ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুরো এলাকা বিশেষ নজরদারিতে ॥ জীবিত আটক দম্পতিকে ঢাকায় প্রেরণ

সীতাকুণ্ডে নিহত জঙ্গীদের একজন রোহিঙ্গা নারী ॥ চার মামলা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৮ মার্চ ২০১৭

সীতাকুণ্ডে নিহত জঙ্গীদের একজন রোহিঙ্গা নারী ॥ চার মামলা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস/সীতাকুণ্ড- সংবাদদাতা ॥ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান ও সাঁড়াশি অভিযানের পর ছায়ানীড় নামে ভবনটির অভ্যন্তর থেকে মৃতদেহ এবং মানব দেহের খণ্ড-বিখণ্ড- টুকরা ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদি উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে বৃহস্পতিবার গভীর রাতেই। এ ভবনে নিহত ৪ জঙ্গীর মধ্যে ২ জন এবং সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার জঙ্গী দম্পতি পরস্পরের আত্মীয়। এদের একজন রোহিঙ্গা নারী বলে নিশ্চিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ডোম দিয়ে ছায়ানীড় ভবনের জঙ্গীদের আস্তানাটি পুরো ফ্ল্যাটটি পরিষ্কার করা হয়েছে। মৃতদেহ ও মানব দেহের খণ্ড- খণ্ড- অংশগুলো পুলিশ সংগ্রহ করে ময়নাতদন্ত এবং ফরেনসিক বিভাগে প্রেরণের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ দুটি ঘটনায় স্থানীয় থানায় পৃথক চারটি মামলা দায়ের হয়েছে। অস্ত্র, বিস্ফোরক, হত্যা ও সন্ত্রাস দমন অধ্যাদেশ আইনে এ মামলা চারটি হয়েছে বলে সীতাকু- পুলিশ জানিয়েছে। এসব মামলায় ৬ জন এবং অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। ছায়ানীড়ের মালিক মহিলা রেহেনা বেগম এবং তার দুই পুত্র মহিউদ্দিন ও নাসিরকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ছায়ানীড় ভবনটি পুলিশী প্রহরার নিরাপত্তাধীনে রাখা হয়েছে। অপরদিকে, সাধন কুঠিরের মালিক ও তার পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছেন। সুভাষ দাশকে ইতোমধ্যে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে তার বক্তব্য নিয়েছে। তিনি নিজের ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা চেয়েছেন পুলিশের কাছে। পুলিশ তাকে আশ্বস্ত করেছে। নিরাপত্তা বিধানে তার বাসার সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনার পর শুক্রবার দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা সাংবাদিকদের পুরো ঘটনা নিয়ে ব্রিফিং করেছেন। পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, তারা গ্রেফতারকৃত ও নিহত জঙ্গীদের সম্পর্কে দু’ধরনের তথ্য পেয়েছেন। পুলিশের মতে, ছায়ানীড় ভবনে নিহত জোবাইদা সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতারকৃত জসিমের বোন। আর কামাল জহিরের দুলাভাই। অপরদিকে, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তথ্য পেয়েছে, জোবাইদা ও আরজিনা সম্পর্কে আপন বোন। সে সুবাধে জসিম ও কামাল পরস্পরের ভায়রা। এদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর আরও তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী দম্পতির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া গেছে। জঙ্গী জসিমের প্রকৃত নাম জহিরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী আরজিনার নাম রাজিয়া সুলতানা। আরজিনা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। জহিরুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারি নামক স্থানে থাকত। জঙ্গী সন্ত্রাসে জড়িত হওয়ার পর তারা চট্টগ্রামে এসে সীতাকু-ের সাধন কুঠিরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। এছাড়া অদূরের ছায়ানীড় ভবনে নিহতরা হচ্ছে কামাল উদ্দিন, তার স্ত্রী জোবাইদা এবং তাদের এক শিশু সন্তান। প্রথমদিকে