ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

দেশ-বিদেশের গল্পবলা আলোকচিত্রে বৈভবময় ছবিমেলা

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দেশ-বিদেশের গল্পবলা আলোকচিত্রে বৈভবময় ছবিমেলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঘরের মেঝেতে বসে ভাত খাচ্ছেন এস এম সুলতান। শিল্পীর আহার গ্রহণের সময়ে মাছের কাটা খাওয়ার লোভে চারপাশে জড়ো হয়েছে চারটি বিড়াল। আপনজনের মতো প্রাণীগুলো সখ্য গড়েছে বিচিত্র স্বভাবের এই মানুষটির সঙ্গে। এভাবেই নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় সাদা-কালো মাধ্যমে ধরা দিয়েছেন পথিকৃৎ এই চিত্রশিল্পী। এ ছবিটি এখন শোভা পাচ্ছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার ৪ নম্বর গ্যালারিতে। চোখটি একটু ঘোরাতেই আলো-ছায়ার খেলায় সামনে হাজির হন বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান। তন্ময় হয় শুনছেন কিংবদন্তি সেতারবাদক প-িত রবিশঙ্করের সেতার বাদন। এভাবে পুরো গ্যালারিতে এই আলোকচিত্রীর ফ্রেমে ফ্রেমে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজমুদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, গোলাম মুস্তাফা, কবি আবুল হোসেন, নির্মলেন্দু গুণসহ এ দেশের শিল্প-সাহিত্য ও রাজনৈতিক অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা। তাঁদের সঙ্গে আছেন মানবতার পথিক মাদার তেরেসাও। সময়ের সাক্ষ্য দেয়া ছবিগুলোয় প্রত্যেকেই উজ্জ্বল আপন অভিব্যক্তির আলোকছটায়। দেশ-বিদেশের গল্পবলা এমন নানা আলোকচিত্রে বৈভবময় হয়ে উঠেছে ছবি মেলার নবম আসরটি। চিত্রশালার পাঁচটি গ্যালারিজুড়ে বিচিত্র বিষয়ের ছবির সমাহারে সেজেছে আন্তর্জাতিক এই আলোকচিত্র উৎসব। এশিয়ার অনুসরণীয় আন্তর্জাতিক এ আলোকচিত্র আসরে অংশ নিয়েছেন ১৬টি দেশের ২৭ জন আলোকচিত্রী। বহুমাত্রিক গল্পের সঙ্গে বিশ্বের আলোচিত নানা বিষয়কে স্পর্শ করা এসব শিল্পীর ফ্রেমবন্দী ছবি নিয়ে সাজানো হয়েছে ৩১টি প্রদর্শনী। অবস্থান্তর প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক এ মেলার আয়োজক দৃক পিকচার লাইব্রেরি লিমিটেড ও পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট। শিল্পকলা একাডেমির এই প্রদর্শনীর বাইরেও মেলার অংশ হিসেবে পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও লালকুঠিতে ছবিপ্রেমীরা দেখার সুযোগ পাবেন এই প্রদর্শনী। এর বাইরে রয়েছে মেলার ট্রেডমার্ক ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী। রিকশাভ্যানে চড়ে মেলার নির্বাচিত আলোকচিত্রগুলো ঘুরে বেড়াবে শহরের নানা প্রান্তে। মেলার অংশ হিসেবে আজ শনিবার সন্ধ্যায় আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত হবে মুনেম ওয়াসিফ ও সরকার প্রতীকের প্রস্তুতকৃত স্লাইড শো ‘বেঙ্গল ডিভাইডেড’। শুক্রবার দুপুরে শোভাযাত্রার মাধ্যমে শুরু হয় মেলার নবম আসরের কার্যক্রম। