ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৪ মার্চ ২০১৭

গণহত্যা স্মরণ দিবস পালন কেন জরুরী

॥ চতুর্থ কিস্তি ॥ ৩০ লাখ শহীদের ব্যাপারটি কিভাবে এলো তারপর তা ব্যাখ্যা করেছেন ডেভিড। ১৯৭২ সালে ১৮ জানুয়ারি ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘৩ সরষষরড়হ ঢ়বড়ঢ়ষব যধাব নববহ শরষষবফ, রহপষঁফরহম পযরষফৎবহ, ড়িসবহ, রহঃবষষবপঃঁধষং, ঢ়বধংধহঃং, ড়িৎশবৎং, ংঃঁফবহঃং...’ ফ্রস্ট তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সংখ্যাটি যে ৩ মিলিয়ন তিনি তা কিভাবে বুঝলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি ফেরার আগেই আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরাখবর আসছে, এখনও সঠিক সংখ্যায় উপনীত হইনি তবে তা কিন্তু ৩ মিলিয়নের নিচে হবে না।’ এর আগে ১০ জানুয়ারিও তিনি একই সংখ্যার কথা বলেছিলেন। এরপর ডেভিড এ প্রসঙ্গে কট্টর মুজিব ও আওয়ামী লীগবিরোধী মাহমুদুর রহমান মার্কা সাংবাদিক, বিবিসির এককালীন কর্মী সিরাজুর রহমানের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। সিরাজ লিখেছেন, ৩ লাখকে শেখ মুজিব ইংরেজীতে ৩ মিলিয়ন বলেছেন। সিরাজ এ মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধুর ইংরেজী জ্ঞানের প্রতি কটাক্ষ করতে চেয়েছেন। সিরাজুর রহমানের বই পড়েছি। ইংরেজী নিশ্চয় ভাল জানেন লন্ডনে থাকার কারণে। বঙ্গবন্ধুর ইংরেজী ভাষণও পড়েছি। সিরাজুর রহমানের ইংরেজী এর চেয়ে উত্তম এমন দাবি করা যায় না। বাংলা গদ্য তো নয়ই। সিরাজুর রহমানের যে দৃষ্টিভঙ্গি তাতে তিন লাখও তার কাছে বেশি মনে হওয়া স্বাভাবিক। সংখ্যাটি ৩০ হাজার হলে বোধহয় তিনি সন্তুষ্ট হতেন। এস এ করিমের প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর জীবনী থেকেও ডেভিড উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনিও লিখেছেন, ৩০ লাখ ‘হড় ফড়ঁনঃ ধ মৎড়ংং বীধমমবৎধঃরড়হ’। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, প্রাভদায় সংবাদটি ছাপা হয়েছিল। বার্গম্যান বলেছেন, প্রাভদার হিসাবটা গোলমেলে [কমিউনিস্টদের কাগজ সেজন্য; ইহুদী বা ইউরোপীয়দের হলে না হয় মানা যেত।] কারণ প্রাভদা লিখেছিল, পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে [ফধুং রসসবফরধঃবষু] ৮০০ বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। আসলে ঠিক সংখ্যা হবে ২০। বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে। এই বুদ্ধিজীবীর অন্তর্গত [দেখুন রশীদ হায়দার সম্পাদিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ] বিভিন্ন পেশার মানুষ। ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২০ জন বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে? জামায়াতীদের কাছেও অপমানজনক মনে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানকে সামান্য একটু প্রশংসা করেছেন ডেভিড। ফ্রস্টের সাক্ষাতকারের পরপরই তিনি দুটি কমিটি করেছিলেন মৃতের সংখ্যা জানার জন্য। কমিটি নাকি প্রাথমিক রিপোর্টও দিয়েছিল। সে রিপোর্টে নাকি ৫৭,০০০ জন মৃতের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। সেজন্য এরপর সরকার এ নিয়ে এগোয়নি। প্রশ্ন জাগে, নিয়াজী যে ১৫ লাখের কথা বলেছিলেন সেটি কী কারণে? এরপর ডেভিড কলেরা হাসপাতাল, যা এখন আইসিডিডিআরবি নামে পরিচিত তাদের একটি জরিপের উল্লেখ করেছেন। মতলব থানা নিয়ে জরিপটি পরিচালিত হয়েছিল। ওই থানায় তাদের অনুমান ৮৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ওই হিসাবে মৃতের সংখ্যা তারা ৫ লাখ বলে অনুমান করেছে। ২০০৮ সালে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল অনুসারে, ১৯৭১ সালে নিহতের সংখ্যা ১,২৫,০০০ থেকে ৫,০৫,০০০ জন। আর জে রুমেল বলছেন ১৫ লাখ আর শর্মিলা বোসের হিসাব অনুযায়ী ৫০ হাজার থেকে ১০০,০০০। এ রকম আরও কিছু হিসাব দিয়েছেন তিনি। উপসংহারে তিনি লিখেছেন, যে কোন সংঘাতে নিহতের সংখ্যা নিরূপণ করা মুশকিল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি বেশি প্রযোজ্য- এর ‘পার্টিজান পলিটিকসের’ কারণে এবং এ কারণে এ বিষয়ে স্বাধীন গবেষণা করা কঠিন। এটা ঠিক পাকিস্তানীরা অনেক হত্যা করেছে। মৃতের সংখ্যা যাই হোক সরকারের বর্তমান নীতি যে অপরাধীর বিচার তাতে [এ সংখ্যা] কোন অভিঘাত হানবে না। তার ভাষায় ‘This is pity- as the number of civilians who were killed in atrocities by the Pakistan military in 1971 was, without doubt, very high. Whatever might be the actual figure, it would not affect the governmentÕs current policy for the need for criminal accountability for these offences.’ বার্গম্যান যে সব যুক্তি দিয়েছেন এগুলো যে খুব নতুন তা নয়। আমরা এর বিপরীতে যেসব যুক্তি দেব তাও নতুন নয়। রবার্ট পেইন সেই ১৯৭২ সালে যেমন ম্যাসাকারে লিখেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘৩০ লাখ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খাবার খুঁটে খাবে।’ এখন যদি বলি সামরিক বাহিনীর প্রধানের আদেশ তার সৈন্যরা মেনে ৩০ লাখ হত্যা করেছে তাহলে এ যুক্তি অসার এমন কথা কি বলা যাবে? প্রাভদা ইয়াহিয়ার কথার আলোকেও এই সংখ্যা উল্লেখ করে থাকতে পারে। মুক্তমনা ওয়েবসাইটে আবুল কাসেম একটি প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, ১৯৮১ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপে লেখা হয়েছে, বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ মারা হয়েছে। গণহত্যার ইতিহাসে এই হার সবচেয়ে বেশি। [ 'Among the genocides of human history, the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 (six thousand) to 12000 (twelve thousand) people were killed every single day... This is the highest daily average in the history of genocides.’] জাতিসংঘের হিসাব ধরে আবুল কাসেম একটি হিসাব করেছেন। তার মতে, হত্যা হয়েছে ২৬০ দিন। সে হিসাবে জাতিসংঘের সর্বনিম্ন হিসাব ধরলে তা দাঁড়ায় ৬০০০২৬০= ১৫ লাখ ৬০ হাজার। আর সর্বোচ্চ মাত্রা ধরলে= ১২০০০২৬০= ৩১ লাখ ২০ হাজার। তার মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ৪০% পরিবারের কেউ না কেউ মারা গেছেন এবং পাকিস্তানী প্রতিটি সৈন্য প্রতি ১০ দিনে ১ জন করে হত্যা করেছে। এখানে রাজাকার, আলবদর কর্তৃক হত্যার সংখ্যা ধরা হয়নি। পাকিস্তানী সেনা অফিসার কর্নেল নাদের আলী যিনি ১৯৭১ সালে এখানে ছিলেন এবং গণহত্যা করে ও দেখে সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। লিখেছেন, তাকে আদেশ দেয়া হয়েছিল ‘মুজিবের জেলায় [হোম ডিস্ট্রিক্ট] যত বেজন্মাকে পাওয়া যায় তাদের হত্যা কর এবং কোন হিন্দু যেন বাদ না যায়।’ এ ধরনের আদেশ যখন দেয়া হয় তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা কী পরিমাণ হত্যা করতে পারে তা অনুমেয়। এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় এবং শরণার্থী শিবিরে কত মানুষ মারা গেছেন সে হিসাব কিন্তু গণহত্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সে হিসাবও কিন্তু গণহত্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। এ রকম অনেক তথ্য-উপাত্ত ৩০ লাখ শহীদের পক্ষে দেয়া যায়; কিন্তু আমি দেব না। কারণ, এগুলো কুতর্ক। বিশেষ উদ্দেশ্যে এসব বিতর্ক উত্থাপন করা হয়। বলতে পারেন তাহলে আমি বিতর্কে যোগ দিচ্ছি কেন? না, যোগ দিতে চাইনি। কিন্তু বার্গম্যানের লেখা পড়ে অনেকে অনুরোধ করেছেন কিছু লিখতে এ কারণে যে, তা না হলে বার্গম্যানরা একই কথা বার বার বলবে। পুরনোরা না হোক, নতুনদের অনেকের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। অন্তত তাদের যুক্তি যে উদ্দেশ্যমূলক এ বক্তব্যটি আসা উচিত। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নাতনি শর্মিলা বসু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে, আমি নিজেও লিখেছি। এখানে পুনরুক্তি করব না। তবে সর্বজনবিদিত যে, তিনি পাকিস্তানী জেনারেলদের নীল চোখের বালিকা। আর জেনারেলরাও তার নীল চোখের বালক। তাদের ভক্তি, ভালবাসা পরস্পরের প্রতি অটুট এবং এর ভিত্তি অর্থ তো বটেই। তার মিথ্যাচারের একটি নমুনা দিই। তিনি বাংলাদেশে ধর্ষিতার সংখ্যা উল্লেখ করেছেন মাত্র তিন হাজার। চলবে...
×