ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সালিশীর আইনী প্রক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সালিশীর আইনী প্রক্রিয়া

যে কোন সমাজের অপরাধপ্রবণতার সঙ্গে মামলা মোকদ্দমার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। মানুষ যখন তার অধিকার ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত কিংবা কারও দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয় তখন সে বিচারপ্রার্থী হয়। এক সময় প্রচলিত নিয়মকানুন, চলে আসা সামাজিক প্রথা কিংবা ন্যায়-অন্যায়বোধ থেকে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হতো। কালক্রমে এই বিচারিক ব্যবস্থা সময়ের দাবি এবং আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় আইনী কাঠামোতে রূপ নেয়। আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিম-ল একটি চলমান প্রক্রিয়া। দেশের এসব সূচকে যখন সমৃদ্ধির জোয়ার আসে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে অপরাধের মাত্রাও। বর্তমানে বিভিন্ন অপরাধের বিচার প্রার্থনায় সাধারণ মানুষ সংবিধান অনুমোদিত প্রাতিষ্ঠানিক আইনী ব্যবস্থার সাহায্য প্রার্থনা করে। ফলে স্থানীয়ভাবে চলে আসা সালিশী ব্যবস্থা তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হারায়। ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে। আইনানুগ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কারণে বিচার ব্যবস্থা সেভাবে গতিশীল না হওয়ায় মামলা-মোকদ্দমা সহজে নিষ্পত্তি হয় না। স্তূপের পর স্তূপ মামলার জট বাড়তে থাকে। বিচার ব্যবস্থার এই দীর্ঘসূত্রতাকে কমাতে ‘সালিশী আদালতের অপরিহার্যতার ওপর বিশিষ্টজনেরা গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে বিভিন্ন বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রচলিত সালিশী ব্যবস্থাকে নতুন করে আইনানুগ করা অত্যন্ত জরুরী। এই ব্যবস্থার আইনী স্বীকৃতি সাধারণ মানুষকে সহজভাবে বিচার প্রক্রিয়ার কাছাকাছি নিয়ে আসবে। আর সময়ের দাবিতে এটা অত্যন্ত জরুরীও। কারণ এই সালিশী ব্যবস্থা আইনানুগ না হওয়ায় মানুষ ন্যায্য বিচার থেকে শুধু বঞ্চিতই হয় না প্রক্রিয়াটিও সেভাবে শক্তিশালী হতে পারে না। তাই প্রাতিষ্ঠানিক আইনী কাঠামোর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে এ সালিশী আদালতেরও সুষ্ঠু প্রয়োগ অনিবার্য। দেশে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে মামলার সংখ্যা প্রায় ৩২ লাখ। জেলা আদালতগুলোতে যেখানে ফৌজদারি মামলার ৪২ ভাগ নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে মাত্র ১ বছর কিংবা তারও কম। সেখানে বাকি ৫৮ শতাংশ মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লেগে যায় ৪ বছরেরও বেশি। আর এভাবে চলতে থাকলে মামলার জটের স্তূপ ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে। বিচার ব্যবস্থার বিলম্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে সন্ত্রাস, নাশকতা, নির্যাতন কিংবা জঙ্গীবাদের মতো সহিংস ঘটনা। দেশের প্রতিটি আদালত আজ অসংখ্য মামলায় ভারাক্রান্ত। ভোগান্তি এবং দীর্ঘসূত্রতার বিপাকে পড়া সাধারণ জনগোষ্ঠী ও এই প্রাতিষ্ঠানিক আইনী কাঠামোর প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। এই অব্যবস্থা থেকে জনগণকে বের করে আনতে হলে স্থানীয় পর্যায়ের সালিশী ব্যবস্থা জোরদার করা ছাড়া বিকল্প কোন প্রক্রিয়া নেই। আর এই সালিশী আদালতকে আইনী প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। এই সালিশী ব্যবস্থাকে আইনানুগ করে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে পাঁচটি সুপারিশ এসেছে বিশিষ্টজনদের কাছ থেকে। ক. টেকসই সামাজিক সালিশ ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেয়া। খ. এই ব্যবস্থার পৃথক আইনী প্রক্রিয়া সংযুক্ত করা। গ. এই ব্যবস্থার প্রতি গণসচেতনতা বাড়ানো। ঘ. আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান সর্বোপরি এই কার্যক্রমকে গ্রাম্য আদালত থেকে দেশব্যাপী বিস্তার করে সালিশী ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত করা। সরকারের সহৃদয় বিবেচনায় এসব সুপারিশ পেশ করা হয় যাতে অতি দ্রুত এই আইনী কাঠামোর কার্যক্রমকে সাধারণ মানুষের কল্যাণে পরিচালিত করা যায়। রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন আদালতে হরেক রকম অসামাজিক কার্যকলাপের কারণে দায়ের করা মামলাগুলো সময়মতো নিষ্পত্তি করা না গেলে এর পুরো নেতিবাচক প্রক্রিয়া বর্তাবে সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ওপর। তাহলে এই অরাজক পরিস্থিতি সামলানো সত্যিই দুঃসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। সুতরাং দেশ এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে প্রচলিত সালিশী ব্যবস্থাকে আইনী প্রক্রিয়ায় ঢেলে সাজানো অত্যাবশ্যক। সরকার যাতে এ ব্যবস্থার প্রতি সচেতন হয়, সক্রিয় উদ্যোগ যেন গ্রহণ করে সর্বোপরি আইনী ব্যবস্থাকে আরও জনবান্ধব করতে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে আসে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত অবয়বে সালিশী আদালতকে আইনী প্রক্রিয়ায় আনা হোক, এই দাবি আজ সকলের।
×