ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জলজ ফুলের ভুবনে শীর্ষে, প্রকৃতির অপার নিসর্গ...

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৫ মার্চ ২০১৭

জলজ ফুলের ভুবনে শীর্ষে, প্রকৃতির অপার নিসর্গ...

সমুদ্র হক ॥ পদ্ম ও শাপলা ফুল দেখতে প্রায় একই রকম হলেও এদের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। শাপলা নিয়ে মানুষের মনে যতটা কৌতূহল, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌতূহল পদ্ম ফুল নিয়ে। প্রকৃতিতে পদ্মের নিষ্ঠা সূর্যের সঙ্গে আর শাপলার সম্মোহন চাঁদের সঙ্গে। পদ্মের মধ্যে নীলপদ্ম জলজ ফুলের ভুবনে শীর্ষে। নীলপদ্মের দেখা পাওয়া সহজ নয়। তবে পদ্ম ফুল তার ৬৪টি পাঁপড়ি মেলেই নিজেকে প্রদর্শন করে স্বাগত জানায়। যে পদ্মই হোক প্রকৃতির নিসর্গের রূপ নিয়েই এসেছে ভুবনে। এই পদ্মই আবার রহস্যের সৃষ্টি করেছে। ইতিহাসের পাতায় মিসরের রাজকুমারী ক্লিওপেট্রা নিজে যত না রহস্যময়ী, তার চেয়ে বেশি রহস্যের সৃষ্টি করে তার প্রিয় ফুল পদ্ম। পদ্মকে নিয়ে অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে যুগে যুগে। প্রাচীন মিসরে টলেমি যুগে দীর্ঘ সময় ধরে একছত্র ক্ষমতায় থাকা রহস্যময়ী ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতির চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর এবং প্রতাপশালী নারী ছিলেন হাটশেপসুট। তিনি প্রতিদিন প্রাসাদে বসে পদ্মের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। প্রাসাদে তার সামনেই জলাধার নির্মাণ করে পদ্ম ফোটানো হতো। তাদের উত্তরসূরিরা এই ধারাতেই পদ্মকে রাখতেন। ক্লিওপেট্রা রোমান বীর জুলিয়াস সিজারের প্রেমে পড়ে প্রাসাদজুড়ে গোলাপ বিছিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে তাদের প্রণয়ের অভিষেক হয় পদ্ম দিয়েই। (ক্লিওপেট্রার সঙ্গে সিজারের শুধুই মিষ্টি প্রণয় ছিল)। নানাভাবেই জলপদ্ম প্রাচীন মিসরের রাজ শক্তির প্রতীক হয়ে আছে। পৌরাণিক থেকে কিংবদন্তি...প্রকৃতির নিসর্গে বড় আসন করে নিয়েছে এই পদ্ম। যে ফুল মানব মনে জাগায় বিস্ময়কর অনুভূতি। রোমান্টি সিজমকে সঙ্গে নিয়ে থাকে। পৌরাণিক কাহিনীতে পদ্মকে সূর্য ও পুনর্জন্মের প্রতীক বলা হয়েছে। উপমহাদেশের বরেণ্য সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যাায় ‘কেউ কথা রাখেনি...’ কবিতায় রূপক বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য প্রেমিক দুঃসাধ্য সাধন করে ১০৮টি পদ্ম সংগ্রহ করেছিল। রামায়নে বর্র্ণিত আছে দুর্গা পুজোয় রামচন্দ্র দেবীকে ১০৮টি পদ্ম অঞ্জলি দিলে দেবী মুগ্ধ হন। সেই থেকে পদ্মকে সুন্দর চোখের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। ভারতের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী শ্যামল মিত্রের (প্রয়াত) একটি গানের কথায় আছে ‘ওই পদ্ম চোখের নীল যমুনায় আমি ঝাঁপ দিয়েছি.....।’ অনেক পুষ্পানুরাগী পদ্মকে লালন করে ফুটিয়েছেন। তাদের একজন বগুড়ার সবুজ নার্সারির স্বত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান। কিশোর বেলার পুষ্পপ্রেমী থেকেই নার্সারির আঙ্গিনায় পা দিয়েছেন তিনি। চেনা ফুলের সঙ্গে ‘আনকমন’ ফুলের চারা সংগ্রহ করেন দেশ-বিদেশের নানা জায়গা থেকে। বিশেষ প্রক্রিয়ায় মাটির বড় চাড়িতে (বড় পাত্র) পানি ভরে ছোট জলাধার সৃষ্টি করে পদ্ম ফোটাবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তিনি। এর আগে চাড়ির নিচে কিছু কাদা মাটি তৈরি করেন। সামান্য জৈব সার দেন। মাস দুয়েকের মধ্যে পদ্ম চোখ মেলে তাকায়। পাঁপড়ি ছড়িয়ে দেয়। বর্ষা মৌসুম পদ্ম চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় যে কোন সময় রোপণ করা যায়। কেউ পুকুরে পদ্ম ফোটাতে চাইলে তাও পারবেন। বাড়ির টবে পদ্ম ফোটাতে দরকার হয় বিশেষ ধরনের বড় টব। উদ্যানতত্ত্ববিদ মাসুদার রহমান জানান, বিশ্বে সকল ধরনের পদ্মের প্রেম পানির সঙ্গে। যে কারণে পানির সংস্পর্শ রাখতেই হয়। পদ্ম দিনের আলোয় দ্যুতি ছড়ায়। পদ্ম ও শাপলা দূর থেকে প্রায় একই রকম মনে হয়, কাছে গিয়ে ধরা পড়ে পার্থক্য। পদ্মের ইংরেজী নাম বেশ কয়েকটিÑ লিলি নাইল, ইজিপসিয়ান লিলি, দ্য ফ্লাওয়ার অব এ্যানসিয়েন্ট ইজিপশিয়ান। বিজ্ঞান নাম নিমফাইয়া কেরুলা। সাধারণ পদ্ম (সাদা ও গোলাপী রঙের) হরহামেশাই দেখা যায়। আমাজান লিলি পদ্মেরই একটি ভিন্ন জাত। চর্যাপদে বাংলা ভাষার সাহিত্য সৃষ্টির সূচনায় আছে পদ্মের পাঁপড়ি ৬৪টি। পাঁপড়ির নিচে অনেকটা হলদেটে পাঁপড়ি আছে কয়েকটি। ফুলের মধ্যের অংশের পুষ্পরেণুর শাখা হলদেটে। বৌদ্ধদের কাছে পদ্ম এতটাই পবিত্র যে মহাযানী বৌদ্ধের একটি সূত্রের নাম পদ্মসূত্র। বৈদিক যুগেরও আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে পদ্মেরই উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মনে করেন, সিদ্ধার্থের সাধনায় প্রমাণিত হয়েছে সবকিছুই আছে মণিপদ্মে। এই মণিপদ্মেরই একটি রূপ নীলপদ্ম। দেশে দেশে লোক সংস্কৃতিতে ফুল অপরিহার্য। কোন ফুল সৃষ্টি করে কিংবদন্তি। খ্রীষ্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতার পরিচয়বাহী মৃৎপাত্রে পদ্মের নক্সা পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে প্রাচীন নানা স্থাপনায় ও পাত্রে পদ্ম ফুলের অজস্র চিত্র দেখা যায়। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই যেখানে পুষ্পের কদর ও গুরুত্ব নেই। গাছে পুষ্পকলির আবির্ভাবের সঙ্গে জীব জগতের যৌবন সন্ধিক্ষণের তুলনা করা হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নের কথা, ফুল বিলুপ্ত হতে থাকলে সে জায়গা মানুষ বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। গ্রিক উপাখ্যানে প্রেমের দেবী ভেনাসের জন্মের সঙ্গেই আছে ফুলের সম্পর্ক। পৌরাণিক কাহিনীর ব্রহ্মা দাবি করেছিলেন পৃথিবীতে পদ্মই শ্রেষ্ঠ। সেই আদিকাল থেকে ফুল মানব জীবনকে সুন্দরের ধারায় এগিয়ে নেয়।
×