ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে

৮ জানুয়ারি ২০১৭ দৈনিক জনকণ্ঠের ১৮ পাতায় অর্থ ও বাণিজ্য বিভাগে ‘ওষুধ নীতিমালার খসড়ায় কোম্পানির স্বার্থ বেশি রক্ষা করা হয়েছে’ শীর্ষক সংবাদটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। এতে কিছু অসত্য তথ্য পরিবেশিত হয়েছে, যা ইতোমধ্যেই জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আমরা এর প্রতিবাদ করছি। অনুগ্রহ করে নিম্নেœ বর্ণিত আমাদের বক্তব্যটি আপনার প্রখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশ করলে অত্যন্ত বাধিত হবো। সংবাদটিতে প্রকাশিত বক্তব্য অনুযায়ী গত ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ সরকার কর্তৃক ঘোষিত ওষুধ নীতিতে ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ বেশি রক্ষা করা হয়েছে- এ বক্তব্যটি সঠিক নয়। কারণ এবারের ওষুধনীতিতে : (এক) নকল- ভেজাল-নিম্নমানের ওষুধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, (দুই) ওষুধ উৎপাদনে ১৯৭৬ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) বা উত্তম উৎপাদন কৌশল মেনে চলার জন্য কোম্পানির ওপর কার্যকর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে, (তিন) একইভাবে আয়ুর্বেদ-ইউনানী-হোমিওপ্যাথি-হার্বাল-বায়োকেমিকÑসব ওষুধ কোম্পানির জন্যও একইভাবে জিএমপি মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, (চার) এলোপ্যাথির পাশাপাশি দেশে প্রথমবারের মতো আয়ুর্বেদ-ইউনানী-হোমিওপ্যাথি-বায়োকেমিক ওষুধেরও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে, (পাঁচ) ৩৯টি ওষুধ ব্যতীত অন্য সব ওষুধের (যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, অন্যান্য হরমোন, হিপনোটিক, সিডেটিভ, ট্রাঙ্কুইলাইজার, নারকোটিক, এন্টি-ক্যান্সারসহ প্রায় ১,৩০০ ওষুধ) প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, (ছয়) এ দেশে প্রথমবারের মতো ৩৯টি ওষুধ নিয়ে (যেগুলো সাধারণ অসুখে বহুল ব্যবহৃত এবং যেগুলোর পাশর্^প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে কম) একটি ওভার-দি-কাউন্টার (ওটিসি) বা ব্যবস্থাপত্রহীন ওষুধের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, (সাত) একইভাবে সার্ক ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আয়ুর্বেদ ও ইউনানী ওষুধের জন্য ওটিসি ওষুধের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, (আট) দেশের ওষুধের দোকানগুলোকে উন্নত বিশে^র মতো আধুনিকায়ন করে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধানে ‘মডেল ফার্মেসি’ প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে (ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরীতে গত তিন সপ্তাহে এরকম সাতটি মডেল ফার্মেসি স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতিষ্ঠা করেছেন, যথাসম্ভব দ্রুত তা সারা দেশে বিস্তৃত করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তরুণ গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা দেশের কাজ হিসেবে এসব ফার্মেসিতে যোগ দিচ্ছেন)। (নয়) রোগীর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে বাংলাদেশেই ওষুধের বায়োইকুইভ্যালেন্স এবং ক্লিনিক্যাল স্টাডি করার ব্যবস্থা করা হয়েছে, (দশ) মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি এবং ওষুধের প্যাকেটে উল্লিখিত নির্ধারিত দামের চাইতে বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, (এগারো) এ দেশে প্রথমবারের মতো নকল-ভেজাল-নিম্নœমান-মেয়াদোত্তীর্ণ-চোরাচালানকৃত ওষুধ ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত রোগীদেরকে কোম্পানি ও দোকানদার কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং (বারো) এ দেশে প্রথমবারের মতো ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা শুধু সরকার বা কোম্পানির হাতে সীমিত না রেখে দাম নির্ধারণে স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থে সব স্টেকহোল্ডার যথাÑ সরকার-কোম্পানি-চিকিৎসক-ফার্মাসিস্ট-ভোক্তা সবার সমন্বয়ে গঠিত কমিটির কাছে দেয়া হয়েছে। তাই সরকারের এমন জনবান্ধব ওষুধনীতিটি যাতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির কবলে না পড়ে সেজন্য সবারই সচেষ্ট থাকা উচিত। একই পরিবেশিত সংবাদে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মন্তব্যটিও সত্যের অপলাপ এবং বিভ্রান্তিকর। তিনি উষ্মা প্রকাশ করেছেনÑ কেন আমরা বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় উল্লিখিত ওষুধগুলো কমিয়ে এবারের ওষুধনীতির অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করেছি? আমাদের উত্তর হচ্ছে, বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়নকালে সারা বিশে^র সব দেশের কথা বিবেচনা করে তা প্রণয়ন করেছে। আমাদের দেশে অনেক অসুখ নেই যেগুলো অন্য দেশে আছে। সেক্ষেত্রে সেই সব ওষুধ আমাদের তালিকায় রাখা অযৌক্তিক এবং বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থারও এটিই নিয়ম। যেমনÑ আফ্রিকায় ইয়েলো ফিভার বা স্লিপিং সিকনেস আছে, এগুলোর ওষুধ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আফ্রিকার দেশগুলোর অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় রয়েছে, অন্যত্র নেই। আমাদের দেশে এসব ওষুধ তালিকায় রাখার প্রশ্ন তাই অবান্তর। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি প্রণয়নকালেও জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম ও ডাঃ জাফরুল্লাহসহ বিশেষজ্ঞরা এসব ওষুধ তাদের প্রণীত তালিকায় রাখেননি। উপরন্তু তাঁরা ১৯৮২-তে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ১৫০টি ওষুধ রেখেছিলেন, এবার রাখা হয়েছে ২৮৫টি। ডাঃ জাফরুল্লাহ যে রাজনীতি করেন সেই দলটি যখন ২০০৫ সালে ওষুধনীতি প্রণয়ন করে তখন তারা অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের কোন তালিকায় রাখেননি। তখন তিনি প্রতিবাদ করেননি কেন? আজ যখন ২৮৫টি ওষুধকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সরকার বিশে^র অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয় একটি চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তখন এর বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ অযৌক্তিক ও ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা’ বলেই প্রতীয়মান হয়। এছাড়া সংবাদটিতে তিনি ফার্মাসিস্টদের নিয়ে একটি অসত্য ও অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কমিটিতে অধিকাংশই ফার্মাসিস্ট ছিল। কারণ ওষুধ কোম্পানির দয়া ও ধাক্কা নিয়ে চলতে হয় তাদের’। আমরা তাঁর এই উক্তির তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ওষুধনীতি প্রণয়ন কমিটি বা উপ-কমিটিতে অধিকাংশই ফার্মাসিস্ট ছিল না, যদিও যে কোন দেশে এরকম কমিটিতে তাদেরই বেশি সংখ্যায় থাকার কথা। কারণ জিএমপি অনুযায়ী ওষুধের উৎপাদন, গুণগত মান-নিয়ন্ত্রণ, বিতরণ, বিক্রয়, নিরাপদ ব্যবহার, আমদানি, রফতানি, নীতিমালা প্রণয়ন ইত্যাদি ফার্মাস্টিদেরই বিশেষায়িত এলাকা। রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে একমাত্র তাদেরকেই এসব বিষয় পড়ানো হয়। আন্তর্জাতিকভাবে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও তাই। ফার্মাসিস্টরা তাদের অর্জিত জ্ঞান ও নৈতিক নীতিমালা নিয়ে পৃথিবীর সব দেশে কাজ করে আসছেন। কোন ওষুধ কোম্পানির দয়া বা ধাক্কায় নয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতো ওষুধ বিজ্ঞানও একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা এবং ফার্মাসিস্টরা এ জন্য গর্বিত। ডাঃ জাফরুল্লাহর এই মন্তব্য সমগ্র ফার্মাসিস্ট সমাজের জন্য অপমানজনক ও কুরুচিপূর্ণ এবং তা দেশের ফার্মাসিস্টদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অবিলম্বে তাঁর এই বক্তব্য প্রত্যাহার ও দুঃখ প্রকাশ করার জন্য তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছি। অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও আহ্বায়ক জাতীয় ওষুধনীতি-২০১৬ প্রণয়ন উপ-কমিটি
×