ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

দুই সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৭

দুই সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শামীম তোমার ভুলের জন্য আমি চলে গেলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম ছেলেমেয়ে। আমি যেখানে থাকব ছেলেমেয়েও সেখানেই থাকবে। তুমি ভাল থেকো। চিরকুটে এমনই বাণী লিখে নিজ হাতে বঁটি দিয়ে ছেলে ও মেয়েকে খুন করেন তিনি। তারপর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ঝুলে পড়েন। এভাবেই করুণ পরিণতি বরণ করে নেন একুশ বছরের গৃহবধূ আনিকা। তিনি ছিলেন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। রাজধানীর দারুসসালাম থানার ছোট দিয়াবাড়ি এলাকার টিনশেড বাড়িতে হতভাগী আনিকা, তার শিশুকন্যা শামীমা (৫) ও ছেলে আব্দুল্লাহর (৩) মরদেহ দেখতে পায় পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেলে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আনিকার স্বামী শামীম হোসেনের (২৯) বাড়ি গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের ভাবনাসুর গ্রামে। আনিকার পিতার নাম গেদু মিয়া। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার বনগ্রামে তার বাড়ি। পুলিশ জানিয়েছে, দুই শিশুসন্তানকে হত্যার পর মা নিজেই আত্মহত্যা করেছেন। দারুসসালাম জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মামুনুর রশিদ জানান, মা তার গর্ভজাত দুই শিশুকে বঁটি দিয়ে জবাই করে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন। রাতে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়। দারুসসালাম জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মামুনুর রশিদ জানান, বঁটি দিয়ে শিশুদের জবাই করা হয়েছে। বিকেল সাড়ে ৩টায় ২৯/১ ছোট দিয়াবাড়ির বাসায় পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ঢুকে দেখতে পায় ফ্যানের সঙ্গে আনিকা ঝুলছেন। পাশেই দুই শিশুর গলাকাটা মরদেহ পড়েছিল। আনিকার স্বামী মোহাম্মদ শামীম হোসেন। তিনি একটি সেলুনে কাজ করেন। ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শনে জানা যায়, ছোট দিয়াবাড়ির মসজিদ রোডের সাইদ মাস্টারের বাড়িতে গত এক বছর ধরে ২২শ’ টাকা ভাড়ায় ছিল হতভাগা এ পরিবার। বাড়িটি টিনশেড। দু’পাশে টিনশেডের সারি সারি ঘর। মাঝখান দিয়ে একটা গলি। আনিকার ঘর সবার শেষপ্রান্তে। তার সংলগ্ন একটি রান্নাঘর। যেখানে ওই বাড়ির সবাই রান্না করে পালাক্রমে। শিরিন নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জনকণ্ঠকে জানান, মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত আনিকার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। এতে কৌতূহলবশত এক মহিলা তার ঘরের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে তাকায়। তখনই তিনি আঁতকে ওঠেন। দেখেন, চৌকির ওপর রক্তাক্ত ছেলেমেয়ে। তার পাশেই ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত আনিকা। তার পরনে থ্রিপিস। তখন তিনি চিৎকার করে সবাইকে ডাকেন। সঙ্গে সঙ্গে খবর দেয়া হয় পুলিশকে। বিকেল সাড়ে তিনটায় পুলিশ আসে। লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিক্যালে। এদিকে দারুসসালাম থানার ওসি ফারুক জানান, ঘটনাস্থল থেকে এ তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের সময় বিছানায় একটি চিরকুট পাওয়া যায়। চিরকুটটি আনিকারই হাতের লেখা। ওই ঘরের একটি চৌকি, আলনা, কাঠের বাক্স, কটা থালা, বাটি ও যৎসামান্য কাপড়চোপড় ছাড়া তেমন আর কিছু নেই। হতদরিদ্র এই পরিবারটিতে আনিকার জীবন যে খুব সুখের ছিল না তা চিরকুটের বাণীতে ফুটে উঠেছে। দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গি ও স্মার্ট আনিকার লেখা চিরকুটে অব্যক্ত বেদনা ও যাতনার করুণ বাণী। ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া লোকজন জানিয়েছেন, আনিকাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল শামীম। কিন্তু বিয়ের পর নানা কারণে তাদের দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়। আনিকার তুলনায় শামীম যথেষ্ট খাটো । তিনি মেয়েদের মতো লম্বা চুল রেখেছেন এবং পেছনে চুল বেঁধে রাখেন। যা আনিকার ছিল খুবই অপছন্দের। মহল্লায় শামীম একজন জুয়াড়ি ও নেশাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত। রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় জানা যায়, এ ঘটনায় শামীমকে আটক করে থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। মঙ্গলবার বিকেলে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট ওই রুমে রক্ত ছড়িয়ে আছে। একটিমাত্র চৌকি, বিছানা ওঠানো অবস্থায় ২/৩টি বালিশ পড়ে আছে। একটি টেবিলে ছোট ছোট হাঁড়ি-পাতিল, পানির বোতলসহ অন্যান্য তৈজসপত্র সাজানো-গোছানো রয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান, ওখানে নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। বেশিরভাগই গার্মেন্টস শ্রমিক। সকালে সবাই যে যার মতো কাজে চলে যায়। কাজ শেষে গভীর রাতে বাসায় ফেরে। তাই দুই সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর আত্মহত্যার ঘটনাটি কারও চোখে পড়েনি। দারুসসালাম থানার ওসি (তদন্ত) ফারুক বলেন, আনিকার স্বামী শামীম হোসেন সেলুনে কাজ করেন। সেই সেলুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গেছেন। তার কাছে মোবাইল নেই। সমাবেশ শেষে কিংবা খবর পেয়ে বাসায় ফিরলে তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওই বাড়ির ভাড়াটে সুমন বলেন, শামীম গত দুই বছর ধরে ওই বাসার একটি রুম ২২ শ’ টাকায় ভাড়া নেন। তার স্ত্রী চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। শামীমের সংসারে অভাব-অনটন লেগেইে থাকত। ইদানীং সে অন্য এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। মঙ্গলবার সকালেও ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে আনিকার গালে জোরে থাপ্পড় মারে শামীম। পরে তিনি সেলুনে চলে যান। তার পরই ঘটে যায় এই চরম মর্মান্তিক ঘটনা।
×