ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বিশুদ্ধ সাদাসিধা এক কাহিনী

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৫ মার্চ ২০১৭

বিশুদ্ধ সাদাসিধা এক কাহিনী

জন্মের সময় আমি অবশ্যই সোনার চামচে মধু খাইনি। মধু খাওয়ানো হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। সোনার চামচ বলে কিছু আছে, তা আমার মা-বাবা জানত কি? চারদিকে চার-পাঁচ মাইল পর্যন্ত মাটির রাস্তা চলে যাওয়া একটা অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা করা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খেলাধুলায় মেতে থাকা এবং বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া– এই তো তখন আমার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। সাতজনের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ হওয়ায় বাবাকে চাকরি থেকে রিটায়ার্ড অবস্থায় দেখেছি। প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালে বাবার চাকরিস্থলে হেঁটে দু’-একবার গিয়েছিলাম। জমিদার এস্টেটের কাজ থেকে বাবার চাকরি শেষ হয়। তিনবেলা খাওয়াটা জুটেছে বটে, কিন্তু আর কোন প্রাচুর্যতা দেখিনি বা পাইনি। দুটো জামা ও দুটো হাফপ্যান্ট নিয়েই আমার শৈশবকাল কেটেছে দিব্যি। কোন চাহিদা ছিল না বলেই হয়ত কোন কষ্টও অনুভব করিনি কখনও। তবে কষ্টটা অনুভব করেছি যখন কিশোরগঞ্জ শহরে নবম এবং দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করতে এসেছি। হঠাৎ করে গ্রাম থেকে শহরে। বেশভূষায় গ্রাম্য ছাপ। কথাবার্তায় জড়তা, অন্যদিকে ক্লাসমেইটরা দারুণ স্মার্ট। তবে ঈর্ষা আমার কখনোই ছিল না। অবশ্য বন্ধুরাও আমাকে গ্রাম থেকে সদ্য আসা ছেলে বলে অন্য চোখে দেখত না। সবাই কেমন আপন করে নিয়েছিল। অনেক বন্ধুই তাদের বাড়ি ডেকে নিত। আমি এখনও ভুলতে পারি না আমার সেই হাইস্কুলের বন্ধুদের– মাসুদ, বাহার, মনসুর, জালাল শামসুদ্দিন, অপরেশ এবং আরো অনেকে। আহ হা সেই টিনএজার বয়সটা যদি আবার ফিরে পেতাম! পরীক্ষা বিষয়টা আমার সব সময়ই ভাল লাগত। কোন প্রশ্ন আমি না জানলেও কিছু না কিছু লিখে দিতাম, অর্থাৎ বানিয়ে বানিয়ে লিখতে পারতাম। নীরদ সি চৌধুরীর দেশ, কিশোরগঞ্জ আমাকে ভবিষ্যত জীবন গড়ার পথের সন্ধান দিয়েছে। তবে যা দেয়নি তা হলো মেয়েদের বন্ধুত্ব। প্রেম-ভালবাসার সাহসই হয়নি তখন, অথচ ইচ্ছে হতো ভীষণ। গরিবী বিষয়টা মাথায় সব সময় ঘুরঘুর করত। গ্রামের স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পাওয়ায় দু’মাস পড়ে আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় থেকে আমি কিশোরগঞ্জ হাইস্কুলে এসেছিলাম। কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল আমার জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিল। এই কিশোরগঞ্জ শহর থেকে আজকের বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তখন গুরু দয়াল কলেজের তুখোড় একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। আর পড়াশোনায়ও যে আনন্দ আছে– আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম কিশোরগঞ্জ হাইস্কুলে পড়তে এসে। স্কুলের প্রায় সব শিক্ষকই আমাকে দারুণভাবে সাহায্য করত, উৎসাহ দিত। ১৯৬৭ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলের সময় আমি ঢাকা শহরের তাঁতিবাজারে আমাদের আর এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসলাম। আমাদের কিছুটা দূর সম্পর্কীয় কাকা, তখনকার জগন্নাথ কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হরি প্রসন্ন রায়ের বাসায় আসি। ফলাফল বের হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই খবর পেয়ে গেলাম আমি ঢাকা বোর্ডের এসএসসিতে প্রথম চারজনের মধ্যে আছি। কেমন করে যেন সবকিছু আমার মনের মতো হয়ে যেতে লাগল। তাঁতিবাজারের বাসায় আমার সব আত্মীয়স্বজন বলল ‘ঢাকার নটর ডেম কলেজে তোকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হবে। এখানে থেকেই পড়বি।’ শেষ পর্যন্ত তাই হলো। সেই পাড়াগাঁয়ের ছেলেটি আমেরিকান সাহেবদের কলেজে পড়াশোনা শুরু করে দিল। