ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তা, পাল্টে দেবে ভাগ্য

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মুক্তা, পাল্টে দেবে ভাগ্য

অলঙ্কার শিল্পে মুক্তার ব্যবহার দীর্ঘকালের। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অমূল্য রতœসম্ভারের ক্ষেত্রে মুক্তার অবস্থান হীরার পরেই। অলঙ্কার ছাড়াও মুক্তার ব্যবহার হয় ওষুধ শিল্পে। ব্যবহার হয় জ্যেতিষশাস্ত্রে। মুক্তার উৎপত্তি ঝিনুক থেকে। ঝিনুকের বাস জলাশয়ে। আর আমাদের দেশে রয়েছে অন্তহীন জলাশয়। পুকুর-ডোবা, হাওড়-বাঁওড়, নদ-নদী, খাল-বিল থেকে শুরু করে জলাশয় নেই, দেশে এমন এলাকা নেই বললেই চলে। এসব জলাশয়ে পরিকল্পিত উপায়ে ঝিনুকের চাষ করা গেলে, মুক্তা হতে পারে ভাগ্য বদলে দেয়ার চাবিকাঠি। অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানে মুক্তা খুলে দিতে পারে নতুন দিগন্ত। বিশেষত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে নতুন ক্ষেত্র। আশার কথা, বর্তমান সরকার বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঝিনুক ও মুক্তা চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। চলছে গবেষণা। এরইমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে এসেছে আশাতীত সফলতা। ঝিনুক মূলত শামুক জাতীয় অমেরুদ-ী জলজপ্রাণী। বাংলাদেশের উপকূলীয় লোনা পানিতে ৩শ’ প্রজাতির এবং মিঠা পানিতে ২৭ প্রজাতির ঝিনুক রয়েছে। তবে পাঁচ ধরনের ঝিনুকে মুক্তা পাওয়া গেছে। গবেষণায় এখন পর্যন্ত কমলা, গোলাপি, সাদা, ছাই- এই চার রঙের এবং গোল, রাইস ও আঁকাবাঁকা- এই তিন আকারের মুক্তা পাওয়া গেছে। উপকূলীয় মহেশখালী দ্বীপের পিঙ্ক পার্ল বা গোলাপি মুক্তা খুবই বিখ্যাত। এছাড়া, বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকাসহ দেশের প্রায় সব জায়গাতে কমবেশি মুক্তা বহনকারী ঝিনুক পাওয়া যায়। মুক্তাচাষের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৬০ সালে জন লাটেনড্রেস নামের এক আমেরিকান প্রথম মুক্তার চাষ করেন। এর আগে স্পেনের সৈনিকরা ভেনিজুয়েলার উপত্যকায় মুক্তার প্রথম সন্ধান পায়। উনিশ শতকে জাপানে মুক্তার বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়। চীনেরও রয়েছে মুক্তা চাষের প্রাচীন ইতিহাস। বাংলাদেশে এক সময়ে বেদেরা ঝিনুক থেকে মুক্তা আহরণ করত। বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লোনা এবং মিঠা উভয় পানির ঝিনুক তথা মুক্তাচাষে সফলতা লাভ করেছে। এর মধ্যে লোনা পানির মুক্তা উৎপাদনে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও জাপান এবং মিঠাপানির মুক্তা উৎপাদনে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, জাপান, আমেরিকা ও সংযুক্ত আরব আমিরাত শীর্ষে অবস্থান করছে। ভারতও মুক্তা উৎপাদন ও রফতানিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছে। বাংলাদেশেও রয়েছে মুক্তা চাষের অপার সম্ভাবনা। এদেশে শীতকালের স্থায়িত্ব কম বরং প্রায় সারা বছর উষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। এ পরিবেশ ঝিনুকের দৈহিক বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের অনুকূল। এছাড়া, এদেশের ঝিনুক থেকে সংগ্রহ করা মুক্তার রং যথেষ্ট উজ্জ্বল। যা বিশ্ববাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রয়েছে পর্যাপ্ত জলাশয়। যেখানে একই সঙ্গে মাছ ও ঝিনুকের চাষ সম্ভব। রয়েছে শ্রমশক্তি। এত বিপুল সুযোগ-সুবিধা ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশে এর আগে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঝিনুকচাষে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১১-১২ অর্থবছরে একটি ‘কোর’ গবেষণা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় ঝিনুকে মেন্টাল টিস্যু ঢুকিয়ে অপেক্ষাকৃত কম গভীরতর পুকুরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং নিয়মিত পরিচর্যা করা হয়। এতে পাঁচ মাসেই ঝিনুকে দুই থেকে তিন মিলিমিটার আকারের মুক্তা জন্মে, যা ‘রাইস পার্ল’ নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ২০১২ সালের জুলাই মাসে ১৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘মুক্তাচাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে মুক্তা গবেষণাগার, ল্যাবরেটরি স্থাপন ও গবেষণা পুকুর সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয় এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় ভিয়েতনাম থেকে উন্নত প্রজাতির ২১০ কেজি রাজসিক ঝিনুক আমদানি করা হয়েছে। এসব ঝিনুকের প্রতিটির ওজন প্রায় এক কেজি। ভিয়েতনামে মিঠাপানিতে এ ঝিনুকের চাষ হয়। এতে বড় আকারের মুক্তা হয়। যার আন্তর্জাতিক চাহিদা অত্যন্ত বেশি। এসব ঝিনুক ময়মনসিংহের বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) দেয়া হয়েছে। সেখানে এ ঝিনুকে কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে নতুন করে আরও ঝিনুক তৈরি করা হবে এবং পরীক্ষামূলকভাবে মুক্তা চাষের উপযোগী করে তোলা হবে। এতে প্রায় বছর দুই সময় লেগে যাবে। এরপরে তা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য চাষীদের দেয়া হবে। এর পাশাপাশি ময়মনসিংহের ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ ও ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ঝিনুকের প্রদর্শনী খামার করা হয়েছে। এরইমধ্যে ৫শ’ নারী-পুরুষকে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, মুক্তাচাষ নিয়ে গবেষণাও অব্যাহত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান বাজারে ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার একটি মুক্তার দাম ৫০ মার্কিন ডলার। আর একটি ঝিনুকে মুক্তা হয় ১০ থেকে ১২টি। সে হিসেবে মাত্র একটি ঝিনুক থেকে বছরে ৫ থেকে ৬শ’ মার্কিন ডলার বা ৪০ হাজার থেকে ৪৮ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। অথচ এতে খরচ হবে মাত্র ১৫ থেকে ১৬শ’ টাকা। গবেষণায় আরও বেরিয়ে এসেছে, মুক্তা উৎপাদনের জন্য অস্ত্রোপচার করার পর ঝিনুকের বেঁচে থাকার হার ৭৬ ভাগ এবং মুক্তা তৈরির হার ৮২ ভাগ। প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পরিকল্পিত উদ্যোগে মুক্তাচাষ সম্প্রসারণ করা গেলে এ খাত থেকে বছরে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের যেমন সম্ভাবনা রয়েছে। তেমনি ২০-৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। মুক্তা ছাড়া ঝিনুক থেকেও আমাদের অর্জনের সম্ভাবনা একেবারে কম নয়। ঝিনুকের খোলস থেকে নানা ধরনের সৌখিন সামগ্রী ও অলঙ্কার তৈরি করা সম্ভব। তাই এটিও হতে পারে রফতানি পণ্য।
×