ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

শীত উপেক্ষা করে দলে দলে মুসল্লিরা আসছেন

বিশ্ব এজতেমা শুরু আজ ॥ ৫ স্তরের নিরাপত্তা বলয়

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

বিশ্ব এজতেমা শুরু আজ ॥ ৫ স্তরের নিরাপত্তা বলয়

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ টঙ্গীর তুরাগ তীরে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত তবলীগ জামাতের এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে। কনকনে শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে বাস-ট্রাক, কার-পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে দলে দলে মুসল্লিরা টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমাস্থলে আসছেন। তারা কাঁধে-পিঠে প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে এজতেমাস্থলে এসে নিজ জেলার খিত্তায় অবস্থান নিচ্ছেন। অবশ্য গত কয়েকদিন থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জামাতবদ্ধ মুসল্লিরা এসে ময়দানের খিত্তায় খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। আজ প্রথম দিন শুক্রবার বাদ ফজর আনুষ্ঠানিক আমবয়ানের মাধ্যমে তবলীগের বুজুর্গ মুরব্বিরা এর সূচনা করবেন বলে জানা গেছে। তবে বৃহস্পতিবারই বিশ্ব এজতেমার বিশাল ময়দানে লাখো মুসল্লি জমায়েত হওয়ায় বাদ মাগরিব থেকেই মুসল্লিদের মাঝে হেদায়েতী বয়ান শুরু হয়েছে। এদিকে বিশ্ব এজতেমায় আগতদের নিরাপত্তা দিতে ইতোমধ্যেই এজতেমা ময়দান ও আশপাশ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। এজতেমা ময়দানে মুসল্লিদের চলাফেরা ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ওয়াচ টাওয়ারসহ স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। পুরো এজতেমা ময়দান সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। আজ শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে আগামী রবিবার (১৫ জানুয়ারি) আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হবে। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি শুরু হবে দ্বিতীয় পর্ব। এবারের বিশ্ব এজতেমায় মুসল্লিদের উপস্থিতি গত দু’বছরের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে এজতেমার মুরব্বিগণ আশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, গত দু’বছর এজতেমার সময় জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধ ও হরতালের কারণে অনেক মুসল্লি ময়দানে আসতে পারেননি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকা হতে নানা কষ্ট ও বিড়ম্বনা উপেক্ষা করে তবলীগ অনুসারী মুসল্লিরা গাড়িতে চড়ে ও হেঁটে বিশ্ব এজতেমা ময়দানে আসছেন দলে দলে। এদিকে বিশ্ব এজতেমার সর্বশেষ সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর পুলিশ ও র‌্যাবের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ও বিকেলে আলাদাভাবে ব্রিফিংকালে পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মইনুর রহমান চৌধুরী, র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ, পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান ও গাজীপুরে এসপি হারুন-অর-রশিদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গীবাদের বিষয়টি মাথায় রেখে এজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যাপক জোরদার করা হয়েছে। জঙ্গীসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নাগরিকদের ওপর থাকছে বিশেষ নজরদারি। বিশ্ব এজতেমা ময়দানে জঙ্গীর কোন হুমকির আশঙ্কা করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ও কলকারখানার শ্রমিক-মালিকসহ বিভিন্ন পেশার মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা বিশ্ব এজতেমার মাঠে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করেছেন। ময়দানে মুসল্লিদের কাতারবদ্ধ হওয়ার জন্য পুরো মাঠে দাগ কাটা সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া এজতেমা ময়দানে জেলাওয়ারী মুসল্লিদের স্থানও (খিত্তা) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মুসল্লিদের তুরাগ নদ পারাপারের জন্য সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা এবারও তুরাগ নদীতে ভাসমান সেতু নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেছেন। প্রথম পর্বে মুসল্লিরা খিত্তাওয়ারী যেভাবে অবস্থান নেবেন ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বে ২৭টি খিত্তায় ঢাকার একাংশ ও গাজীপুরসহ ১৭ জেলার মুসল্লিদের জন্য ময়দানে জেলাওয়ারী মুসল্লিদের স্থান (খিত্তা) নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মুসল্লিরা জেলাওয়ারী এসব খিত্তায় অবস্থান নেবেন। এ পর্বে মুসল্লিরা জেলাওয়ারী যে সকল খিত্তায় অংশ নেবেন সেগুলো হলোÑ ১ থেকে ৫ নম্বর খিত্তায় ঢাকা জেলা, ৬ থেকে ৮নং খিত্তায় টাঙ্গাইল জেলা, ৯ থেকে ১১নং খিত্তায় ময়মনসিংহ জেলা, ১২নং খিত্তায় মৌলভীবাজার জেলা, ১৩নং খিত্তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, ১৪নং খিত্তায় মানিকগঞ্জ, ১৫নং খিত্তায় জয়পুরহাট, ১৬নং খিত্তায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ১৭নং খিত্তায় রংপুর, ১৮ ও ১৯নং খিত্তায় গাজীপুর, ২০নং খিত্তায় রাঙ্গামাটি, ২১নং খিত্তায় খাগড়াছড়ি, ২২নং খিত্তায় বান্দরবান, ২৩নং খিত্তায় গোপালগঞ্জ, ২৪নং খিত্তায় শরীয়তপুর, ২৫নং খিত্তায় সাতক্ষীরা এবং ২৬ ও ২৭নং খিত্তায় যশোর জেলা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ॥ গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার থেকে এজতেমার চারপাশে ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। এবারই প্রথম বিশ্ব এজতেমার চারপাশ এবং বাইরে সিসি টিভির আওতায় আনা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে টঙ্গীর টেলিফোন শিল্প সংস্থার (টেশিস) মাঠে এক ব্রিফিংয়ের তিনি এ সব কথা বলেন। পুলিশ সুপার বলেন, এবারের বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বে ছয় হাজারের অধিক ফোর্স থাকবে। থাকবে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এজতেমা মাঠের ভেতরে সাদা পোশাকে পর্যাপ্ত পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পর্যাপ্ত সদস্য নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকবে। খিত্তায় খিত্তায় পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এজতেমা উপলক্ষে বিভিন্ন মোড়ে ও গলিসহ এজতেমার প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এজতেমাকে ঘিরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসল্লিদের সার্বিক নিরাপত্তা দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদেশী খিত্তায় তিনটি আর্চওয়ে স্থাপন করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে বেশি ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। সেখান থেকে পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছে। এছাড়া একটি অত্যাধুনিক কন্ট্রোলরুম ও পাঁচটি সাব-কন্ট্রোলরুম করা হয়েছে। পুরো এজতেমা এলাকাকে পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে এ্যাডিশনাল এসপিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি এজতেমায় আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে বলেন, মুসল্লিরা যদি কোন সমস্যায় পড়েন তবে তারা যেন পুলিশের শরণাপন্ন হন। পাশাপাশি তারাও খেয়াল রাখবেন। এজতেমায় বিদেশী মুসল্লি ॥ মাঠের পশ্চিম-উত্তর কোণে গড়ে তোলা হয়েছে বিদেশী মেহমানদের (মুসল্লি) আবাসন ব্যবস্থা। সেখানে বিদ্যুত, টেলিফোন, গ্যাস সংযোগসহ রয়েছে আধুনিক সুবিধাদি। বিদেশী নিবাসের রন্ধনশালায় রয়েছে তাদের আপ্যায়নের নানা আয়োজন। বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা বাণী দিয়েছেন। ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প ॥ বৃহস্পতিবার দুপুরে ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এজতেমা ময়দানের উত্তর পাশে মুন্নু টেক্সটাইল মিলের মাঠে হামদর্দের ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প এলাকায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইবনে সিনা এবং টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতিসহ প্রায় অর্ধশতটি সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফ্রি চিকিৎসা কেন্দ্র চালু করেছে। স্বাস্থ্যসেবা ॥ গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ আলী হায়দার খান বলেন, এজতেমা উপলক্ষে সকল প্রস্তুতি জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। টঙ্গী সরকারী হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। হাসপাতালে একটি নিজস্ব কন্ট্রোলরুম ছাড়াও কার্ডিয়াক, বার্ন, এ্যাজমা, ট্রমাসহ বিভিন্ন ইউনিট খোলা হয়েছে। এছাড়াও টঙ্গী সরকারী হাসপাতালের উদ্যোগে একাধিক মেডিক্যাল সেন্টার খোলা হয়েছে। বিশ্ব এজতেমায় যাতায়াতে ডিএমপির নির্দেশনা ॥ বিশ্ব এজতেমায় মুসল্লিদের যাতায়াত নির্বিঘœ করতে যানবাহন পার্কিংসংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। বৃহস্পতিবার ডিএমপি থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রেইনবো ক্রসিং থেকে আব্দুল্লাহপুর হয়ে ধউর ব্রিজ পর্যন্ত এবং রামপুরা ব্রিজ থেকে প্রগতি সরণি পর্যন্ত রাস্তা ও রাস্তার পাশে কোন যানবাহন পার্কিং করা যাবে না। বিদেশগামী বা বিদেশ ফেরত যাত্রীদের বিমানবন্দরে আনা-নেয়ার জন্য ট্রাফিক উত্তর বিভাগের ব্যবস্থাপনায় চারটি বড় আকারের মাইক্রোবাস নিকুঞ্জ-১ আবাসিক এলাকার গেটে ভোর ৪টা থেকে থাকবে। এছাড়াও সাহায্যের জন্য- ১০০, ৭১২৪০০০, তথ্যের জন্য- ডিএমপি মিডিয়া সেল- ৯৩৩৭৩৭৯, ০১৭১৩৩৯৮৭৫৬-৭, ০২-৯৩৩৭৩৬২ নম্বরে ডায়াল করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। ট্রাফিক সম্পর্কিত যে কোন তথ্যের জন্য উত্তরা ট্রাফিক জোনের সিনিয়র এসি মোঃ জিন্নাত আলী মোল্লা, (০১৭১৩৩৯৮৪৯৮) এবং টিআই মোঃ মাহফুজার রহমানের (০১৭১১৩৬৬৫৬১) সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। দুই মুসল্লির মৃত্যু ॥ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত এজতেমায় আগত দুই মুসল্লি মারা গেছেন। এদের মধ্যে বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটায় সাতক্ষীরা জেলা সদরের মৃত আব্দুস সোবহানের ছেলে আব্দুস সাত্তার (৬০) মারা গেছেন। এর আগে বুধবার রাতে ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল থানার মারুয়া গ্রামের ফজলুল হক (৫৬) মারা যান। বার্ধক্যজনিত কারণে তারা এজতেমা ময়দানে মারা যান বলে জিম্মাদার জানিয়েছেন।
×