ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

বালটিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

(পূর্ব প্রকাশের পর) ড. চিত্তরঞ্জন দাশ সুইডেনের রাজধানী শহর স্কটহোম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই স্টকহোম শহরে যতবারই আসার সুযোগ হয়েছে ততবারই এই শহরকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পেয়েছি। লেক, সরোবর, অসংখ্য বে দ্বারা পরিবেষ্টিত সবুজ বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ ছোট বড় দ্বীপগুলির নান্দনিক সৌন্দর্য রাজধানী শহরটাকে বহুমাত্রিক রূপে সাজিয়ে রেখেছে। কোনটি পাহাড়ের চূড়ায় আবার কোনটি জলাধারের সমন্তারালে লুকোচুরি খেলায় মগ্ন। এরই মাঝে গড়ে তোলা হয়েছে, বিলাসী সৌধ। অর্থবিত্ততে যারা বৃত্তশালী, বিলাসী জীবন যাপন যাদের জন্য আশীর্বাদ একমাত্র তারাই এই সব দ্বীপপুঞ্জে প্রকৃতির অপার মহিমায় মহিম্মানিত হয়ে গড়ে তুলেছে নিজ নিজ বিলাসী আবাসস্থল। কিসের অভাব তাদের, কিই বা নেই সেখানে? স্টকহোমের কথা মনে পড়লে সবার আগে মনে হবে আলফ্রেড নোবেলের কথা। যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আশাায় সারা পৃথিবীর জ্ঞানী, গুণী, গবেষক ও প-িত ব্যক্তিরা অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন কখন তাদের সাধনায় সিদ্ধি লাভ হবে কখন সেই মহেন্দ্রক্ষণ আসবে। আলফ্রেড নোবেলের জন্ম ২১ অক্টোবর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটহোমে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১০ ডিসেম্বর ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে। তিনি একাধারে ছিলেন রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, আবিষ্কারক এবং বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয় অস্ত্রের উদ্ভাবক ও প্রস্তুতকারক। যার মধ্যে সব থেকে পৃথিবীব্যাপী সাড়া জাগান বিখ্যাত আবিষ্কার হল ডিনামাইড। ঝরষলধ ঝবৎবহফধফব লাইনের যে প্রমোদ তরীতে আমাদের যাত্রী হওয়ার কথা সেটির যাত্রা শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময় বিকাল পাঁচটায়। যতই সময়টা কাছে আসতে লাগল মনের গভীরে কেমন যেন একটা উত্তেজনা অনুভব করতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে কোন রকম দ্বিধান্বিত না হয়েই বলা যেতে পারে যে, কম তো ঘোরা হলো না এই অর্ধ শতাব্দীরও অধিক বয়সকালে। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা অন্য যে কোন ভ্রমণ থেকে ভিন্ন। নৌযানে করে পাড়ি দিতে হবে বালটিক সাগর। আর এইটি এমন একটি নৌযান যে যান সম্পর্কে শুধু গল্পই শুনেছি দেখার সৌভাগ্য আজই হতে যাচ্ছে। সে কারণেই একটা ভিন্ন মাত্রার উত্তেজনা অনুভব করছি। ডাঃ উৎপল বাবুদের বাড়ি থেকে আন্ডারগ্রাউ- ট্রেনে করে টারমিনাল যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগার কথা। যথেষ্ট সময় হাতে নিয়েই আমরা তিন পরিবারের দশজন যাত্রী যাত্রা শুরু করলাম। বাড়ি থেকে নিকটতম স্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দাদার ছোট কন্যা নোয়া। কারণ সে আমাদের সঙ্গী হচ্ছে না পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকার কারণে। তবে সে ভাল ড্রাইভার। অগ্রগামী দলে আমরা আগেই স্টেশনে পৌছে অপেক্ষা করতে থাকলাম বাকিদের জন্য। ট্রেনে চড়ে বুঝতে বাকি রইল না যে, যাত্রীদের প্রায় সকলেরই গন্তব্য অভিন্ন। সেটি আরও পরিষ্কার হয়ে গেল যখন ট্রেন থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম তখন। এই প্রমোদতরীর ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই। তবে পূর্বে যে ধারণাই থাকুক না কেন, সেটা যে সঠিক নয় সেটা বুঝতে পারলাম যখন দেখলাম চতুরদিক থেকে পিপড়ার মতো সারি দিয়ে ভিন্ন বয়সের তরুণ তরুণী, বয়স্করা যুগল বন্দী হয়ে, কেউ বা হ্যানিমুন, কেউ বা ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে ছুটি কাটাতে টারমিনাল অভিমুখে পদ সঞ্চালন করে চলেছে। বয়স্ক যুগলদের সংখ্যা নিহায়ত কম নয়। আমরা যখন টারমিনাল পৌঁছালাম তখন সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তরীতে