ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যা দিবস

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১১ মার্চ ২০১৭

গণহত্যা দিবস

বাংলাদেশের মাটিতে একাত্তরে প্রায় নয় মাস ধরে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল তা ছিল বিশ শতকের নৃশংসতম গণহত্যা। গত শতকে অনেক দেশেই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধের বিচার হয়নি। তদন্ত হয়নি। এখনও ক্ষতিগ্রস্তরা রয়েছেন বিচারের অপেক্ষায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এক রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ নামে হানাদাররা বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে গণহত্যার প্রক্রিয়া চালু করে, যা অব্যাহত ছিল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়ঙ্কর। পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে বাঙালীকে। গণহারে নারীদের ওপর চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। ঘরবাড়িতে আগুন দেয়াসহ অপহরণ, খুন, বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদারদের সেসব পৈশাচিক বর্বরতা যা গণহত্যার ইতিহাসে এক ভয়াবহতম ঘটনা। এই জঘন্যতম হত্যাকা-ের ইতিহাস, দলিলপত্র, ভিডিও বা ছবি দেখলে যে কেউ ধিক্কার জানাবে অপরাধীদের। বিশ্ববিবেক দাঁড়াবে মানুষ ও মানবতার পক্ষে। বাংলার মানুষ আজও সেই গণহত্যার বিচার দাবি করে আসছে। অভিধানের ইংরেজী ‘জেনোসাইড’ শব্দটি বাংলায় ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিধৃত। যার অর্থ বিশেষ কোন জনগোষ্ঠী বা ধর্ম, বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত পন্থায় পরিচালিত ব্যাপক নির্মম হত্যাকা-, আক্রমণ ও পীড়ন এবং যা সেই জনগোষ্ঠীকে আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের ‘জেনোসাইড কনভেশন’ এই সংজ্ঞা দিয়েছে। সে অনুযায়ী একাত্তরে বাংলার মাটিতে হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসর রাজাকার, শান্তি কমিটি, আলবদর ও আলশামস বাহিনীকে নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল নির্বিচারে, যা সব অর্থেই গণহত্যা। নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর প্রশিক্ষিত দখলদার হানাদার বাহিনী সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালায়। ফলে আত্মরক্ষার্থে কোটি মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের ট্র্যাজেডি ধারণ করে ২৫ মার্চ ‘কালরাত্রি’ হিসেবে বাঙালীর ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে। এদেশের জনগণ কয়েক দশক ধরেই দিনটিকে গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে। কারণ এই দিন থেকেই সূত্রপাত ঘটে প্রায় নয় মাসের বর্বরতা, নৃশংসতা, যাতে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হন, সম্ভ্রম হারান তিন লাখ মা-বোন। দেশবাসী মনে করেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া ন্যায়সঙ্গত এবং জরুরী, জাতিসংঘের কাছ থেকে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি চান দেশবাসী। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আজকের বিশ্ব সমাজ ও বিশ্ব মানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থেও গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য নির্ধারিত দিন থাকা দরকার। জাতিসংঘের বিধান অনুযায়ী প্রস্তাবটি কোন দেশের সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হতে হবে। তাই জনগণের এই যৌক্তিক দাবির আলোকে গণহত্যার নির্মম শিকার বাঙালী ও বিশ্বের সকল গণহত্যাপীড়িত দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকেই প্রস্তাবটি তুলে ধরতে হবে। বর্তমান জাতীয় সংসদের এমপিরাও এই দাবিকে সমর্থন করেছেন। ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট নেতারাও এই দাবিতে অনড়। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার জন্য ‘গণহত্যা দিবস’ নামে একটি দিবস পালনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভায় আলোচনাও করেছিলেন। বিশ্ববাসী অনেক গণহত্যার সাক্ষী। বাংলাদেশ ছাড়াও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, চিলি, বুরুডি, রুয়ান্ডা, গুয়াতেমালাসহ বিভিন্ন দেশে গণহত্যা হয়েছে। তবে গণহত্যার স্বীকৃতির বিষয়টি জটিল একটি দেশকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে; যে দেশ এই গণহত্যা চালিয়েছে, সেই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন হতে পারে ভেবে অনেক দেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলে না। তবে গণহত্যার ঘটনা কোনভাবেই চাপা পড়তে পারে না। জাতীয় সংসদে এমপিরা ‘গণহত্যা’ দিবস পালনের যে প্রস্তাব পেশ করেছেন তা গৃহীত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
×