ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আদর্শ নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে! ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আদর্শ নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে! ॥ অভিমত

আমি আবেগে ভারাক্রান্ত হই না। শোকেও মূর্ছা যাই না। বল্গাহীনভাবে অতিরঞ্জিত উক্তিও ছাড়ি না। গত কয়েক বছর ধরে রাজনীতি করে আমার উপলব্ধি হলো- এগুলোতে বিশেষ কোন কাজ হয় বলে মনে হয় না। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলেছে তা শুনেছি। যদিও আমি ভাবতে পারি না, তথাপি ভাবার চেষ্টা করেছি। অনেককে প্রশ্ন করেছি, মুজিবীয় আদর্শটা কি? কিন্তু কারও কাছ থেকে সদুত্তর পাইনি। খুব ভাল পণ্ডিত থেকে শুরু করে সবাই প্রায় একইভাবে এটাকে সংজ্ঞায়ন করেছে। দুই-একটি শব্দ ছাড়া ব্যতিক্রম কিছুই পাইনি। যেহেতু কেউ এটাকে ভালভাবে জানে না বা যেহেতু মুজিবীয় আদর্শের উৎপাদন পুনঃউৎপাদন নেই তাই তারাই এর মালিকানাস্বত্ব নিয়ে রেখেছেন। এটা নিয়ে নতুনভাবে কেউ বাতায়ন খুলতে চাইলে তারা ঢাল-তলোয়ার নিয়ে এক ধরনের যুদ্ধে নামে। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ওপর মৌলবাদ বা মওদুদীবাদের ভূত চেপেছে কিনা? আমি আগেও বলেছি, আমি মনে করি মুজিবীয় আদর্শ গোড়া কোন বিষয় না। শুরুতে এর দার্শনিক বা প্রায়োগিক ভুল থাকতে পারে কিন্তু এটা পরিবর্তনশীল বিষয়। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে নির্দিষ্ট ছকে চিন্তা করে (যে এটা স্থির কোন বিষয়) তাদের মধ্যে আর মওদুদীবাদীদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? নাকি এটাকে ব্যবহার করে তারা ফায়দা লুটছে? যে মানুষটি জনগণের মুক্তির সংগ্রাম করেছে তার আদর্শের রূপায়ন তো জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। সেই গণমানুষের নেতার আদর্শটা এভাবে বাক্সবন্দী করে ফেলা হলো? তার আদর্শের প্রাণভোমরাটা খাঁচায় বন্দী হয়ে চার দেয়ালের মাঝে আছড়ে পড়ছে। এমনটা এখনই হচ্ছে তা নয়, শুরুটা দেশ স্বাধীনের পরেই। স্বাভাবিক বাঙালীর চেয়ে লম্বা, দৃঢ় কণ্ঠের বঙ্গবন্ধুকে কতিপয় বামন গোত্রের মানুষ চারদিক থেকে বলয় তৈরি করে ঘিরে রেখেছিল তাদের ফায়দা হাসিল করার জন্য। কীভাবে একটা জনগণের নেতাকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলো। এরাই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্লট তৈরি করেছে। যেটা খুনীদের মানসিক শক্তি উৎপাদনে কাজ করেছে। সারা দেশের মানুষের নেতা হয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের নেতা। বঙ্গবন্ধু তো দেশের মানুষকে ভালবাসতেন কিন্তু এই চৌহদ্দি তিনি ডিঙ্গাতে পারেননি। আর এই সুযোগে তাদের বড় কাজটি সেরে ফেলল হায়নার দল। এর মধ্যে যেটা আশ্চর্যের বিষয়, দেশের সাধারণ মানুষই বঙ্গবন্ধুর ভালবাসার প্রতিদান দিতে চেয়েছিল। পেরেছিল জনগণ, পারে নি তৎকালীন আওয়ামী লীগ। যারা বলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সারা দেশে কোন প্রতিবাদ হয় নি, তারা ইতিহাস পড়ে দেখে নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে নিহত হয়েছেন আরও ১৪০ জন। কিন্তু পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের উচিত ছিল এটাকে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার, সেটাই করা হয়ে ওঠে নি। আজ অনেকে বলে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার মসলা তখনই তো ছিল। কিন্তু পারা যায় নি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয় না। যেটা তখন সম্ভব হয় নি, সেটা এখন সম্ভব করার উপায়গুলো তো জানতে হবে। শুধু এই উচ্চ বচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তখনকার চাইতে নতুন কিছু ঘটবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুক্তি সংগ্রামকারী যে কোন নেতার মতো বা চাইতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ছিল সংগ্রামপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু ২৪ বছর পাকিস্তানের শোষণনীতির বিরোধী সংগ্রাম করেছেন। এটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হলো- জনগণের সঙ্গে থেকে সংগ্রাম, আরেকটা হলো- কারা অন্তরীণে কষ্ট ভোগ। এর কোনটাই একটা অপরটার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মহিমান্বিত করে দেখার ক্ষেত্রে পূর্বের ধরনটা আমার কাছে পরেরটা থেকে বেশি অগ্রাধিকার পায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের পরের সংগ্রাম আর তার আগের ২৩ বছরের যে সংগ্রামপূর্ণ জীবন, এর মধ্যে দেখা যায় আমাদের কিছু লোক বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামকে ১৯৭১ সালে ৯ মাসের সংগ্রামে বন্দী করে ফেলেন। যেটা তার ওই ২৪ বছরের কম সংগ্রামপূর্ণ। তারা মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুকে এক করে দেখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পথে হেঁটে চলা জনগণের মুজিবকে এড়িয়ে যায়। যে মুজিব এদেশের হাটে-মাঠে, পথ-প্রান্তরে মুক্তির বার্তা নিয়ে হেঁটে চলেছেন, সাধারণ জনগণের বুকে দম দিয়েছেন সেই মুজিবের ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলো- হয় তারা বঙ্গবন্ধুকে জনগণ থেকে আলাদা করে রাখতে চায় আর না হলে তারা ওই ইতিহাস জানে না। শেখ মুজিবের ওই ইতিহাস গণ-মানুষের ইতিহাস, তাকে গণ-মানুষের নেতা হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করতেই হবে। আমি সবকিছু না বুঝলেও এতটুকু বুঝি, কাউকে চাপিয়ে বা লোভ দেখিয়ে মুজিবীয় আদর্শের বিস্তার লাভ হবে না। যা দেখা যাচ্ছে, এটা আপেক্ষিক। যদি মুজিবীয় আদর্শের বিস্তার ঘটাতে হয় তাহলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। গণ-মানুষের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের হৃদয় ছিল ভালবাসতে জানত, বুক ভরা ছিল সাহস, গণ-মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে জানত। এটা আমি বলিনি, বলেছেন শিক্ষাবিদ আহমদ ছফা। আর আমি বলব ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালী হারিয়েছে তার সেই সাহস আর ভালবাসা। আজ আমি সাহস আর ভালবাসাহীন একজন মানুষ। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হাতড়ে বেড়াই। লেখক : ছাত্রনেতা
×