ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি

কাওসার রহমান ॥ সেচযন্ত্র স্থাপনে অনুমোদন ও লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে এমন নীতিমালাই করতে যাচ্ছে সরকার। ‘সমন্বিত ক্ষুদ্রসেচ নীতিমালা ২০১৭’ নামের এ নীতির খসড়াটি অতি সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অনুমোদন করেছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দিন দিন ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস কমে আসছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সেচ কাজে কৃষকদের পানি ব্যবহার করতে হবে হিসাব করে। এ কারণেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের অবনমন ঠেকাতে এমন নির্দেশনা যুক্ত করে নতুন একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। খসড়া নীতিমালার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নে সেচের গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সেচ অন্যতম উপকরণ। কৃষকরা বিভিন্ন সেচ কার্যক্রমের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও ভূপরিস্থ পানি যথাযথভাবে ও পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার না করায় পানি ব্যবহারে দক্ষতা কমতে থাকে। সেচের পানি সুষ্ঠু ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনে নিবিড়তা ও ফলন বৃদ্ধির জন্য সুপরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটি যুগোপযোগী সমন্বিত ক্ষুদ্রসেচ নীতিমালা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। সেচযন্ত্র স্থাপনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের বিষয়ে নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘সেচযন্ত্রের স্থান ও দূরত্ব নির্ধারণ করে সেচযন্ত্র স্থাপনের অনুমোদন, সেচযন্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, জেলা ও উপজেলায় সেচ সংক্রান্ত বিষয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ক্ষুদ্রসেচ প্রকল্পের অনুমোদনের ব্যবস্থা করা।’ সেচ কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য উপজেলা ও জেলা সেচ কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। নীতিমালার ৪ নম্বর নীতিতে পানি ব্যবহারের বিষয়ে বলা হয়েছে, অঞ্চলভিত্তিক পানির প্রাপ্যতা, পানির ব্যবহারের প্রকৃতি ও সম্ভাব্যতা বিবেচনায় হাওড়, পাহাড়ী এলাকা, বরেন্দ্র এলাকা, চরাঞ্চল, উপকূলীয় অঞ্চলে সেচের পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা, বৃষ্টির পানি ব্যবস্থাপনা, গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ, সমবায়ভিত্তিক পুকুর, নাল, খাল পুনঃখনন, সম্পূরক সেচ ও পানির অর্থনৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ নীতিমালা প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বিদ্যমান পানি সম্পদের পরিমিত ব্যবহার নিশ্চিত করা, সেচ কাজে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভূ-উপরিস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদের উন্নয়ন করা, পানি সম্পদের এফিশিয়েন্ট ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে এই নীতিমালা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক আলাদা সেচ ব্যবস্থাকে একটু সিস্টেমে আনার জন্য দু’টি কমিটিও করা হয়েছে।’ উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ১৬ জন এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও বিএডিসি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মিলে ১৬ জনের কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা সুপারভিশন করবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। দিনে দিনে নিচে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এর ফলে বাড়ছে আর্সেনিকের প্রকোপ। তাই পানি ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পাঁচ দশক আগেও বাংলাদেশে পানির প্রধান উৎস ছিল খাল, বিল, নদী ও পুকুর। সময়ের আবর্তে শুকিয়ে গেছে অনেক নদ-নদী। ভরাট হয়ে গেছে জলাশয়গুলো। এর ফলে চাপ পড়েছে ভূগর্ভের পানির ওপর। বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পানির স্তর বছরে দুই থেকে ৩ মিটার নিচে নামছে। ওয়াটার এইড বাংলাদেশের গবেষণায় ৩ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ সুপেয় পানির উৎস থেকে বঞ্চিত বলে জানানো হয়েছে। তাই ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পানি ব্যবহারে এখনই সতর্ক না হলে ভবিষ্যত প্রজন্মকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশের উজানে পদ্মা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীতে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে ভূ-গর্ভস্থ পানির চাহিদা বেড়েছে। গত চার দশকে দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে প্রায় শতভাগ। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের জন্য চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই মেটাতে হচ্ছে ভূ-গর্ভ থেকে। আর অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ দ্বারা এই পানি উত্তোলনের ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নামছে। ভূ-গর্ভের পানির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে আগামী পাঁচ বছর পর আরও আশঙ্কাজনক হারে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। আর্সেনিকের পরিমাণও বাড়বে। তখন নানা ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা করা হয়েছে ওই গবেষণায়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এক গবেষণায় দেখা যায়, ষাটের দশকে ৫০ ফুট নিচ থেকে গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উঠানো যেত। কিন্তু এখন ১৫০ ফুট নিচ থেকে পানি তুলতে হয়। গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে, সাধারণত মাটির নিচ থেকে যে পানি উঠানো হয় সেটি নদী, খালবিল ও মাটি থেকে তৈরি হওয়া। পানি উঠালে প্রাকৃতিকভাবেই আবার পানি চলে আসত। কিন্তু এখন আর ভূ-গর্ভে সেই পানি যায় না। এর কারণ সেচব্যবস্থা। বোরো মৌসুমে প্রতিবছর যে হারে পানি সেচের জন্য ভূ-গর্ভ থেকে তোলা হয়, সে পরিমাণ পানি মাটির নিচে যায় না। ফলে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যায়। এ কারণে অগভীর তো দূরের কথা, গভীর নলকূপ দিয়েও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যায় না। জানা যায়, তিস্তা অববাহিকা, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে একসময় তিস্তা থেকে পানি নিয়ে চাষাবাদ হতো। আশির দশকে তিস্তা ব্যারেজ করে নদী থেকে শ্যালো মেশিন দিয়ে বা নালা তৈরি করে ক্ষেত-খামারে সেচ দেওয়া হতো। কিন্তু, বেশ কয়েক বছর ধরে তিস্তা এখন পানিশূন্য, মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। গভীর-অগভীর নলকূপে শ্যালো মেশিন দিয়ে কয়েক বছর ধরে বিকল্প ব্যবস্থায় সেচ কার্যক্রম চালাচ্ছে কৃষক। কিন্তু ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। ১০ বছর আগে যেখানে ৬০-৭০ ফুট গভীরে পানি পাওয়া যেত, সেখানে পানি পেতে হলে এখন ১০০ থেকে ১২০ ফুট গভীরে যেতে হচ্ছে। শুধু তিস্তা অববাহিকা নয়, বাংলাদেশের উজানে ভারত গঙ্গায় বাঁধ দেয়ার কারণে বহু আগেই পদ্মা নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলো এখন ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এস আই খানের মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ নলকূপ রয়েছে। এই নলকূপ থেকে সেচের জন্য, খাওয়ার জন্য ও শিল্পের জন্য পানি তোলা হয়ে থাকে। ফলে আমাদের পাতাল পানি বা গ্রাউন্ড ওয়াটারের লেভেল প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশে বৃষ্টির পরিমাণ দুই মিটার। তা থেকে ১ মিটার পানি রিচার্জ হয়। এ ছাড়া বর্ষার সময় নদীর কূল ছাপিয়ে পানি যখন ক্ষেত-খামার ও জলাভূমিতে ঢুকে যায়, সেখান থেকে বাকি চার মিটার পানি রিচার্জ হতো। কিন্তু বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেয়ার কারণে আমাদের পাতাল পানি রিচার্জ হচ্ছে না। ফলে গ্রাউন্ড পানির লেভেল প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে।
×