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তাঁতিবাজারের সব আত্মীয়স্বজন চলে গেল কলকাতায়। তবে আমার একটা দারুণ ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল। সদরঘাটে ব্যাপ্টিস্ট মিশন হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল। সেই থেকে আমি বাংলাদেশে খ্রীস্টান সমাজের সঙ্গে মিশে গেলাম। অনেক খ্রীস্টান পরিবারের একজন আপনজন, যেন ওদের পরিবারেই সদস্য হয়ে গেলাম। মৃদুলদা, রীনা বৌদি, তপনদা তথা কাকা- কাকিমা, নীরেনদা, খোকনদা– এই কজনই নয়, আরও অনেক শুভার্থী হয়ে গেল আমার। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে থেকে কেমেস্ট্রিতে পড়তে লেগে গেলাম। তখন অনেক কটা টিউশনি করতাম। স্কলারশিপের টাকা এবং টিউশনির টাকা দিয়ে চলে যেত। বাড়িতে যাওয়ার সময় বাবা-মার জন্য নানা কিছু নিয়েও যেতাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে পাস করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের টিচার হয়ে গেলাম। হুমায়ূন ভাইও আমার পাকাপোক্ত বন্ধু হয়ে গেল। কেমন যেন সিনেমার কাহিনীর মতো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। সেই শৈশবের স্বপ্ন, আমেরিকার মতো দেশে যেতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েই একটা দারুণ কাজ করে ফেললামÑ বাংলায় জৈব রসায়ন বিএসসি ক্লাসের জন্য লিখে ফেললাম। মল্লিক ব্রাদার্স বইটি ছাপাল। রজব আলী মল্লিক আমাকে বেশ স্নেহ করত। সেই বইটির রয়ালটি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে একদিন কানাডায় যাওয়ার প্লেনের টিকেট কিনে ফেললাম। পিএইচডি করতে কানাডা যাওয়া। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক নিয়ে এলাম। ১৯৮৫ সালে হাওয়াই থাকাকালে এক সময় মনে হলো অনেকটা কাল বড়লোকি দেশে থেকেছি এবং দেশে ফেরার আগ্রহটা বেড়ে গেল। একদিন চলেও এলাম। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো চাকরিতে জয়েন করতে পারলাম না। কেরিয়ারে ছন্দপতন ঘটে গেল। তাতে বরং ভালই হয়েছিল। জাফর ভাই সাদরে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালে চাকরি দিয়ে দিল। পাঁচ বছর পর আবার ফিরে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারও পাঁচ বছর পর চলে গেলাম অস্ট্রেলিয়ায়। আবার ফিরে এলাম দেশে স্কয়ারে চাকরি নিয়ে। আরও পাঁচটি বছর পর ২০০১ সালে ঢাকা থেকে ফোন ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি চাকরি নিয়ে তিন কন্যা, স্ত্রীসহ আবার আমেরিকায় চলে এলাম। সেই থেকে আমেরিকায়। এই কাহিনীর সঙ্গে প্রেম-ভালবাসা এবং বিয়ে জাতীয় বিষয়গুলো ‘কাট এ্যান্ড পেস্ট’ করে দিলেই একটা জমজমাট সিনেমা হবে। তাই না? সে কথা আরেকদিন হবে। এবার কতগুলো অত্যন্ত বিশুদ্ধ কথা বলেই লেখাটা শেষ করি। ‘নো ইউর লিমিটস এ্যান্ড বি হ্যাপি’। আমার লোকাল পত্রিকার একটা কলাম লিখতে গিয়ে গুগলে সার্চ করলাম। অবাক হলাম একদম এই কথাটিই বলেছেন ১৯১৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ফ্র্যান্স ঔপন্যাসিক রোমেন রোল্যান্ড। ভদ্রলোক স্বামী বিবেকানন্দের বায়োগ্রাফি লিখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গান্ধীজির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল এবং ভারতীয় কালচারে দীক্ষিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমাদের কবিগুরু দু’বছর আগেই নোবেল পেয়েছিলেন। কানাডায় পিএইচডি করতে এসে প্রজেক্ট ঠিক করার সময় ‘গাছকে তাৎক্ষণিক রিএকশান করিয়ে জ্বালানি তেল’ বানানোর প্রজেক্টটিই বেছে নিলাম। ভাবলাম প্রজেক্ট শেষে একদিন রসায়নের নোবেলটা আমার কপালে জুটবেই। শেষমেষ কয়েকটা পাবলিকেশন দিয়ে আমার পিএইচডি হলো মাত্র। নোবেলের আশা ছুটে পালাল। সেইসঙ্গে গবেষণা করে বিখ্যাত হয়ে ওঠার চিন্তাটাও মাথা থেকে চলে গেল। তারপর থেকে ঠিক করলাম স্ট্রেস ফ্রি চাকরি করব। আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জান, তারপর আশা কর ‘এ’ লেটার গ্রেড পাবে কিনা? যদিও বলা হয় ‘ড্রিম বিগ’, তবে সারাজীবন আপসোস নিয়ে বেঁচে থাকারও মানে নেই। জীবনে বেঁচে থাকাটা অস্বাভাবিক এবং মৃত্যু হলো স্বাভাবিক। সুতরাং যদ্দিন বেঁচে থাকা তদ্দিনই আনন্দকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকার চেষ্টাই করা উচিত। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক [email protected]
×