ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

খন্দকার মাহ্বুবুল আলম

সংস্কৃতি চর্চার কোন বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২ মার্চ ২০১৭

সংস্কৃতি চর্চার কোন বিকল্প নেই

‘সংস্কৃতি, হচ্ছে একটি জাতির বিকাশের মূলধারা বা জাতির ভূষণ। এক্ষেত্রে বিকৃতি বা বিচ্যুতি ঘটলে অন্য জাতি গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে নিজস্ব সংস্কৃতি বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকে। ফলে সে জাতির বিকাশ ঘটে না। আমাদের দেশে আশানুরূপ সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে না। শহর-নগরে সীমিত পর্যায়ে কিছু মাত্র সংস্কৃতি চর্চা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পাড়া-গাঁয়ে সংস্কৃতি চর্চা আগের মতো নেই। তদস্থলে ভিনদেশী সংস্কৃতির ভূত আগেকার তুলনায় আরও বেশি করে চেপে বসেছে। যার ফলে তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে। হচ্ছে জঙ্গীবাদের দিকে উদ্বুদ্ধ। যা আমাদের জাতিসত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক সময় বাঙালী জাতি বর্তমানের তুলনায় আরও বেশি সাংস্কৃতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল। সেই সাংস্কৃৃতিক চেতনাকে ধারণ করেই ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে এ জাতি ’৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। যার রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই জাতি আজ সংস্কৃৃতি চর্চার দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে। যেই সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে নিহিত রয়েছে অন্ধকার থেকে মুক্তির পথ। এক সময় পাড়া গাঁয়ে দেখা যেত ক্লাব সংস্কৃতি। গান বা সঙ্গীত চর্চা, আবৃত্তি, নাটক অভিনয় ইত্যাদি শিল্পকলার অবারিত চর্চা। দেখা যেত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞানের বইপুস্তক, ভাল প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি পড়ত। আজ আর তা দেখা যাচ্ছে না। এক সময় পাড়া-গাঁয়ে পাঠাগার দেখা যেত। তাও আজ আর নেই। কোথায় যেন এসব হারিয়ে গেল। এখন আর আগের মতো পাড়া-গাঁয়ে ঐতিহাসিক ও সামাজিক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে না। হচ্ছে না কোন কবিগানের পালা। যাত্রা পালার মতো লোকজ সংস্কৃতির অনুষ্ঠান দেখার জন্য এক সময় মানুষের মধ্যে উৎসাহবোধ কাজ করত তাও আজ আর নেই। এখন কোথাও আর কিছু নেই। বরং ব্যান্ড শোর শব্দ দূষণ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে মানুষ। স্বীয় বাঙালিপনা সংস্কৃতির পরিবর্তে আমরা দিন দিন ভিনদেশী সংস্কৃতির সেবাদাসে পরিণত হয়ে উঠছি। দেখা যাচ্ছে স্বজাত সাংস্কৃতিক বিমুখতায় কল্পনাপ্রসূত অর্থহীন ও যুক্তি বোধহীন এক ধরনের সংস্কৃতি চর্চার দিকে অনেকেই অতি মাত্রাই ধাবিত হয়ে পড়ছে। এতে করে এ জাতি বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা, তারা নানা কুসংস্কারাচ্ছন্নতায় অন্ধকারের বাসিন্দা হয়ে উঠছে। যে জাতির মধ্যে শিক্ষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা থাকে না, সে জাতি বেশি দিন ধরে স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে টিকে থাকতে পারে না। এ সবের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে মানবতা, সভ্যতা ও নৈতিক মূল্যবোধ। তৎপরিবর্তে সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বৃহত্তর মানব গোষ্ঠীর মধ্যে অনৈক্য, হিংসা, বিভেদ, খুনোখুনী, হানাহানি, পারস্পরিক দূরত্ব ও ঘৃণা-বিদ্ধেষের জন্ম দেয়। যা মানব গোষ্ঠীর জন্য কখনও ভাল ফল বয়ে আনতে পারে না। চলমান বাস্তব অবস্থাই এর প্রমাণ। আগে যখন আমাদের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বেশি বেশি চর্চা ছিল, তখন মানুষের নৈতিক অধঃপতন এ রকম সময়ের মতো ঘটেনি। বিশেষত আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে এ অবক্ষয়ের শুরু। যা ধীরে ধীরে আজকের এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে এলো। মানব জাতির বিকাশের ক্ষেত্রে সুস্থ ধারার ‘সংস্কৃতি, এমন একটি মাধ্যম যা বহু মত প্রকাশ এবং পারস্পরিক সহনশীলতার বোধকে সৃষ্টি করে দেয়। বহু মত প্রকাশের অবাধ সুযোগ না থাকলে মানবিক মূল্যবোধ যেমন সৃষ্টি হয় না, তেমনি দীর্ঘ লালিত মিথ্যার জঞ্জাল থেকে উঠে আসা যায় না। পরমতসহিষ্ণুতাই আমাদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে সুস্থ ধারার সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যে কোন অপসংস্কৃতিকেও সামাজিকভাবে রুখতে হবে। এক্ষেত্রে মানবিক শিক্ষার সঙ্কটকেও কাটিয়ে উঠতে হবে। এ শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার মুক্ত করতে সহায়ক। প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় শিক্ষা-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মুক্ত মনন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে আজকের তরুণ যুব সমাজের গতি পথ পরিবর্তন করে দিতে হবে। এ জন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি শিশুদের জন্যও সে রকম অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। নতুবা মানবিক ঐক্যের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। আনন্দবাজার, চট্টগ্রাম
×