ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে কৃষি জমির ‘টপ সয়েল’ রক্ষায় উদ্যোগ নেই

ইটভাঁটিতে পুড়ছে পাঁচ কোটি সিএফটি মাটি

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৯ জানুয়ারি ২০১৭

ইটভাঁটিতে পুড়ছে পাঁচ কোটি সিএফটি মাটি

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ যশোরের ইটভাঁটি প্রতি মৌসুমে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৪২ কোটি পিচ ইট। এই ইট উৎপাদনের জন্য পোড়ানো হচ্ছে প্রায় ৫ কোটি সিএফটি মাটি। আর এই মাটির সিংহভাগই যোগান দিচ্ছে কৃষি জমি। ইটভাঁটি মালিক সমিতি, পরিবেশ অধিদফতর, কৃষি বিভাগ, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য উপাত্ত থেকে এ চিত্র উঠে এসেছে। কৃষি জমির সবচেয়ে মূল্যবান অংশ ‘টপ সয়েল’ হিসেবে পরিচিত এ মাটি ইটভাঁটিগুলোর পেটে গেলেও এ নিয়ে তেমন তাপ-উত্তাপ নেই কোন প্রতিষ্ঠানেরই। অথচ ইটভাঁটির সর্বশেষ আইন অনুযায়ী, কৃষি জমির মাটি ভাঁটিতে ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এভাবে কৃষি জমির টপ সয়েলের বিনাশ করা হলে ফসল উৎপাদনের ওপরে এর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর কৃষির এই হুমকির পাশাপাশি ইটভাঁটির পরিবেশ দূষণ নিয়েও রয়েছে উদ্বেগ। যশোর জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি জানায়, এ জেলায় ১৬৭টি ইটভাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে ১২০টির মতো জিগজ্যাগ ইটভাঁটি (হাওয়া ভাঁটি)। বাকিগুলোর মধ্যে কয়েকটি অটো এবং অবশিষ্ট ফিক্সড চিমনির। সবচেয়ে বেশি ৪০টি ইটভাঁটি রয়েছে যশোর সদর উপজেলায় এবং সবচেয়ে কম ৯টি কেশবপুর উপজেলায়। এছাড়া মনিরামপুরে ৩২টি, শার্শায় ২৩টি, ঝিকরগাছায় ২০টি, বাঘারপাড়ায় ১৮টি, চৌগাছায় ১৫টি ও অভয়নগরে ১০টি ইটভাঁটি রয়েছে। তবে সবগুলো চালু না থাকায় প্রতি মৌসুমে গড়ে ১৪০টির মতো ভাঁটি ইট উৎপাদন করে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে এই ইট উৎপাদনের সময়কাল ২০ থেকে ২২ সপ্তাহ। এ সময়ের মধ্যে কোন ইটভাঁটি ২০ লাখ আবার কোনটি ৬০ লাখ ইটও উৎপাদন করে থাকে। যশোর জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গড়ে ভাঁটি প্রতি ৩০ লাখ হিসেবে ধরলে যশোরের ১৪০টি ইটভাঁটি থেকে প্রতি মৌসুমে ৪২ কোটি পিচ ইট উৎপাদিত হয়। আর এজন্য প্রতিভাঁটতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ট্রাক মাটি দরকার হয়। প্রতি ট্রাকে ১০০ থেকে ১২০ সিএফটি মাটি হিসেবে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি সিএফটি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের মতে, এই জেলায় নদী, খাল, জলাশয় বা বিকল্প স্থান থেকে মাটি পাওয়ার সুযোগ কম থাকায় ওই মাটির সিংহভাগই ভাটি মালিকরা সংগ্রহ করেন কৃষি জমি থেকে। কৃষি জমির ওপর এই ‘আগ্রাসনে’ উদ্বেগ রয়েছে কৃষি বিভাগ ও মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এ জেলায় মোট আবাদী জমির পরিমাণ ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪১৬ হেক্টর। অথচ ৬ বছর আগে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪১৬ হেক্টর। অর্থাৎ ৬ বছরে আবাদী জমি কমেছে ৫ হাজার হেক্টর। এর একটি অংশ কৃষি জমির টপ সয়েল কেটে নেয়ার কারণে। যদিও টপ সয়েল কেটে নেয়ার পর সে জমিতে বাড়তি সার, কীটনাশক দিয়ে চাষাবাদ করেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোর’র উপ পরিচালক কাজী হাবিবুর রহমান বলেন, যশোরে কৃষি জমি থেকে টপ সয়েল কেটে নেয়ার একটি মারাত্মক প্রবণতা রয়েছে। মাটির সবচেয়ে উর্বর অংশ কৃষি জমি থেকে ভাঁটিতে চলে যাওয়ায় ফসল উৎপাদনের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। বাড়তি জৈব ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে কৃষক উৎপাদন ঠিক রাখতে চাইলেও তা সব সময় সম্ভব হয় না। উপরন্তু উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। যশোর মৃত্তিকা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাটির জৈব ও পুষ্টি উপাদান উপরিভাগের ৩ থেকে ৫ ইঞ্চির মধ্যে বিরাজমান। ফলে এই মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া যে, কি ভয়াবহ ক্ষতি তা কৃষকরা জানেন না। এ জন্য কোন কারণ ছাড়াই বা সামান্য কারণেও তারা মাটির উপরিভাগ ইটভাঁটিতে বিক্রি করে দিচ্ছেন। অথচ এই টপ সয়েল পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ১৫ থেকে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগে। তাই কৃষি জমি রক্ষায় কৃষকদের এই মারাত্মক প্রবণতা থেকে সরিয়ে আনা দরকার। জিএম মোস্তাফিজুর রহমান আরও উল্লেখ করেন, ‘কৃষিতে ইটভাঁটির প্রভাব’ বিষয়ে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ক্ষতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন সম্ভব হবে। কৃষি জমির টপ সয়েল নিয়ে এই উদ্বেগ সম্পর্কে ধারণা নেই কৃষকদের। তারা সামান্য প্রয়োজনে বা কোন প্রয়োজন ছাড়াই মাটির উপরিভাগ তুলে দিচ্ছেন ভাঁটি মালিকদের কাছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল ধারণা থেকেও তারা মাটি বিক্রি করছেন। ইটভাঁটিতে টপ সয়েল বিক্রি নিয়ে যশোর জেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর নিয়ে নানা চিত্র উঠে এসেছে। কোথাও কৃষককে বোঝানো হয়, তোমার জমি উঁচু, সেচের পানি নেমে যাবে, বোরো আবাদ হবে না। তাই উপর থেকে মাটি ভাঁটিতে বিক্রি করে দাও। কোথাও বলা হয়, উপরের মাটিতে ভাইরাস-ময়লা। উপরের মাটি বিক্রি করে নিচের ‘ভাল’ মাটিতে চাষ করলে ভাল ফসল হবে। এভাবেই নানাভাবে কৃষককে বিভ্রান্ত ও প্ররোচিত করা হয় টপ সয়েল বিক্রির জন্য। আর এ কাজে সক্রিয় রয়েছে ভাঁটিতে মাটি সরবরাহকারী কন্টাক্টররা। যশোর সদর উপজেলার দোগাছিয়া গ্রামের কৃষক জুলফিকার আলী বলেন, জমির ওপরের মাটিতে ময়লা-ভাইরাস থাকে। এজন্য তিনি ওপর থেকে মাটি ইটভাঁটিতে বিক্রি করে দিয়েছেন। আর একই গ্রামের কৃষক নিয়ামত আলী জানান, তার জমিটি আশপাশের জমি থেকে কিছুটা উঁচু। স্যালোমেশিন মালিক উঁচু জমিতে সেচের পানি দিতে চায় না। আবার উঁচু জমিতে পানি বেশিক্ষণ ধরেও রাখা যায় না। এজন্য তিনি ওপর থেকে মাটি বিক্রি করে ‘জমি সমান’ করছেন। অপর কৃষক আব্দুল ওয়াদুদও একই কারণে জমির মাটি বিক্রি করছেন উল্লেখ করে বলেন, মাটি কেটে নিলে কিছুটা ক্ষতি হয়, তিনি জানেন। সার-মাটি দিয়ে তা তিনি পুষিয়ে নেবেন। আর সদর উপজেলার হাটবিলা গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ ইটভাঁটিতে মাটি বিক্রি করেছেন কোন কারণ ছাড়াই। তিনি বলেন, ‘মাটির (ইটভাঁটির) কন্টাক্টর বলল, মাটি বিক্রি করলে কিছু টাকা পাওয়া যাবে, তাই ভাঁটির মাটি বিক্রি করেছি। দেড় বিঘা জমি (পৌনে এক একর) থেকে ৮০ টাকা দরে আড়াইশ’ ট্রাক মাটি বিক্রি করেছি ভাঁটিতে।’ কথা হয় পরিবেশ অধিদফতর যশোরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, যশোরে ১৩৮টি ভাঁটি সচল রয়েছে। এর সিংহভাগই জিগজ্যাগ। এই জেলার ইটভাঁটিগুলো কৃষি জমির মাটির ওপর নির্ভরশীল। আর অল্পকিছু ভাঁটি গোপনে কাঠও পুড়িয়ে থাকে। এজন্য তারা এই ভাঁটিগুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও খোঁজখবর রাখেন। অনিয়ম পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানাও করা হয়। এদিকে, কৃষি জমির ক্ষতির পাশাপাশি কাঠ-কয়লা পোড়ানোসহ বায়ুদূষণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি করছেও প্রচলিত ইটভাঁটিগুলো। এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সহায়তায় ‘প্রমোটিং সাসটেইনেবল বিল্ডিং ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রকল্পও কাজ শুরু করেছে। প্রকল্পের আওতায় প্রচলিত পোড়া ইটের পরিবর্তে ‘বিকল্প ইটের’ প্রযুক্তিও প্রচারের আলোয় আনছে।
×