তার বয়স ৮ বছর বলে জানা গেলেও শুক্রবার পুলিশ নিশ্চিত করেছে, শিশুটির বয়স ২ বছর। উল্লেখ্য, সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতারকৃত জসিমের বোন জোবাইদা এবং তার স্বামী কামাল উদ্দিন যারা তাদের শিশুপুত্র নিয়ে ছায়ানীড় ভবনের নিচতলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল। নিহত জঙ্গীদের অবশিষ্ট দুজনের প্রকৃত পরিচয় এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে একজনের নাম রাশেদ এবং আরেকজনের নাম হৃদয় বলে জানা গেছে। নাম দুটিও ছদ্মনাম বলে ধারণা করা হচ্ছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি সূত্রে জানানো হয়েছে, দু’জনই ঢাকার মিরপুরে থাকত। গত কয়েক মাস আগে তারা হঠাৎ করে বাসা থেকে উধাও হয়ে যায় এবং জঙ্গী সন্ত্রাসে যুক্ত হয়। মূলত, এরা চট্টগ্রাম অঞ্চলে জেএমবির কমান্ডেই চলে আসছিল। বড় ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানোর ছক এঁটেছিল। কিন্তু তার আগেই সাধন কুঠিরের মালিক সুভাষ দাশের সাহসিকতার কারণে জসিম ও আরজিনা (সাংগঠনিক নাম) ধরা পড়ে গেলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর ছায়ানীড়ের আস্তানার তথ্য বেরিয়ে আসে। এরপরই পরবর্তী ঘটনা অর্থাৎ পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে এক শিশু ও ৪ জঙ্গী মারা যায়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, মহিলা ও এক জঙ্গী পুলিশের গুলিতে এবং অপর দুই জঙ্গী আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তাদের মৃত্যু হয়। আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহতদের দেহের বিভিন্ন অংশ ভবনটির বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। একটি ভবনের ছাদে পাওয়া যায় এক জঙ্গীর হাত। ৫ শ’ গজ অদূরে সীতাকু- কলেজের পেছনের বিলে পাওয়া যায় এক জঙ্গীর দেহবিহীন মু-ু। পুলিশ সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে, জহিরুল ইসলাম ও রাজিয়া সুলতানার সাংগঠনিক নাম জসিম ও আরজিনা। জসিমের বাড়ি কক্সবাজারের রামু বলে তথ্য দিয়ে সীতাকু-ের সাধন কুঠিরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। অপরদিকে, নিহত জঙ্গী কামালের প্রকৃত ঠিকানা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। এই দুই পরিবার সীতাকু-ের আমিরাবাদের নামার বাজার এবং কলেজ রোডের চৌধুরী রোডের প্রেমতলায় আস্তানা গেড়েছিল। প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে মাত্র ৪৫ মিনিটের অভিযানে ৪ জঙ্গী ও ১ শিশু প্রাণ হারায়। এর আগে সাধন কুঠির থেকে গ্রেফতার হয় জঙ্গী দম্পতি জসিম ও আরজিনা। জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে সীতাকু- ও মীরসরাইজুড়ে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশেষ করে সীতাকু-ের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বহিরাগত ভাড়াটিয়াদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়ির মালিকদের সতর্কও করা হয়েছে। উল্লেখ্য, কিছু দিন আগে কুমিল্লায় বাসে তল্লাশি চলাকালে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর মীরসরাইতে দুই জঙ্গী ধরা পড়ে। এরপর সীতাকুণ্ডের সাধন কুঠির ও ছায়ানীড়ে দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলে। ছায়ানীড় ভবনের গৃহকর্ত্রী ও তার দুই পুত্রকে বৃহস্পতিবার থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর শুক্রবার ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর নিহত জঙ্গীদের মরদেহ চমেক হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। ঢাকা থেকে পুলিশের ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ দল আলামত সংগ্রহ করেছে। এদের ডিএনএ টেস্টও করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে। জনমনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ॥ ফটিকছড়ি থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, চট্টগ্রামের সীতাকু- ও মীরসরাইয়ে জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মেলার পর ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতেও জনমনে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে এই দুই উপজেলার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠা ভবনে বসবাসরত অপরিচিত ভাড়াটিয়াদের নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন বাড়ির মালিকরা। সন্দেহ ভর করায় ভাড়াটিয়াদের পরিচয়পত্রসহ বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে তারা তৎপর হয়েছেন। হাটহাজারী উপজেলায় রয়েছে অঞ্চলের সবচেয়ে বড় কওমি মাদ্রাসা। সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয় হাটহাজারী থেকে। পাশ্ববর্তী ফটিকছড়ি এমনকি রাঙ্গুনীয়া উপজেলাতেও রয়েছে সংগঠনটির কার্যক্রম। সময়ের প্রয়োজনে দুই উপজেলায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য বাড়িঘর, যেগুলোতে অনেক ভাড়াটিয়া রয়েছেন। সীতাকু-ের ঘটনার পর উপজেলায় জনমনে জঙ্গীভীতি কাজ করছে। আবাসিক ভবনের মালিকরাও ভারাটিয়াদের নিয়ে রীতিমতো সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। পাহাড়ী অঞ্চলে অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় বেড়েছে আবাসিক ভবনও। জঙ্গীবাদী তৎপরতাও উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। নিহত জঙ্গীরা প্রথমে ছিল পটিয়ায় ॥ সীতাকু-ে নিহত জঙ্গীদের অবস্থান প্রথমে ছিল চট্টগ্রামের পটিয়া পৌর সদরে। তারা আমির ভা-ার রেলগেট এলাকার নুরুল আমিন মুন্সির ভবনের তৃতীয়তলায় তিন মাস অবস্থান করে। প্রতি মাসের ৫ তারিখ ভবনের মালিককে ৭ হাজার টাকা করে ভাড়া প্রদান করতেন। তাদের মধ্যে দুইজন পুরুষ, একজন মহিলা ও একজন শিশু ছিল। সীতাকু-ের অপারেশন এ্যাসল্ট-১৬ তে যোগ দেয়া পটিয়া থানার ওসি শেখ মোঃ নেয়ামত উল্লাহ শুক্রবার বিকেল সোয়া পাঁচটায় পটিয়ার ভবনটি তল্লাশি চালিয়েছে এবং ভবনের মালিকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এ সময় নিহত পুরুষ, মহিলা ও শিশুর ছবি দেখালে ভবনের মালিক নুরুল আমিন জঙ্গীদের শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান মহাসড়ক ও পটিয়া থানা থেকে পৌনে এক কিলোমিটার দূরত্ব আমির ভা-ার রেলগেট এলাকার নুরুল আমিন মুন্সির ভবনটি। সীতাকু-ে অভিযানের তিনদিন পূর্বে পটিয়া সদরের একই এলাকার মহিউদ্দিন টাউয়ারে যৌথবাহিনী ভোরে অভিযান চালালেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। কারণ, এর আগেই জঙ্গীরা সীতাকু- উপজেলার কলেজ সড়কের চৌধুরীপাড়ার ছায়ানীড় নামের ওই ভবনে আশ্রয় নেয়। পটিয়া থানার ওসি শেখ মোঃ নেয়ামত উল্লাহসহ সীতাকু- অপারেশনে অংশ নেয়া উপ-পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন, কুতুব উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, বাসু দেব, সোহেল সরকার পটিয়ার ভবনটি তল্লাশি চালায়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পটিয়া থানার ওসি (তদন্ত) রেজাউল করিম মজুমদার। এ বিষয়ে ভবনের মালিক নুরুল আমিন বলেন, আল্লাহ জঙ্গীদের থেকে ভাড়াটিয়া ও আমার পরিবারকে রক্ষা করেছে। এদিকে, কয়েক দিন ধরেই পটিয়া পৌর সদরে মাইকিং চলছে প্রকৃত ভাড়াটিয়াদের তালিকা ও ছবি থানায় জমা দিতে। জঙ্গীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে মাইকিং ও ভাড়াটিয়াদের নামের সংগ্রহ করা হচ্ছে। এতে কোন মালিক অবহেলা করলে ও সঠিক তথ্য না দিলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
×