ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম জিয়ার ভাষণ ও ষড়যন্ত্রের জাল -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৫ জানুয়ারি ২০১৭

বেগম জিয়ার ভাষণ ও ষড়যন্ত্রের জাল -স্বদেশ রায়

নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এক লাখের কাছাকাছি ভোট পাওয়ার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল বেগম জিয়ার ভাষা আবার পরিবর্তন হবে। দেশের রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরবে এমন একটা সম্ভাবনা স্বাভাবিকই এ ধরনের সুষ্ঠু নির্বাচনের পরে সাধারণত জাগে। কিন্তু যখন কোন দেশের একটি মূল রাজনৈতিক দল সন্ত্রাসী দল হয় তখন এ ধরনের চিন্তা করা ভুল। কারণ সন্ত্রাসীরা যখনই বুঝতে পারে তাদের একটা জনভিত্তি আছে তখনই তারা কোন না কোনভাবে হামলা চালায়। সারা বিশ্বে যে ইসলামিক সন্ত্রাস চলছে- দেখা যাবে, যখনই যে দেশে তারা কোন হামলা চালাচ্ছে তারা তাদের হামলা চালানোর মতো একটা জনভিত্তি- তা ওই দেশে হোক আর তার সীমান্তের কোন দেশে হোক পাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে, আফ্রিকার কিছু দেশে যে আইএস সন্ত্রাস চলছে, এর কিন্তু একটা ভাল জনভিত্তি আছে সেখানে। ভারতে যে মাঝে মাঝে সন্ত্রাসী হামলা হয়, এর কারণ ভারতের ভেতরও ওই ইসলামিক সন্ত্রাসীদের একটা জনভিত্তি আছে। আর পাকিস্তান যে বিশ্বসন্ত্রাসের মূল স্থান তার কারণ কিন্তু ওই দেশটিজুড়ে সন্ত্রাসীদের জনভিত্তি রয়েছে। এই যে আমাদের বাংলাদেশের ইসলামিক সন্ত্রাসীরা পশ্চিম বাংলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়; সেখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় এবং সেখান থেকে মাঝে মাঝে বাংলাদেশে এসে হামলা চালায়Ñ এর মূল কারণ সেখানে তাদের জনভিত্তি রয়েছে। যে বিশেষ এলাকাগুলোতে তারা অবস্থান করে ওই এলাকাগুলো তাদের আশ্রয় দেয়, তারা তাদের সমর্থন করে। পশ্চিমবঙ্গে এই জনভিত্তি কিন্তু সন্ত্রাসীদের আছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস চালানোর জন্য জনভিত্তি একটি বড় বিষয়। এই সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছর পূর্তিতে চল্লিশ দিন জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করে বিএনপি ব্যর্থ হওয়ার পরে, তারা বুঝতে পারে তাদের জনভিত্তি নেই। তাই দীর্ঘদিন দলটি অনেকটা চুপচাপ ছিল। তবে এটা ঠিক একের পর এক টার্গেট সন্ত্রাস তারা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু ক্রমেই তার সংখ্যা কমছিল। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের পর বিএনপি ও তার সহযোগীরা যে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছে তা বোঝা গেল ছাত্রদলের উদ্দেশ বেগম জিয়ার দেয়া ভাষণে। এই ভাষণে বেগম জিয়া আবার তার পূর্ব অবস্থানে ফিরে গেছেন। অর্থাৎ তিনি শুধু বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা এগুলো নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেননি, তিনি ছাত্রদলকে ভয়াবহ ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালে বেগম জিয়া তার এক ভাষণে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করার জন্য ছাত্রদলই যথেষ্ট। এবার তিনি তার ভাষণে বলেছেন, শুধু জনপ্রিয়তা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আরও অনেক কিছু করতে হয়। ছাত্রদল যেন সেগুলো করে। অর্থাৎ সন্ত্রাসসহ যা কিছু