নামে বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে চলে যায় অন্ধ বোবা কালা জনগণ তার কিছুই টের পায় না। অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে এখন সংসদের কোন ভূমিকা নেই। এ দায়িত্ব চলে গেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব প্রক্রিয়ার কেন্দ্রের কর্পোরেট পুঁজির হাতে। তাদের দরকার এমন শাসনব্যবস্থা যা প্রান্তের দেশগুলোর পুঁজির প্রবাহ ও উদ্বৃত্তের প্রবাহ প্রাপ্তি নিরাপদ রাখতে পারে, জনগণের অসন্তোষ বা ক্রোধ থেকে ব্যবস্থাটি রক্ষা করে চড়া মুনাফা ফেরত নিশ্চিত করতে পারে। তাই তাদের জন্য সহায়ক গণতন্ত্রকেই তারা বিভিন্ন দেশে চালান করে। আর তাই নিয়ে পরিচালনার গণতান্ত্রিক খেলোয়াড়দের কাড়াকাড়ি, লাফালাফি। তাদের পেছনে অবস্থান নেন সুশীল সমাজ নামের সুবিধাবাদীগোষ্ঠী। তারা ভাল করেই জানেন, বলটি কোথায় থাকে। বল পাওয়ার জন্য শাসক শ্রেণীর মূল শক্তিগুলো প্রতিযোগিতা করে প্রভুদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। সামরিক বেসামরিক গোপন, উন্মুক্ত নানান চুক্তি আসলে প্রভুদের জন্য পাঠানো উপঢৌকন। যার কাছ থেকে যত বেশি উপঢৌকন পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে গণতন্ত্রের বলটি তার কোর্টেই যাবে। এ হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের গণতন্ত্রের পেছনের সরল অঙ্ক। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ। স্বাভাবিক কারণেই বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজির এ ভূখ- নিয়ে নানা ধরনের হিসাবনিকাশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটেই আজ শেষ হচ্ছে আই পি ইউ সম্মেলন।
×