ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বীরোচিত আত্মদান

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩১ জানুয়ারি ২০১৭

বীরোচিত আত্মদান

অপরের প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শ্রমজীবী বাদল মিয়া প্রমাণ করলেন, ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ আর এমন চেতনা ধারণা করা সবার পক্ষে সহজতর নয়। আরও দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন সাহসিকতাপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধের। নিজের জীবনকে বিপন্ন করে, এই বীরোচিত আত্মদান তাকে মানবতার বীর সেনানীর স্তরে আত্মদান করেছে। কবি জীবনানন্দ দাশ গত শতকের চল্লিশের দশকে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘মানুষ মরে গেলে, তবু মানব থেকে যায়।’ বাদল মিয়া অজানা অচেনা মা ও শিশুকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে তুলনাহীন এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বুঝিয়ে দিলেন, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্যই।’ এমন মানুষ আছেন বলেই জগতজুড়ে মানবজীবন ধারা আজও প্রবাহিত হয় মানবিকতাকে ধারণ করেই। আগ-পিছু না ভেবেই, এমনকি নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে কিনা তাতে মনকে নিবদ্ধ না করে মৃত্যুমুখী শিশুকে রক্ষা করে জানিয়ে গেলেন, মানবতা আজও লুপ্ত হয়নি। এবং নিজেই হয়ে গেলেন মানবতার এক বীর সেনানী। রেললাইন পার হতে থাকা এক নারীর সঙ্গে শিশুকে ঝটকা মেরে সরিয়ে প্রাণ বাঁচালেও নিজে বাঁচতে পারেননি দরিদ্র ৫৮ বছর বয়সী এই রেলকর্মী। সিলেট থেকে ঢাকামুখী সুরমা এক্সপ্রেস ট্রেনটি দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসছিল। সময়ক্ষেপণ না করে নিমিষেই দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। কিন্তু নিজে সরার সময়টুকু আর পাননি। দুর্ভাগ্য, দ্রুতগতির ট্রেনের ধাক্কায় ও চাকায় কাটা পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার শরীর। মহৎপ্রাণ বাদল মিয়ার নিথর খ-বিখ- দেহ পড়ে থাকে লাইনের ওপর। রক্তে রঞ্জিত হয় রেলপথ। স্ত্রী, তিন কন্যা ও পাঁচ ছেলের বাবা বাদল মিয়া ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। পুরো পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। রেল কর্তৃপক্ষ অবশ্য পরিবারটাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছেন। রেল বিভাগে অস্থায়ীভাবে কর্মরত থাকা মেজ ছেলেকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি বড় ছেলেকে রেল বিভাগে চাকরি এবং আর্থিকভাবে পরিবারকে সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। মানুষকে সচেতন করার ব্যাপারে প্রচারণা চালানো জরুরী। এমনিতেই দেখা যায়, পথচারীরা রেললাইন ধরে অসচেতনভাবে হাঁটছেন। এর মধ্যে নতুন উপসর্গ হয়েছে মোবাইল ফোন। ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন অথবা অন্যমনস্কভাবে লাইনে চলছেন। পেছন থেকে যে ট্রেন আসছে, তার শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশও করে না। কেমন একটা বেখেয়ালি ভাব। যে কারণে গত ক’বছরে মোবাইল ফোনে কথা বলা পথচারী ট্রেনে কাটা পড়ার বহু ঘটনা ঘটেছে। রেল দুর্ঘটনা অবশ্য নতুন কিছু নয় এদেশে। রেলক্রসিংগুলো এমনিতেই মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে রাজধানীতে পথচারী এবং যানবাহনের জন্যও। রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অবহেলার নিদর্শন অনেক ক্রসিংয়ে গেট না থাকা, এমন কি গেটম্যানও। দশ বছর রেলে বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পর নিয়মিত কর্মচারী বাদল মিয়া দায়িত্ব ও কর্তৃব্যবোধের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থেকে গেলেন। তার প্রতি অভিবাদন। বীরের মতো মৃত্যু তার নিয়ে আসুক দুর্ঘটনামুক্ত এক বিশ্ব। মানুষ যেন এভাবে আর প্রাণ না হারায়, সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনই।
×