নৈরাজ্য করার দরকার সেগুলো যেন ছাত্রদল করে। বেগম জিয়া কীভাবে ক্ষমতায় যেতে চান তা মনে হয় এত দিনে দেশের মানুষ বুঝে গেছেন। বেগম জিয়া কোন মতেই একটি সুষ্ঠু বা স্বাভাবিক পথে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া বা তার ফল মেনে নেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নন। বেগম জিয়া চান যে কোনভাবে হোক নির্বাচনের আগে জয়লাভ করতে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়ে তিনি বিজয়ী হতে চান এবং বিজয়ী নেতা হিসেবে প্রশাসনসহ সব কিছু তার অনুকূলে নিয়ে ২০০১-এর লতিফুর রহমান মার্কা নির্বাচনের ভেতর দিয়ে তিনি ক্ষমতায় যেতে চান। নির্বাচনের আগে এই বিজয় ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তিনি ও তার সহযোগী জামায়াতে ইসলামী (যদিও এই দুই দলের এখন আর কোন পার্থক্য নেই) মিলে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে দেশে একের পর এক সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বসন্ত্রাসের কেন্দ্রস্থল পাকিস্তান ও তাদের অপারেশন কেন্দ্র আইএসআই বেগম জিয়াকে অর্থ ও তার লোকজনকে ট্রেনিং দিয়ে সহায়তা করছে। বেগম জিয়াকে যে আইএসআই টাকা দেয় সে কথা সে দেশের কোর্টেও বলা হয়েছে। ছাত্রদলের উদ্দেশে বেগম জিয়ার দেয়া ভাষণটির যারা পরিপূর্ণ অংশ শোনেননি, তারা ইউটিউব বা অন্যান্য সোশ্যাল মাধ্যমে শুনতে পারেন। তাহলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন দেশব্যাপী আরেকটি সন্ত্রাস চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বেগম জিয়া। শুধু প্রস্তুতি নয়, ইতোমধ্যে তার কাজ তারা শুরু করে দিয়েছেন। আর এদের কাজ কী সেটা ১৯৭২ থেকে এ দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। আর গত সাত বছর তারা কী কাজ নেই করেনি। এমনকি দেশে যাতে বিদেশী বিনিয়োগ না হয় এ জন্য হলি আর্টিজান পর্যন্ত এ দেশে ঘটেছে। দেশে হলি আর্টিজান ঘটেছে। তারপর থেকে সরকার অনেক জঙ্গী আস্তানা সফলভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সত্য হলো হলি আর্টিজানের অস্ত্র ও গোলাবারুদ কোন্ পথে গেল তা কিন্তু এখনও পরিষ্কার হয়নি। গুলশানে শুধুমাত্র ভিআইপি গাড়ি আর ডিপ্লোম্যাটদের গাড়ি চেক হয় না। কোন ভিআইপির বাসা ওই হলি আর্টিজানের কাছে, কোন বিদেশী দূতাবাস তার কাছাকাছি এগুলো নিয়ে কিন্তু কোন তদন্ত হয়নি। তাই জঙ্গীরা ধরা পড়লেও জঙ্গীদের হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তারা রাজনীতিক হিসেবে সমাজের সবখানে সম্মানিত হচ্ছে। সরকার তাদের মুখোশ খুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। সরকার তাদের মুখোশ খুলতে ব্যর্থ হচ্ছে মূলত সরকারী দলের ব্যর্থতার কারণে। কারণ কোন দল ক্ষমতায় থাকলে প্রশাসনকে ওই দল সহায়তা করে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জন্য দুর্ভাগ্য হলো এদের বড় একটি অংশ জামায়াত ও বিএনপির টাকার কাছে বিক্রি হয়ে আছে। তাই দলের কাছ থেকে প্রশাসনের যে সহায়তা পাওয়ার কথা তা পাচ্ছে না। যে কারণে সবাই বলেন, শেখ হাসিনা অনেকটা নিঃসঙ্গ শেরপা। যা হোক, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের পরে বিএনপি ধরে নিয়েছে তাদের ভাল জনভিত্তি আছে। এখন যদি একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বা সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে তারা সরকারের পতন ঘটাতে পারে তাহলে আগামী নির্বাচনে তারা বিপুলভাবে জয়লাভ করবে। আর এ কারণে তারা এখন মরিয়া। বেগম জিয়ার ছাত্রদলের উদ্দেশে দেয়া ভাষণটি ছিল মূলত তার দলকে (বিশেষ করে ছাত্রদল, যুবদল ও জামায়াতের কর্মীদের) নির্দেশ দেয়া। সে কাজটি বেগম জিয়া করেছেন। তিনি লিটনকে নিয়ে মায়াকান্না কেঁদেছেন। মাছের মায়ের যখন পুত্রশোক হয় তখন কিন্তু জাতিকে ভাবতে হয়। লিটন হত্যা একটি বড় ইঙ্গিত। