ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

মোটা দাগে দেখলে বলতেই হবে গত সপ্তাহে ঢাকায় এক অস্বাভাবিক যানজটের ধকল পেরুলো, নিকট অতীতে এমনটি আর ঘটেনি। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সপ্তাহ ফুরোবার এই বিশেষ দিনটিতে ঢাকায় অতিরিক্ত চাঞ্চল্য দেখা যায়, রাস্তাভরা যানবাহন থাকে। ঢাকার ভেতরে যেমন গাড়িচলাচল বেশি হয়, তেমনি অন্য দিনের তুলনায় বেশি গাড়ি ঢাকা থেকে বেরিয়েও যায়। তার ওপর যদি অনির্ধারিত কিছু সামনে চলে আসে তবে যানজটও অভিনব জট পাকিয়ে ফেলে। ফলে বলতে পারি স্থিরচিত্রের মতো ঢাকা প্রায় স্থবির হয়ে যায়। বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ নাগরিকদের চলাচলেল জন্য সেদিন ওই বিশেষ যানজটটি হয়েছিল। এক কবিবন্ধু উত্তরা থেকে সন্ধ্যায় রওয়ানা দিয়ে রাত দশটায় অতিক্রম করেন মহাখালী ফ্লাইওভার। ফলে তার আর কবিতা পড়া হয়নি উৎসবে। কবিতা না পড়লে আর তেমন কী ক্ষতি, কিন্তু অসুস্থ যে মানুষটি হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়েছিলেন, তার অবস্থা একবার কল্পনা করুন। ঢাকা এক উদ্ভট আজব শহরে পরিণত হতে চলেছে। আর গত সপ্তাহের ঢাকার পরিবেশের কথা বলতে গেলে উপেক্ষা করতে পারি না বসন্ত আসার আগেই আকস্মিক গ্রীষ্মের মাথা তোলার কথা। মাঘের শেষটায় শীতের শেষ কামড় খাওয়ার বদলে রাজধানীবাসী যদি গরমের ছোবল খান তাহলে সেটাকে অস্বাভাবিকই বলতে হবে। সেইসঙ্গে এটাও বিস্ময়ের যে ঢাকার এক জায়গায় মাত্রাছাড়া গরম অনুভূত হলেও পনেরো কুড়ি কিলোমিটার দূরের আরেকটি জায়গায় ঠাণ্ডা অনুভূত হয়। একই সময়ে পৃথিবীর এক প্রান্তে তুষারপাত হলে অন্যপ্রান্তে সূর্যের তীব্র দহন থাকতে পারে। কালে কালে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে এই মহানগরীর দুই অংশে দু’রকম তাপমাত্রা বিরাজ করলে হয়তো একদিন আর অবাক হবে না লোকে। কথার কথা নয় বাঙালীর বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের ভেতর একটি হলো কথা বেশি বলা। এটাকে নেতিবাচক অর্থে না নিয়ে বরং ইতিবাচকভাবে দেখা যাক। অপরিচিত লোককে কথায় কথায় আপন করে নিতে বাঙালীর দেরি হয় না। নিকটজনের সঙ্গে তো বটেই, অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গেও সে কথার ঝুড়ি খুলে বসে। উভয়পক্ষ যখন বাঙালী তখন কথায় কথায় বেলা বেড়ে যায়। কথার উত্তরে একটু বেশি কথা বলাই বাঙালীর পছন্দ। যিনি তা না করেন, তাকে অহংকারী, দেমাগী ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়। বাঙালীর স্বভাব তার স্বজাতি জানেন বলেই কে আর বদনামের ভাগীদার হতে চান। তাই নিতান্ত কথা খুঁজে না পেলে বাঙালী একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এতে বক্তব্য জোরালো হয় বলেও অনেকে মনে করেন। কথায় সময় খরচ হয়, এটা ভেবে কষ্ট পাওয়ার মতো কৃপণ খুব বেশি কি আছে আমাদের সমাজে? নির্দিষ্ট সময়ে