প্রবেশের জন্য। ডাঃ দিশাখী (তোয়া) আমাদের টিম লিডার। টিম লিডার সবিনয়ে আমাদের একখানে দাঁড়াতে অনুরোধ করে চলে গেল, মেশিন থেকে তরীতে প্রবেশের প্রয়োজনীয় টিকিট সংগ্রহ করতে। অন লাইনে টিকিট কাটার সময়ে প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়েছিল। যে যার টিকিট হাতে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে একটার পর একটা বৈতরণী পার হয়ে প্রধান ফটকে এসে দেখা গেল চলন্ত বৈদ্যুতিক সিঁড়িতে করে সবাই বিশাল আকৃতির প্রমোদ তরীতে প্রবেশ করছে। ভিতরে প্রবেশ করেই দেখলাম বড় করে লেখা আছে ৭ঃয ঋষড়ড়ৎ. আর এটি যে জাহাজ সেটা বোঝার কোন উপায় নেই, মনে হলো যেন কোন শপিং কমপ্লেক্সে এসে পড়লাম। ডেভিড বা ক্রেডিট কার্ডের অনুরূপ কার্ডটিতে রুম নং লেখা ছিল ১১১৬ এবং ১১ তম তলায় এর অবস্থান। পূনরায় লিফটের সাহায্য নিয়ে রুম খুঁজে পেতে তেমন কোন সমস্যা হলো না। তবে বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, এই টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে রুমে পৌঁছান পর্যন্ত কোন মানুষের সাক্ষাৎ মিলল না। সবই ঘটে গেল অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় টেকনোলজির কৃপায়। একই বলে ডিজিটাল! বিলাসিতার ছোঁয়া লেগে আছে সারা ঘরটাতে। থ্রি স্টার ফোর স্টার হোটেলের অনুরূপ সাঝে সাজিয়ে রাখা আছে এর প্রতিটি আসবাব পত্র। সোফার সামনে টি টেবিলটাতে কোন এক রমণীর কোমল হাতের স্পর্শে পরম মমতায় রাখা এক গোছা ফুল, ডালি ভরা নানা রকমের ফল আর রকমারি চকলেট। হরেক রকমের পাণীয়তে সাজান মিনি বার। চা, কফির সরজ্ঞাম তো আছেই। সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো রুমটির অবস্থান। প্রায় রুমটির সমান আকৃতির স্বচ্ছ কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের ও সাগর বক্ষের যে মোহনীয় দৃশ্যাবলী অবলোকন করা যাবে সেটা ভাবতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হলো, অবাক হলাম এর বিশালত্ব দেখে। এখন কাজ হলো সারা প্রমোদতরীটি ঘুরে ঘুরে দেখা। দু’জনে মিলে বেরিয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম দুই পরিবারের পারিবারিক প্রমোদ ভ্রমণে কোন রকম বিঘœ না ঘটিয়ে আমরা আমাদের মতো করেই চলাফেরা করব কিন্তু তা আর হলো না, বের হয়েই দেখি সদলবলে দরজায় হাজির। সকলে মিলে হ্যানিমুন স্যুট দেখতে এসছেন। রুমে আপ্যায়নের সকল আয়োজন বর্তমান। আমাদের আর অপ্যায়ন করার প্রয়োজন হলো না। যে যার মতো করে অ্যাপায়িত হলেন। তারপর বেরিয়ে পড়লাম সকলে মিলে বিলাসী তরীতে বিলাসী পদচারণায়। একমাত্র ডাঃ পাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ক্রুজ শিপের অভিজ্ঞতটা ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন মাত্রায় সমৃদ্ধ আর অন্যদের মধ্যে মিঃ অনুপ পাল, তার সহধর্মিণী সুতপা, কন্যা বৃন্দা ও পূত্র অনিলসহ আমরা দু’জন আনকোরা নতুন। টাইটানিকের বিশালত্ব, এর ভিতরের রোমাঞ্চকর অনুভূতি, রোজ আর জ্যাকের রোমান্টিক অভিনয় এবং টাইটানিকের করুণ পরিণতির কথা সারা দুনিয়ার সচেতন মানুষরা জানে না এমন লোকের সংখ্যা নিশ্চয় খুব বেশি হবে না। টাইটানিক যখন তৈরি করা হয় সেই ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে, সেই সময় টাইটানিক ছিল সে যাবত কালের সব থেকে বৃহৎ এবং আধুনিক প্রমোদ তরী। টাইটানিক, যাত্রা শুরু করেছিল ব্রিটেনের সাউথহ্যাম্পটন থেকে। গন্তব্য ছিল নিউইয়র্ক। পাড়ি দিতে হবে নর্থ আটলান্টিকের তিন হাজার আটশ’ মাইল। যাত্রীদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজকীয় পরিবারের সদস্য থেকে ধর্নাঢ্য ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্য। টাইটানিকের যাত্রী হতে পেরে এর যাত্রীদের মধ্যে একটা বাড়তি উত্তেজনা এবং গর্বেরও সীমা ছিল না। তেমনি গর্বের কমতি ছিল না এর ক্যাপ্টেন ও ক্রুদেরও। নিউইয়র্ক থেকে চারশ’ মাইল দূরে বিশাল আকৃতির আইস বারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সকল দম্ভ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। (চলবে)
×