ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিমল মালাকার

অভিমত ॥ শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারটির প্রতি সদয় হোন

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

অভিমত ॥ শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারটির প্রতি সদয় হোন

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’... রবীন্দ্রনাথের এ অমর কাব্য চরণের অন্তর্নিহিত কথার সত্যতা কালে কালে আমরা দেখেছি মহৎ ত্যাগের ক্ষেত্রে। যারা দেশ, জাতি, মানুষ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগে স্বমহিমায় ভাস্বর। এ কথা আরও বেশি প্রযোজ্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে আত্মত্যাগী শহীদদের ক্ষেত্রে। এদের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আমরা কি কখনও ভুলতে পারব? এখনও অনেক বুদ্ধিজীবীর পরিবার-পরিজনের বর্তমান বাস্তবতা খুব সুখকর নয়। এমনই এক শহীদ বুদ্ধিজীবী মোহাম্মদ সাদেকের কথা জানাতে চাই। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের অধ্যক্ষ। একাত্তরের ২৫ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকায় মেতে ওঠে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরের বিভিন্ন জায়গায় নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে তারা। সময়টা তখন কার্যত ২৬ মার্চ। ফজরের নামাজের সময় ঘাতক পাকিস্তানী সেনারা মোহাম্মদ সাদেকের ১১ নম্বর ফুলার রোডের বাসার দরজায় ক্রমাগত লাথি মারতে থাকে। বিপদ হতে পারে জেনেও তিনি নিজেই দরজা খুলে দেন। ঘাতকরা তাঁর দিকে রাইফেল তাক করলে তিনি নির্ভয়ে ইংরেজীতে তাদের বলেন, ‘নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর এভাবে আক্রমণ করা যায় না।’ বলাবাহুল্য, মোহাম্মদ সাদেকের এই যুক্তি ঘাতকদের কাছে কোন মূল্য পায় না, যুক্তি তো নয়ই। কী অপরাধ তাঁর? বাঙালী হওয়া! সেই সঙ্গে ৭ মার্চ থেকে তাঁর বাসার বারান্দায় স্বাধীন বাংলাদেশ ও ২৩ মার্চ থেকে কালো পতাকা উড়ছিল। কথা শেষ না হতেই পাকিস্তানী সেনাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। তিনি লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে। মোহাম্মদ সাদেকের দুই হাতে গুলি লেগেছিল। তখনও তাঁর জ্ঞান ছিল। সেনারা যাওয়ার সময় মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাঁর গলায় বেয়নেট চার্জ করে। তিনি মৃত্যুকে বরণ করলেন বীরোচিতভাবে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একমাত্র তাঁর লাশটিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় (ফুলার রোড) সমাধিস্থ করা হয়। মোহাম্মদ সাদেকের জন্ম ভোলা জেলার দক্ষিণ ইলিশা গ্রামে, ১৯৩৯ সালের ৩১ মে। ভোলা সরকারী বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (১৯৫৪) পাস করার পর ভর্তি হন বরিশালের বিএম কলেজে। এখান থেকে ইন্টারমিডিয়েট (১৯৫৬) ও বিএ (১৯৫৮) পাস করেন। এরপর ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৬১তে বিএড ও ১৯৬২ সালে এমএড ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, ভোলার পরাণগঞ্জ হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এখানে চাকরি করেন। ১৯৫৯-৬০ পর্যন্ত ভোলা জেলার ব্যাংকেরহাট কো-অপারেটিভ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিছুদিন এই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। পেশাগত জীবনে নির্লোভ, দৃঢ়চেতা, সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে মোহাম্মদ সাদেক মূল্যায়িত হয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকেটে তাঁর ছবি সংযোজন করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-২০১১ সালের ক্যালেন্ডারে ‘স্মৃতিতে ৭১ : শহীদ শিক্ষকবৃন্দ’ শিরোনামে ২০ শহীদ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে মোহাম্মদ সাদেকের ছবিটি স্থান পায়। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, তাঁর পরিবার নানাভাবে বঞ্চিত। মোহাম্মদ সাদেকের স্ত্রী সামসুন্নাহার বেগম। বিয়ের মাত্র ৮ বছর পরেই পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে স্বামীকে হারান। এরপর থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আর প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মানুষ করার ব্রতি হন। এখনও নিজের কোন জমি নেই, ঘর নেই, বাড়ি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বামীর নামে বরাদ্দ দেয়া কোয়ার্টারে তারা থাকতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোয়ার্টারটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরিবারের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ওই বাড়ি থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হয়। সেই থেকে বাস্তুহারা। আজও হয়নি নিজেদের স্থায়ী কোন বাসস্থান। জীবনের শেষ বয়সে এসে এখন ছেলেমেয়েদের বাসায় ঘুরে ঘুরে দিন কাটাচ্ছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শহীদ পরিবারকে ডেকেছিলেন। এর মধ্যে শহীদ সাদেকের পরিবারও ছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের ২ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। সামসুন্নাহারের বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাদের জন্য অনেক কিছুই করতেন। দুই ছেলে ও দুই কন্যার জননী সামসুন্নাহার বেগম মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার মতোই দয়ালু। তিনি চাইলে তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারেন। তার আশা সরকার তাকে ছোটখাটো একটা ঘর করে দেবে। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্ত্রী হিসেবে সনদ, আবাসন ও সরকারী ভাতাসহ অন্য সুযোগ-সুবিধাদি নিয়মানুযায়ী আশা ও দাবি করেন। এ ব্যাপারে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মাধ্যমে ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে আবেদন করেছেন। তিনি আশায় দিন গুনছেন কবে তার আবেদন মঞ্জুর হবে? বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও নেতৃত্বদানকারী দলের মাধ্যমে এসেছে, তাই এ সরকারের কাছে শহীদজায়া হিসেবে সামসুন্নাহার বেগম ও তার পরিবারের প্রত্যাশা বেশি।
×