বাঙালীর মিটিং শেষ হয় না। কারণ তার কথা ফুরোতে চায় না। কথার পিঠে নানা কথা এসে জাল বুনতে শুরু করে। এই জাল বোনাকে কোনো রসিক মাকড়সার জটিল জাল বোনার সঙ্গে তুলনা করতেই পারেন। যা হোক, কথা যে শুধু সময়ের খরচ তাতো নয়। যদি টেলিফোনে সে কথোপকথন হয় তাহলে অর্থব্যয়ও সেইসঙ্গে যুক্ত হয়। এখনও দুই দশক পেরোয়নি বাঙালী সেলুলার বা মোবাইল ফোনে কথা বলছে। বলতে চাইছি মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ অবারিত হয়েছে দেড় দশকের কিছু বেশি হবে সময়টা। তবু এরই মধ্যে মোবাইলে সেই আগের অভ্যাসবশত টিঅ্যান্ডটি ফোনের মতোই বাঙালী খোশগল্প মাততে পছন্দ করে ফেলেছে। দেশে এখন মোবাইল ফোন গ্রাহক সংখ্যা ১২ কোটি ৪৭ লাখ। কিন্তু এর কত ভাগ মোবাইল ম্যানার সম্পর্কে ধারণা রাখেন, সেটা জানা মুশকিল। জনসাধারণ যেখানে বেশি সংখ্যায় অবস্থান করেন সেখানে, সে বাসের ভেতর হোক কিংবা হোক কোন সেবাদানকারী সংস্থার কার্যালয়ের অপেক্ষমাণ কক্ষ, উচ্চৈঃস্বরে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পছন্দ করেন এমন লোকের সংখ্যা খুব কি নিতান্ত কম? রাস্তা পার হওয়ার সময়, গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলা যে কী বিপজ্জনকÑ সেটাও অনেকে বুঝতে চান না। এতে তিনি যেমন নিজের জীবন বিপন্ন করছেন, তেমনি ঝুঁকির ভেতর ফেলে দিচ্ছেন আশপাশের মানুষকেও। মোবাইল সেট এত শস্তা ও সুলভ হয়ে গেছে যে সত্যিকারের ভিক্ষুকও (পেশাদার ভিক্ষুক নয়) একখানা মোবাইল সেট কিনে ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু ব্যবহারবিধি জেনে তা প্রয়োগই আসল কথা। সময় এসেছে মোবাইল ফোনসেট ও অপারেটরদের মোবাইল ফোনের ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশিকা নিয়মিতভাবে তাদের গ্রাহকদের মনে করিয়ে দেয়া। ‘ধূমপান না করার জন্য ধন্যবাদ’Ñ কথাটি যেমন লেখা থাকে বহু স্থানে, তেমনি এখন থেকেই লেখা দরকারÑ ‘ ফোনে সংক্ষেপে নিচু স্বরে কথা বলুন; গতিশীল অবস্থায় কথা বলা থেকে বিরত থাকুন’। পথ চলার নিয়ম দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আইন না মানার সংস্কৃতি সমাজে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত। একান্ত বাধ্য না হলে মানুষ নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণে উৎসাহী হয় না। এক ধরনের অলসতা, অনীহা এবং উপেক্ষার মানসিকতা কাজ করে জনসাধারণের ভেতরে সাধারণভাবে। ‘আচ্ছা মানব’, ‘মানছি’, ‘যাক না দেখি কী হয়’Ñ এ ধরনের ভাবনাও কাজ করে থাকে অনেক সময়। কিন্তু যখনই আইন অমান্যের জন্য জরিমানা গুনতে হয়, তখনই মানুষ আমলে নেয় বিষয়টা। ট্রাফিক আইনের বিষয়টিই লক্ষ্য করা যাক। ফুটওভারব্রিজের ওপর দিয়ে পথচারী পারাপারের জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হলো ঢাকায়। কয়েকটি স্থানে আইন ভঙ্গের জন্য দোষী ব্যক্তিদের জরিমানাও করা হলো। তারপর যে কে সেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত উঠে যাওয়ার পরপরই আবার জনস্রোত চলমান গাড়িবহরকে ইশারায় থামিয়ে কিংবা তোয়াক্কা না করে রাস্তা পারাপার হতে আরম্ভ করে দিল। খুব কম লোকই রাজধানীতে এখন পদচারী সেতু ব্যবহার করেন। তবে খাবারে ভেজালসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু অপরাধের তাৎক্ষণিক বিচারের বেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের প্রশংসা পেয়েছে, এটা বলতেই হবে। আমাদের মতে ট্রাফিক আইন মানতে গাড়িচালক ও জনমানুষকে বাধ্য করতে ঢাকায় প্রতিদিনই মহানগরীর কোথাও না কোথাও অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ধরা যাক বাংলামোটর মোড়ে শনিবার অভিযান পরিচালিত হলে সেই একই স্থানে কয়েক দিনের মধ্যে ঝটিকা অভিযানে নামতে হবে। এতে সুফল মিলবে বলে বিশ্বাস। তবে সাবধান, সর্ষের ভেতর যেন ভূত না ঢুকে যায়। তাহলে ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের উৎকোচের বিনিময়ে ছাড় দেয়া হচ্ছে কিনা সেটা তদারকির জন্য সাদা পোশাকে মনিটরিং টিমের প্রয়োজন পড়বে। ভাষার মাসে প্রাসঙ্গিক ভাষার মাসে কিছু কথা না বললেই নয়। একবারে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- এটা বড় বেশি আশাবাদীর লক্ষ্মণ। একবারে কিছুই হয় না, তাই বার বার বলা দরকার। পথে পথে বাংলা ভাষার প্রতি উপেক্ষা, অপ্রেম বুঝতে অসুবিধে হয় না। দোকান বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নাম এখনও ইংরেজীতেই রাখা হচ্ছে। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালানোর সুবিধার্থে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইংরেজীতে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন অনেক ব্যবসায়ী। বলাবাহুল্য এটি সুযুক্তি হতে পারে না। ইংরেজী ভাষা যেসব দেশের প্রধান ভাষা সেসব দেশের কথা আলাদা, তারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশের যেসব বেসরকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবসা করছে সেসব নাম কি ইংরেজীতে রাখা হয়েছে? পণ্যের নামকরণের (ব্র্যান্ডিং) ক্ষেত্রেও ওইসব দেশের নাগরিকরা স্ব স্ব ভাষার ওপরই ভরসা রাখেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নয়, কেবল দেশের ভেতর ব্যবসা-বাণিজ্য করছে যেসব প্রতিষ্ঠান সেগুলোর নাম ইংরেজীতে রাখারই বা যুক্তি কী? এখন আবার হিন্দী ভাষায়ও দোকানপাটের নাম রাখার চল শুরু“ হয়েছে। এটাও মাতৃভাষার প্রতি অবমাননা প্রদর্শনেরই নামান্তর। বাংলা ভাষার মিত্র না বাড়লেও বাড়ছে এ জাতীয় শত্রুর সংখ্যা। বাংলাপ্রেম ভাল, কিন্তু সেই প্রেমে খাদ মিশে যায় তখনই যখন ভাষাটি অশুদ্ধ উচ্চারণে, ভুল বানানে উপস্থাপিত হয়। বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নামফলক (সাইনবোর্ড) একেবারে কম নয়। একটু লক্ষ্য করলেই ভুল বানানের ছড়াছড়ি চোখে পড়বে। এসব