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত-বিএনপি নির্দিষ্টসংখ্যক আসন নিশ্চিত করার জন্য শুধু এমপি নয়, ওই এলাকার প্রগতিশীল রাজনীতিকদের হত্যা করার পরিকল্পনা নিয়েছে কিনা তা এখন গভীরভাবে খোঁজ নেয়া দরকার। কারণ হত্যা ও ষড়যন্ত্র যাদের রাজনীতির মূল উৎস তারা যে শুধু মূল ব্যক্তিকে হত্যা করবে তা কিন্তু নয়। তারা নানান পথ নেবে। যেমন উদীয়মান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তারা দেশের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। দেশে এখন প্রগতিশীল চিন্তা প্রায় বন্ধ। বাংলা একাডেমি পর্যন্ত এখন প্রতিক্রিয়াশীলদের মতে চলতে চায়। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অপরাধে স্টল বরাদ্দ বন্ধ করে। এখানে একক কারও কোন দোষ নেই। সমাজ যে এখন ভীতসন্ত্রস্ত এটা তারই প্রমাণ। ঠিক তেমনিভাবে লিটন হত্যার দুই দিন না যেতেই গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লেগেছে। আমাদের উত্তরের মেয়র অত্যন্ত সজ্জন ও সরল ব্যক্তি। সন্ত্রাসীদের কূটকৌশল তো দূরে থাকুক রাজনৈতিক কূটকৌশলের বাইরের একজন মানুষ তিনি। তাই তিনি বলেছেন, শর্ট সার্কিট হতে পারে। কিন্তু মার্কেট কমিটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এটা স্যাবোটাজ। কয়েক দিন আগে সন্দেহভাজন কয়েক তরুণকে সেখানে ঘুরতে দেখা গেছে। তারা গান পাউডার দিয়ে এ কাজ করছে কিনা সেটা তাদের সন্দেহ। সাঈদীর রায়ের পরে জামায়াত-বিএনপি কর্মীদের হাতে এই গানপাউডার দেশের মানুষ দেখেছে। তারা দেখেছে কীভাবে বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে শুরু করে উপজেলা অফিস অবধি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই সরকারের কোন উপায় নেই ডিএনসিসি মার্কেটের আগুনে গানপাউডারের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া। সর্বোপরি, ১ জানুয়ারি বেগম জিয়ার দেয়া ভাষণের পর সরকারের এখন সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়া উচিত। তারা ওই ভাষণকে ধরে নিতে পারেন, বেগম জিয়া তার কর্মীদের আবার সন্ত্রাস করার নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ আগামী নির্বাচনের আর মাত্র দুই বছর বাকি এ সময়ে সন্ত্রাসসহ নানা ষড়যন্ত্র চলবে। সরকারের প্রশাসনকে নষ্ট করার জন্য এক ব্যক্তি ইতোমধ্যে তার সর্বোচ্চ আসনের ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। তিনি যে কাদের হয়ে করছেন তা কিন্তু সিলেটের একটি রেস্ট হাউসে সাইফুর রহমানের ছেলের ড্রাইভ করা টুকটুকের ছবিটি আবারও প্রমাণ দেয়। ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া এ ছবি ব্রেক করেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলও নিশ্চয়ই এ ছবি নিয়ে খোঁজখবর নেবেন। বিষয়টি হাল্কাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই বেগম জিয়ার ভাষণ, সিলেটের ছবি- সবই এক সূত্রে গাঁথা। ষড়যন্ত্রের জাল তাই অনেক গভীরে। [email protected]
×