ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ও মানবসম্পদ উন্নয়ন

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ও মানবসম্পদ উন্নয়ন

মহল্লার ওষুধ দোকানির সঙ্গে সপ্তাহে আমার অন্তত একবার হলেও দেখা হয়। ওই দেখায় ওষুধ, রোগ ও ডাক্তারের বাইরে সাধারণত আলাপ হয় না। একদিন এসব আলোচনার ফাঁকে রূপপুরের প্রসঙ্গ এলে দোকানি আমাকে কথা শেষ না করতে দিয়েই বলল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের কথা বলছেন তো। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ে দক্ষ জনবল তো নেই। কে চালাবে এই বিদ্যুতকেন্দ্র! আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি জানলেন কিভাবে যে, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনার মতো লোকবল নেই। উনি বললেন, কেন-পত্রিকায় পড়েছি। দোকানির সঙ্গে কথা বলার পর আমি বুঝতে পারলাম কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে থাকা বিশেষ পত্রিকার গোয়েবলসীয় প্রচারণার ঢেউ এই ওষুধ দোকানির মগজেও লেগেছে। বস্তুত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণবিরোধী প্রচারণার বিশাল অংশ জুড়ে ছিল, এই প্রকল্প পরিচালনার মতো দক্ষ জনবল বাংলাদেশে নেই। তাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে আজীবন রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে। এবং রাশিয়ানরা যা বলবে বাংলাদেশকে তা-ই শুনতে হবে। বিষয়টি আসলে কি তা-ই? এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম কি? কীভাবে কোন দেশ পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের যুগে পদার্পণ করে থাকে? পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশের পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়ন অপরিহার্য। দেশের পারমাণবিক অবকাঠামো উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সহায়তায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ২০০ জনের অধিক বিজ্ঞানীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষিত জনবলের অধিকাংশই বর্তমানে প্রকল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন চুক্তি সম্পাদন এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে জড়িত। এদিকে প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতে ৫৫ জন কর্মকর্তার “ফাউন্ডেশন কোর্স অন নিউক্লিয়ার এনার্জি” বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী সমাপ্ত হয়েছে এবং শীঘ্রই আরও ৩৫জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন থেকে রূপপুর প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পে সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ৮২ জন এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত ৪০জনসহ সর্বমোট ১২২জন প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত আছে। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট জনবলের কাজের প্রকৃতিও ভিন্ন এবং তাদের পৃথক আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এজন্য পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার জন্য পৃথক পৃথক জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) গাইডলাইন এবং আন্তর্জাতিক রেওয়াজ অনুযায়ী পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর মূল পর্যায়ের নির্মাণ কাজ বা ফার্স্ট কনক্রিট ডেইট (এফসিডি) থেকে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের এফসিডি ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু পারমাণবিক যুগে নবাগত হিসেবে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের ক্ষেত্র পর্যায়ে কমিশনিং পর্যায়ে অংশগ্রহণের জন্য দক্ষ জনবল সৃষ্টির লক্ষ্যে এফসিডি’র পূর্বেই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অপারেটিং অর্গানাইজেশনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি বিষয়ে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল গড়ে তোলা আবশ্যক। স্বাক্ষরিত জেনারেল কণ্ট্রাক্টে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ জনবল তৈরির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্পটি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন এবং কেন্দ্রটি সুষ্ঠু ও নিরাপদে পরিচালনার জন্য আনুমানিক দুই হাজার পাঁচশ’ পঁয়ত্রিশ জন জনবল প্রয়োজন হবে। ওই জনবলের এক হাজার চারশ’ চব্বিশ জনকে এর অধীনে ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জব পজিশন এবং জব ফাংশনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানদ-ের নিরিখে বিভিন্ন মেয়াদে ঠিকাদারের সহায়তায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আটশ’ পঞ্চাশ জনকে রাশিয়ান ফেডারেশনে এবং পাঁচশ’ চুয়াত্তর জনকে রাশিয়ান ফেডারেশনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। প্রশিক্ষিত জনবলের মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স গ্রহণ করবে এবং সফলতার সাথে প্রশিক্ষণ শেষে কমিশনিংয়ের পূর্বে দেশে প্রত্যাবর্তন করে রাশান ফেডারেশনের বিশেষজ্ঞদের সাথে যৌথভাবে কমিশনিং পর্যায় হতে কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ভবিষ্যতে রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট (এনপিপি) পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণে দক্ষ জনবল তৈরির জন্য রূপপুর প্রকল্প এলাকায় একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। উক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রশিক্ষক তৈরির সংস্থান স্বাক্ষরিত জেনারেল কণ্ট্রাক্টে রয়েছে। এছাড়াও সুষ্ঠু এবং নিরাপদ পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় কারিগরি সেবা গ্রহণের জন্য প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ এবং অভিজ্ঞ প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে সার্ভিস কণ্ট্রাক্টের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের ডিজাইন ও নিরাপত্তা বিষয়ে রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিশেষ অনুদানের আওতায় ৪৭ জন শিক্ষার্থীকে রাশিয়ান ফেডারেশনে প্রেরণ করা হয়েছে। উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের পর উল্লিখিত শিক্ষার্থী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত হবে। পারমাণবিক বিদ্যুত ও কর্মসূচী সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে মেধাবী, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশীয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং পারমাণবিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মেধাবী নবীন জনবল আবশ্যক। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল (বিউপি) নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেছে এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পারমাণবিক প্রযুক্তি বিষয়ে মেধাবী ছ্ত্রাছাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে পরমাণু বিজ্ঞান বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হতে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কারিকুলামে পরমাণু বিজ্ঞান বিষয় অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরফলে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক প্রযুক্তি বিষয়ে ধারণাসম্পন্ন সহায়ক কর্মী পর্যায়ের প্রয়োজনীয় জনবল তৈরির অপার এক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এসবই সম্ভব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বের বদৌলতে। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক
×