অসঙ্গতি নিয়ে সেই কবে থেকেই লেখালেখি চলছে। ব্যঙ্গবিদ্রƒপ কৌতুক চলছে। ভাষার মাস এসব অনিয়ম ও অসঙ্গতির দিকে আমাদের নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাতৃভাষাও শেখা ও চর্চার ব্যাপার। তার শুদ্ধতা রক্ষা করা যে জরুরী, এ জন্মদাত্রীর সম্মান রক্ষার সঙ্গে তুলনীয়- এই বোধটুকু জাগানোর জন্য লেখক- সাংবাদিক এবং শিক্ষকদের বারবার উদ্যোগী হতে হবে। বাঙালী মায়ের সন্তান হলেই যে বাংলা ভাষার ব্যাপারে আমি দক্ষতা অর্জন করে নিয়েছি, এমনটা ভাবলে বড় ভুল হবে। অভিধান বা ডিকশনারির কয়েকটা পাতা উল্টালেই বোঝা যায় আমাদের বাংলা শব্দের সঙ্গে পরিচয়ের গভীরতা কতখানি। এই লেখা যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের বহুজনের ঘরে হয়ত বাংলা অভিধান নেই। তাঁদের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাই, হাতের কাছে একটি বাংলা অভিধান রাখুন। আপনার অতিব্যস্ত সময় থেকে আলাদাভাবে সময় বের করার কথা বলছি না। কাজের ফাঁকেই মাঝেমধ্যে সেটি হাতে তুলে নিন। পাতা উল্টে শব্দগুলো দেখুন। তার অর্থ খেয়াল করুন। বানানটাও দেখে নিন। আমার বিশ্বাস এভাবে কিছুদিন চললে এটা অভ্যাসে পরিণত হবেই। বাংলা ভাষার জন্য ভালবাসা এভাবেও গভীর রূপ নিতে পারে। বইমেলা নিয়ে দু’চার কথা প্রথম দিন থেকে পরপর কয়েকটা দিন বইমেলা ঘুরে মনে হয়েছে এবারের মেলাটি বেশ ছিমছাম, ভেতরে হাঁটাচলার পরিসর প্রচুর। উদ্যানের গাছের ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় সব প্যাভিলিয়নের উপস্থিতি বা সহাবস্থান মোটামুটি শোভন। প্রথম শুক্র ও শনিবার আশানুরূপ লোকসমাগম হয়নি মেলায়, বইয়ের বিক্রিও অনেকটা কম। তবু প্রকাশকেরা আশায় আছেন কয়েক দিনের মধ্যে মেলায় ভিড় বাড়বে, আর ভিড় বাড়লে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়বে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলাটির প্রশংসা অবশ্যই করতে হবে, যদিও পুরনো বিড়ম্বনা ধুলোর দাপট রয়েই গেছে। তাছাড়া লম্বা পথ হেঁটে এসে বয়স্করা যে একটু বসে জিরিয়ে নেবেন এমন কোন ব্যবস্থা দেখলাম না। খাবারের দোকানও একটি দুই প্রান্তে অন্তত চা-কফি আর দুয়েকটি হালকা খাবারের আইটেম মিলবে এমন স্টল থাকতেই পারতো। আগের মতো গেট পেরিয়ে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বইমেলায় ঢুকতে হচ্ছে না। প্রাচীরসংলগ্ন প্রবেশপথ পেরুলেই সোজা বইমেলার নাগাল পাওয়া যাচ্ছে। শব্দদূষণ এখনও তেমন অসহনীয় নয়। মানুষ নিরাপদে আর স্বাচ্ছন্দেই ঘুরে বেড়াতে পারছেন। প্রতিবন্ধী মেলাপ্রেমীদের জন্য কিছু হুইল চেয়ার অপেক্ষমাণ দেখতে পেলাম টিএসসি প্রান্তে। পাঠকদের অনুরোধ জানাই বইমেলায় যান, বই কিনুন। এভাবেই ভাষা শহীদদের প্রতি আপনার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানান। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ [email protected]
×