ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

ভিয়েতনামের শিক্ষা ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তা

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬

ভিয়েতনামের শিক্ষা ও শেখ হাসিনার দৃঢ়তা

ভিয়েতনাম এসে আমি একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝেছি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যতই শক্তিশালী হোক না কেন আমরা তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারিনি। আমাদের দেশের অন্যতম বড় দল নামে পরিচিত বিএনপি আমাদের জাতীয় ঐক্য ও চেতনার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এখানে আসার ইচ্ছে ছিল অনেকদিনের। সেই হো চি মিন, সেই ভিয়েতনাম, সেই আমেরিকা। আমাদের যুদ্ধের মতো ভয়াবহ অথচ দীর্ঘ এক ইতিহাস। আমাদের চেয়ে দুঃখ-কষ্ট-বেদনা অনেক বেশি এদের। সরাসরি লড়াই হয়েছিল আমেরিকান সৈন্যদের সঙ্গে। সঙ্গে ছিল সাউথ ভিয়েতনামের দালালরা। আজ এত বছর পর এখানে এসে দেখি বিজয়ীর ইতিহাস মাথা পেতে নিয়েছে বিজিতরা। মনে যা ছিল তা বলার সুযোগ পায়নি। মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছে সায়গনের পরিবর্তিত নাম। হো চি মিন সিটির নাম পাল্টানোর কথা স্বপ্নেও ভাবে না কেউ। উত্তর ও সাউথ ভিয়েতনামের ভেতর এখনো বিবাদের বীজ আছে। কিন্তু একদেশ এক জাতির ব্যাপারে দ্বিমত নেই। শুধু তাই নয়, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে ভিয়েতনাম। হ্যানয়ে আমাদের গাইড মেয়েটি ছিল উত্তরের। আর হো চি মিন সিটির যুবক গাইড সেখানকার। দু’জনে দু’ধরনের কথা। একজন বলছে, উত্তরের ভূমিকা এখনও সদাচারের এখনও তারাই ধরে আছে এদেশের প্রাণ। অন্যদিকে সাউথের লোকরা ভেতরে আমেরিকার জন্য দুর্বল হলেও জাতীয় স্বার্থে ঐক্য আর সমঝোতায় বিশ্বাসী। তাদের মনে হেরে যাবার যে দুঃখ ও রাগ ছিল এদ্দিনে তা প্রশমিত হয়ে গেছে। এত বছর পরও ওবামা স্বয়ং এদেশে এসে তাদের কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে যায়। ভিয়েতনামীরাও আজ অনেক উদার। আমাদের উত্তর ভিয়েতনাম অন্তপ্রাণের গাইড স্বীকার করল চীনের রাষ্ট্রপতির আগমন তারা মুখে মুখে পছন্দ করলেও আসলে ওবামাকে পেয়েই তাদের আনন্দ বেড়েছিল। কারণ, একদিকে যেমন শত্রুর মুখে বিপ্লবের জয়গান আরেক দিকে আধুনিক বিশ্বে সবার সঙ্গে থাকা ও দুশমনি ভুলে এগুনোর চেষ্টায় কামিয়াব হওয়া। খেয়াল করুন আমরাও তা করেছি। এই সেদিন জন কেরি এসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। লিখে গেছেন তাঁদের পরিবর্তিত চিন্তা ও বাংলাদেশ বিষয়ক নতুন ভাবনা। আওয়ামী লীগের এই অর্জন এই কৃতিত্ব নষ্টের জন্য বিএনপি যত ধরনের অপচেষ্টা করুক না কেন তারা কখনও সার্থক হতে পারেনি। অতীতে তারা এদেশের দেশ প্রহরীকে জাতির পিতার সমান করতে চেয়েছিল। ইতিহাসকে নানাভাবে ছুরিকাঘাত করে রক্তাক্ত করলেও তার জবাব দিতে দেরি করেনি ইতিহাস। সময় তাদের এমন কোণঠাসা করেছে যে, আজ জামায়াত একটি নিষিদ্ধ হবার পথের দল আর বিএনপি মাজাভাঙ্গা। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমরা ইতিহাস ও দুশমন কারও প্রতি সুবিচার করতে পারিনি। আমাদের পদে পদে ভুলের কারণে বিজয় হয়ে গেছিল হাতছাড়া, ভিয়েতনামের মতো সংহতি আর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগেই রাজাকাররা চলে এসেছিলো দেশ শাসনে। আজ শেখ হাসিনার বলিষ্ঠতার ফলও কি হাতছাড়া হয়ে যাবে? মাঝে মাঝে নিজেকে বড় বেকুব মনে হয়। রাজনীতিবিদরা আমাদের যে কতকিছু শেখান, আমরা অধম বলে বুঝতে পারি না। দেশে এখন আসলে কোন রাজনীতি নেই। দলও নেই। আমি এ লেখাটি লিখছি ভিয়েতনামের হোয়েন শহর থেকে। যেখানে লোকাল পাবলিকের চাইতে ট্যুরিস্ট বেশি। আর এখানে কেউ কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে কোন দলের নামও শোনেনি। আমরা অবশ্য পোশাকি গণতন্ত্রে এদের চাইতে আগুয়ান। দেশে রাজনীতি না থাকলেও দলের অভাব নেই। একজন বা দু’জন নির্ভর দলের নেতারাও অলি হয়ে ফুলের মধু খেতে রাষ্ট্রপতির কাছে দৌড়ায়। আমরা এদের মতো বিদেশী বা নিজ দেশ-জাতিকে নিরাপত্তা দিতে না পারলেও গণতন্ত্রের লেবাসে ভাল আছি, সুখে আছি। না থাকলেও আছি বলে মেনে নিই। যে কথা বলছিলাম, ক’বছর ধরে দেশে মহাজোট সরকারের শাসন চললেও আমরা শেখ হাসিনার বিকল্প দেখছি না। তার দৃঢ়তা আর সাহস না থাকলে এদেশ জঙ্গীদের সেফ হেভেন হতে পারত! হতে পারত অর্ধশিক্ষিত যুবরাজের খেয়াল খুশির দেশ। ফলে উপযুক্ত বিকল্প ও সঠিক দলের বাইরে এখন আমরা পা ফেলতে চাই না। সে সরকার উৎখাত ও লাশ ফেলার কথোপকথনে ধরা খাওয়া নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও মূলত জাসদ-বাসদের নামে জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু বিরোধী ভোটে বিজয়ী নেতা। একসময় উপায় না দেখে সুশীল হবার চেষ্টায় লীগের বিরুদ্ধে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। এবারের অভিযোগ ছিল সাংঘাতিক। সে বিচার এখনও শেষ হয়নি। মামলাও খারিজ হয়নি। জামিনে মুক্ত মান্নাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাতে গেছিলেন সরকারী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তাহলে কি এই সরকার উৎখাতটা দোষের কিছু না? না মান্নার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা? এর যে কোন একটা হতেই হবে। তা না হলে ফুল দিয়ে আসামি বরণের দরকার পড়ল কি কারণে? ওবায়দুল কাদের বলছেন অতীতের কথা। তাদের অতীত রাজনীতির জীবন কি মধুময় ছিল? না বন্ধুত্বের? আমাদের যৌবনে আমরা যা দেখেছি তার নাম তিক্ততা আর মারামারি। আজ সে অতীত দুধের মতো সাদা হয়ে গেল কীভাবে? মূল বিষয়টা গোলমেলে। বিএনপির মহাসচিব যাকে ফুল দিয়ে বরণ করলেন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারিও তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানালেন, তো সে বেচারী এতদিন জেল খাটলেন কার অপরাধে? বলেছি না? রাজনীতিবিদরা আমাদের প্রায়ই মনে করিয়ে দেন, আমরা আসলে ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা। অকারণে ফাল পাড়ি। ফালের রাজনীতি ও ভুলের রাজনীতির তফাৎ বুঝব কবে? না এদেশে তা কোনদিনও সম্ভব হবে না? ভিয়েতনামের ইতিহাসের কোন পর্যায়ে দেশবিরোধী বা স্বাধীনতা বিরোধীদের সে সুযোগ দেয়নি। দলে দলে ভিয়েতনামী রাজাকার আমেরিকা বা পাশ্চাত্য দেশে বসবাস করলেও তারা আমাদের রাজাকারদের মতো দেশবিরোধী কাজে জড়িত হতে পারেনি। কারণ, দেশের বামদল ও নেতারা সে সুযোগ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আজ এরা বিদেশ থেকে দেশে আসে বিনিয়োগ করতে বা পর্যটক হয়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও তাদের পরাজয়কে তারা না মানলেও টুঁ শব্দ করে না কারণ বিজয়ীর ইতিহাসের ওপর আর কোন সত্য নেই, থাকে না। আমাদের রাজনীতি বারবার চোরাপথে পথ হারায়। তার গলি ঘুপচি এদেশে বারংবার মোশতাকের জন্ম দেয়। মান্নার মতো নেতারা আওয়ামী লীগ বা স্বাধীনতার ধ্বজাধারী একটি মাত্র কারণে তা হলো পাওয়ারে যাওয়া। এদের সঙ্গে আছে পুরনো ও নব্য রাজাকারের দল। এদের দমন না করলে আমরা ভিয়েতনামের ছায়াও হতে পারব না। এককালে আমরা সেøাগান দিতাম বাংলা হবে ভিয়েতনাম। আজকে দালালেরা শিখিয়েছে বাংলা হবে আফগান। এই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাখতে না পারলে কেউ নিরাপদ থাকতে পারবে না। ভিয়েতনাম আমাদের সেটাই বলছে বারবার। যুদ্ধপরবর্তী দেশে দেশ শাসনে কঠোর হবার বিকল্প নেই। শেখ হাসিনা তাই করছেন, কিন্তু বাকিরা?
×