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শেষ হয় বর্ণিল এই শোভাযাত্রা। এরপর বিকেলে একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে ছবি মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এ আয়োজনে আলোকচিত্রের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয় দেশবরেণ্য দুই আলোকচিত্রীকে। তাঁরা হলেন সাঈদা খানম ও পোর্ট্রেটের কবি হিসেবে পরিচিত নাসির আলী মামুন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসব পরিচালক ড. শহিদুল আলম। সভাপতিত্ব করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। বিশেষ অতিথি ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্লিমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিজ ওয়েলস এবং ইরানের আলোকচিত্রী হেঙ্গামেহ গোলেস্তাঁ। আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশ করে সাঈদা খানম বলেন, ৬৫ বছর আগে যখন ছবি তোলা শুরু করেছিলাম তখন দুই হাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। সে কারণেই আজকের এই সম্মাননাপ্রাপ্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সম্মাননাপ্রাপ্তির অনুভূতি প্রকাশে মুক্তিযোদ্ধা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নাসির আলী মামুন। শিল্পচর্চায় ছবি মেলার গুরুত্ব তুলে ধরে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এ ধরনের শৈল্পিক আয়োজনের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে মানবিক সমাজ। জীবনকে যুক্ত করতে হবে সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে। আর শিল্পের প্রতি আমাদের ভালবাসা যত বাড়বে তত বেশি মানবিক মানুষ তৈরি হবে। ছবি মেলার এবারের বিষয় নির্বাচনের তাৎপর্যটি উঠে আসে উৎসব পরিচালক শহীদুল আলমের বক্তব্যে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বই আজ যুদ্ধ নামের ভয়ঙ্কর খেলায় বিপর্যস্ত। বিশ্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুখে শান্তির কথা বললেও অবস্থার উত্তরণে কোন ভূমিকা রাখেন না। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। আর আলোকচিত্রীরা তাদের ছবি মাধ্যমে সেই পরিবর্তনের কথাই মেলে ধরেছেন। এ কারণেই এবার মেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে অবস্থান্তর। লিয়াকত আলী লাকী বলেন, শুধু এশিয়ায় নয়, সারা বিশ্বেই এখন আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত এক আলোকচিত্র উৎসব ছবি মেলা। নানাভাবে দ্বিধাবিভক্ত পৃথিবীর ভারসাম্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে আলোকচিত্র। ছবি মেলায় অংশ নেয়া বাংলাদেশের পাঁচ আলোকচিত্রী হলেন নাসির আলী মামুন, নাঈম মোহাইমেন, সাহরিয়া শারমিন, দেবাশিস চক্রবর্তী ও তৌফিকুর রহমান অনীক। মেলার বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে কানু গান্ধীর ‘কানু’স গান্ধী’, পুষ্পমালা এন’র ‘নেটিভ উইমেন অব সাউথ ইন্ডিয়া : ম্যানারস এ্যান্ড কাস্টমস (২০০০-২০০৪)’, নাঈম মোহাইমেনের ‘ইউনাইটেড রেড আর্মি’, স্ট্যানলি গ্রিনের ‘ওপেন উন্ড’সহ দেশ-বিদেশের বিখ্যাত আলোকচিত্রীদের অনবদ্য সব ছবি। এর বাইরে রয়েছে ফেলো হিসেবে নির্বাচিত ১০ বাংলাদেশী শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। তাঁদের শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে চিত্রকর্ম, এ্যানিমেশন, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র ও ইনস্টলেশন। মেলায় প্রদর্শনী ছাড়াও ৬টি কর্মশালা, ২ দিনব্যাপী পোর্টফোলিও রিভিউ, আর্টিস্ট টক, লেকচার ও প্রেজেন্টেশন রয়েছে ছবি মেলায়। বাংলাদেশ ছাড়া মেলায় অংশ নেয়া অন্য দেশগুলো হলোÑ আলজিরিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা. ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইরান, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, পোল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, স্পেন, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। দুই সপ্তাহব্যাপী এ মেলা চলবে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। ছায়ানটে বার্ষিক লোকসঙ্গীতের আসর[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ ॥ শুক্রবার শীতের সন্ধ্যায় সহজিয়া সুর ভেসে বেড়াল ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে। শিকড়রসন্ধানী মাটির গানের মর্মবাণীতে আপ্লুত হতো নাগরিক মন। অনুষ্ঠিত হলো ছায়ানটের বার্ষিক লোকসঙ্গীতানুষ্ঠান। সান্ধ্যকালীন সঙ্গীত আসরটি উৎসর্গ করা হয় গীতিকবি আবদুল গফুর হালীকে। পরিবেশিত হয় চার লোককবির রচিত গান। তাঁরা হলেন ওসমান খান, কছিম উদ্দীন, মমতাজ আলী খান ও রশীদ উদ্দীন। ‘দুই কূলের সুলতান’ ভা-ারি শীর্ষক সম্মেলক সঙ্গীতের মাধ্যমে শুরু হয় পরিবেশনা। এরপর স্বাগত বক্তব্য রাখেন ডা. সারওয়ার আলী। কথন শেষে বাজানো হয় আবদুল হালীর গান ‘একদিন যাইবো তোরে নোমাতাই’। নাজমুল আহসান তুহিন গেয়ে শোনান, ‘মানুষ ধর, মানুষ ভজ’। এছাড়া একক কণ্ঠে গান শোনান আবুল কালাম আজাদ, নাদিরা বেগম, চন্দনা মজুমদার, স্বপ্না রায়, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, সরদার মোঃ রহমাতুল্লা, এরফান হোসেন, সাদিকা নূর প্রমুখ। তাঁদের গাওয়া কয়েকটি গানের শিরোনাম ছিল ‘সকল গোলমাল মিটে যাবে’, ‘ওরে সুন্দইরা নায়ের মাঝি’, ‘সোনার ময়না পাখি’, ‘এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া’, ‘আমার আশায় যায়রে দিন’, ‘অচিন গাঁয়ের অচিন বন্ধু রে’ ও ‘সোনা বন্ধু তুই আমারে’। সম্মেলক কণ্ঠে গীত হয় ‘এবার ধান কাটিব কচাকচ’, ‘বাংলাদেশের মাটি ওগো’ ও ‘নয়া বউ নাইওর যায়’। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে শেষ শ্রোতাকে সিক্ত করা এই লোকগানের আসর। ঢাকা আন্তর্জাতিক পয়েট সামিট ॥ শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা আন্তর্জাতিক পয়েট সামিট। দেশের কবিদের সঙ্গে বিদেশী কবিদের পারস্পরিক ভাব-বিনিময় ও প্রাণবন্ত আলোচনায় সাজানো ছিল সাহিত্যের এ আয়োজন। কবিতা নিয়ে বিশ্বের এই শীর্ষস্থানীয় সম্মেলনে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কবি ছাড়াও অংশ নেন নবীন কবিগণ। আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিদেশী কবিদের মধ্যে ছিলেন অস্ট্রিয়ার মেনফ্রেড কোবো, জার্মানির ইওনা বুরঘার্ট, রাশিয়ার ভিক্টর পোগাদাইভ, জার্মানির টবিয়াস বুরঘার্ট, পুয়ের্তো রিকোর লুজ মারিয়া লোপেজ ও মারিয়া ডি লো এনজেলেজ কামাচি রিভা প্রমুখ। দেশের কবিদের মধ্যে ছিলেন আসাদ চৌধুরী, হায়াৎ সাইফ, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হাবীবুল্লাহ্ সিরাজী ও জাহিদুল হক। সভাপতিত্ব করেন সম্মেলনের আয়োজক সংগঠন কথক বাংলাদেশের সভাপতি আশির দশকের অন্যতম কবি আমিনুর রহমান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাশেদ খান মেনন বলেন, কবিতা মানুষের মনোভাব প্রকাশ করে। মূল্যবোধ জাগাতে সাহায্য করে। আর কবিরা একেক দেশের সম্পদ। তারাই যেমন মননশীলতা পরিচয় দেয় কবিতার ছন্দে ছন্দে। আবার তারাই মানুষে মানুষে বন্ধন সৃষ্টি করেন। ঢাকা আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন তারই একটি শুভ উদ্যোগ।
×