ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সৌম্য সালেক

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ॥ কম্পিত স্বরের মূর্ছনা

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা ॥ কম্পিত স্বরের মূর্ছনা

উনিশ শ’ একাত্তরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিল বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম আলোকিত অধ্যায়। তবে এ সংগ্রামের পেছনে রয়েছে বহুযুগের শোষণ, অপমান, বৈষম্য ও বঞ্চনার করুণ রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তান পর্বের ২৪ বছরের ইতিহাস অনিয়ম, বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়নের আস্তরণে ঢাকা। অবশ্য বাঙালীর ক্ষীণতা ও অনধিকারের ইতিহাস আরও দীর্ঘকালের বিভিন্ন অন্যায্য শাসনের করুণ কথাকতায় পূর্ণ। তবে বাঙালী ভীতু এই জনশ্রুতিকে একাত্তরে আমরা সাহসের বীরমন্ত্রে লঙ্ঘন করতে পেরেছি; সেই ধ্বনি সুকান্তের কণ্ঠে শোনা যাক- ‘একবার মরে ভুলে গেছে আজ মৃত্যুর ভয় তারা’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনী যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল তা যেমন বিরল তেমনি বর্ণনাতীত। নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে জাতিসত্তাকে তথা মাতৃভূমিকে বাঁচাবার জন্য বাঙালী সেদিন প্রাণপণ লড়েছিল আর তাদের মাতৃপ্রেমকে শাণিত করতে ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তসহ সমকালীন কবি ও শিল্পীদের নিরন্তর প্রচেষ্টা। এ সার্বিক প্রচেষ্টায় আমরা সফল হয়েছি এবং আজ উদযাপন করছি তারই লব্ধ-সুফল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পটভূমি। একই সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে রাষ্ট্রিক পরিচয় বহনেরও আঁতুরঘর। পুরনো প্রতিবেশ ভাবনা থেকে নতুন আলোয় নতুন আয়তনে নিজকে দাঁড় করাবারও সূতিকাগার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই স্বাভাবিক অনিবার্যতায় আমাদের শিল্প-সাহিত্যে, কবিতায়, সংগীতে এর উপস্থিতি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং গুরুত্ববহ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যেমন মুক্তিকামীদের উৎসাহিতকরণে ও দৃশ্যপট বর্ণনা করে কবিতা এবং সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে সেই ধারা আজও সক্রিয়ভাবে সচল রয়েছে। কেউ কেউ মন্তব্য করে থাকেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত কবিতায়, শিল্পের প্রয়োজনের তুলনায় সময়ের প্রয়োজন অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। এ বিষয়ে বলতে চাইÑ সময় যদি অনুভূতিকে আক্রান্ত করে, শিল্প সৃষ্টির সেটাই কি মহার্ঘ মুহূর্ত নয়! মুক্তিযুদ্ধের কবিতামালায় যুদ্ধের ঘনিষ্ঠ বর্ণনার পাশাপাশি উঠে এসেছে গোটা বাংলাদেশের প্রকৃতি ও ভূগোলের অবিচ্ছিন্ন রূপরেখা, যার মর্মমূলজুড়ে রয়েছে মাতৃভূমির প্রতি মমতা, প্রেম ও ভালবাসায় এককার এক মহাচিত্র। বিভিন্ন কবিদের বর্ণনা ও গ্রন্থণা থেকে সেই মহাচিত্রের সামান্যই আমরা তুলে আনতে সক্ষম। আমরা কবি জসীম উদ্দীনের কবিতায় পাই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাহসের সমাচার, যিনি দেশকে দস্যুবিহীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- ‘আমি চলিয়াছি চির-নির্ভীক অবহেলি সব কিছু নরমু-ের ঢেলা ছড়াইয়া পশ্চাত-পথ পিছু।’ এক অনলবর্শী বর্ণনায় ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতায় কবি সিকান্দর আবু জাফরের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে প্রতিবাদের প্রবল উচ্চারণÑ ‘রক্ত চোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া/ আমার বছরগুলো আজকে যখন হাতের মুঠোয়/ কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী ছুরি কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে/ কেউটে সাপের ঝাঁপি আমার হাতেই নিলাম আমার/ নির্ভরতার চাবি/ তুমি আমার আকাশ থেকে সরাও তোমার ছায়া/ তুমি বাংলা ছাড়ো।’ মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে সবচেয়ে বেশি সফল কবিতা লিখেছেন কবি শামসুর রহমান। সম্পত্তি, পথের কুকুর, তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি-সহ তাঁর রচিত আরও অনেক কবিতাই আজ মুখে মুখে চর্চিত। তিনি ‘গেরিলা’ শিরোনামের কবিতায় মুক্তিকামীর অবয়ব অঙ্কন করেছেন এক অভিনব বাক্মহিমায়Ñ ‘দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে কুলুজি তোমার আঁতিপাতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্নতন্ন করে খোঁজে প্রতিঘর। পারলে নীলিমা চিরে বের করত তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে। অসাধারণ বীরব্যঞ্জনায় কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আমাদের শুনিয়েছেন পূর্ব পুরুষের কিংবদন্তি। ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ কবিতাটিতে হাজার বছরের বাঙালীর নির্মম ও করুণ ইতিহাসের সাথে সাথে যেনো উঠে এসেছে সমগ্র মানব জাতির অনধিকার ও বঞ্চনার ইতিহাস, আমরা সামান্য পাঠ নিচ্ছি- ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল। তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন... যখন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করল তখন আমরা প্রাচীন সঙ্গীতের মতো ঋজু এবং সংহত হলাম। পর্বতশৃঙ্গের মতো মহাকাশকে স্পর্শ করলাম দিকচক্রবালের মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে সমূলে উৎপাটিত করলাম।’ কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় শত শত মৃত্যু ও কান্নার কলরোলের মাঝে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভীক পথচলার ধ্বনি। মধ্যরাতের স্তব্ধতা ভেঙে উঠে আসছে গুলির শব্দ, একের পর এক চলছে কবর খোঁড়া তবুও বাবুই পাখির মতো স্বপ্ন বুনতে ছিল কিছু মানুষ; এমন স্বপ্ন ও মৃত্যুর মাঝে কবির কলম থাকে ওঠে আসেÑ ‘যখন কবর খোঁড়া হচ্ছিল/ প্রতীক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছিল/ বাবুই তখনো ব্যস্ত ছিল/ তার চঞ্চল ঠোঁটে ছিল অমর তন্তু/ কী সূক্ষ্ম, কী পেলব/ কী অপরাজেয়।’ দেশমাতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিতে বীরযোদ্ধাদের একটুও দ্বিধা ছিল না, ছিল না এতটুকু ভীতি, বীরবাঙালীর এই বলিষ্ঠ চেতনাই বিজয় অর্জনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সেই দীপ্ত-চেতনার উজ্জ্বল গ্রন্থনা ফুটে ওঠে কবি আল মাহমুদের কবিতায়, তাঁরÑ ‘অসহ্য সময় কাটে’ শিরোণামের কবিতার কিঞ্চিৎ পাঠ নিচ্ছিÑ ‘আমিও অন্তরঙ্গ হয়ে যাই হঠাৎ তখন/ জনতার সমুদ্রের সাথে/ বাঘের হাতের মতো সনখ শপথ/ সোহাগের গাঢ় ইচ্ছা নিয়ে/ নেমে আসে মনের ওপর। / নির্মম আদর পেয়ে আমিও রক্তাক্ত হব বরকতের শরীরের মতো?’ ‘বারবারা বিডলার-কে’ শিরোনামের কবিতায় বারবারাকে অনুভূতি লিখতে গিয়ে কবি আসাদ চৌধুরীর শব্দমালায় ওঠে আসে ‘ইয়াহিয়া খা’ নামে এক জল্লাদের প্রতিচ্ছবিসহ ‘সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে’ বাঁচাতে কবির অমোঘ আহ্বানÑ ‘বারবারা এসো/ রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই/ বিবেকের জং ধরা দরজায় প্রবল করাঘাত করি/ অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুব্ধ হই, সংগঠিত হই/ ছাত্রপত্রহীন সূর্যকিরণকে বিষাক্ত করার পূর্র্বে/ এসো বারবারা, বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।’ বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন কোলাজে কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় ওঠে এসেছে অশ্রু ও মৃত্যুর রক্তকাহিনী আর সেই সাথে বিচার প্রাপ্তির অশান্ত কামনা, ‘যদি সত্য হয়’ কবিতা থেকেÑ ‘যদি সত্য হয় জল, মোমেনার মার চোখ ভেঙে দরিয়ার নোনা ঢল/ মহুয়ার বুকে বিদ্ধ ছোরা/ দৃষ্টির পাথর গলে ছিটকে-আসা বহু বহু যুগ জমানো মাটির খাদে খানখান হিম নিস্তব্ধতা/... নিশ্চয় বিচার হবে, যদি সত্য, কলিজার উম।’ কবিতায় বাককৌশলের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশগুণে আদৃত নির্মলেন্দু গুণের কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণেই মূলত স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ধ্বনিত হয়েছে; সেই ভাষণের অন্তরীণ উত্তেজনা ও আকাক্সক্ষা দারুণ বাক্নৈপুণ্যে প্রকাশ পেয়েছে কবিরÑ ‘স্বাধীনতা শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায়Ñ ‘হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি/ শিশুপার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে/ তুমি একদিন সব জানতে পারবেÑ আমি তোমাদের কথা ভেবে/ লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।’ মুক্তি ও প্রতিশোধের চেতনাদীপ্ত এক বজ্র-বিদ্যুত বর্ণনা আমরা খুঁজে পাই কবি অসীম সাহার ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মঘাতী রক্তপাত’ শিরোনামের কবিতায়- ‘শুধু প্রয়োজন প্রতিটি ঐতিহাসিক রক্তবিন্দুর কাছ থেকে/ মানুষের সভ্যতার ইতিহাস জেনে নেওয়া/ আমি সেই রক্তবিন্দু থেকে সম্মুখের ইতিহাস অবধি নিজের রক্তবিন্দুকে প্রবাহিত করে দিতে চাই/ আমি একটি রক্তপাতহীন পৃথিবীর জন্যে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে- মর্মঘাতী রক্তপাত করে যেতে চাই।’ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আবেগ-উত্তেজনা ও ভালবাসার নিপুণ এক সাংগীতিক বর্ণনা খুঁজে পাই কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ‘বাউসী ব্রিজ ৭১’ শিরোনামের কবিতায়। কবিতাটির শেষ কয়েকটি পঙ্ক্তি- ‘আর আমরা শীতের রাতে সূর্যের প্রার্থনাস্তবগানরত কৃষকের মতো/ আমাদের মুখগুলো মাটির কাছাকাছি নামালাম, মমতার বিন্দু বিন্দু রক্তে/ চরের মাটিতে জ্বলন্ত ফুল ফোটানোর ঠিক আগ মুহূর্তে, কী আশ্চর্য/ আমাদের চিবুকগুলো ভয়ে নয়, আসন্ন মৃত্যুর সন্ত্রাসে নয়/ ভালবাসার মতো এক আর্দ্র, কোমল আবেগে ডুকরে কেঁদে উঠল।’ দামাল ছেলের জন্য এক মায়ের প্রতীক্ষা অত্যন্ত আবেগঘন সুরে উঠে আসে কবি ‘সানাউল হক খান’ এর কবিতায়। তাঁর ‘খোকন খোকন করে মায়’ শিরোনামের কবিতা থেকেÑ ‘ভাঙা ভিটে লেপে দিতে দিতে/ আঁচলে জমেছে কাদা, দুই চোখে বালি/ অনেক স্বপ্নের লগ্নপাত ঘটেছে আরক্ত ঘুমে/ তোমার খোকন তবু ঘরে ফিরল না/ তুমি বসে রইলে।’ একাত্তরে যুদ্ধকালীন পোস্টারে, ফেস্টুনে, মিছিলে মিছিলে বজ্র-সেøাগান হয়েছিল কবি হেলাল হাফিজের কবিতা, তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ থেকে দুই ছত্র- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ কবি কাজী রোজীর ‘একটি মাইক্রোবাস, তোমরা দু’জন ও জীবন্ত লাশ আমি’ শিরোনামের কবিতাটিতে পাওয়া যায় যুদ্ধকালীন ভয়, স্তব্ধতা, অন্ধকার ও নিরুদ্দিষ্ট যাত্রার এক ভয়ানক বর্ণনা- ‘তোমরা যে দু’জন আমাকে নিয়ে চলেছ/ কোনো কথা বলছ না কেন?/ হু-হু বাতাস মিশমিশে কালো অন্ধকার/ দীর্ঘ পথের নাগাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে চলেছে দূরের পথ/ সাদা মাইক্রোবাস প্রচ- গতিবেগে ছুটে চলেছে/ তোমরা কথা বলছ না কেন?’ মুক্তিযুদ্ধের অধীনায়কের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ‘না’ শিরোনামের কবিতায় কবি হাসান হাফিজ উচ্চারণ করেছেন বলিষ্ঠ প্রত্যয়, বাঙালীর হার না মানা বীর্যবান অস্তিত্বের জয়গাথাÑ ‘অপেক্ষার জীর্ণ জরায়ু ছিঁড়ে/ আমাদের দাঁত কামড়ে বেঁচে থাকাÑ লেফট রাইট দুঃসাহস/ ক্ষোভ ঘৃণা ভালোবাসা রক্তপাত/ অবিমিশ্র রক্তপাত আরো রক্তপাতÑ না, আমরা কাপুরুষ নই, না।’ স্বাধীনতা অর্জনের অনেক বছর অতিক্রম হলেও দেশবাসী স্বাধীনতার মাহাত্ম্যকে ঠিক উদযাপন করতে পারছে না; যেন সেই পুরনো শকুন খামছে ধরে আছে পতাকা, আজও যেনো চক্রান্তের অবসান হলো না, এমনই ভাব-চিত্রে গড়া ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতার শেষাংশে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নতুন করে স্বাধীনতার পরিচয় ও সংজ্ঞায়ন করেছেন- ‘স্বাধীনতা- সে আমার স্বজন হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন/ স্বাধীনতা- সে আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল/ ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মহাপ্রতিরোধের সাথে বাঙালী ফিরিয়ে দিয়েছে প্রতিঘাত; রক্তপটভূমে ওদের অসুর নৃত্য আর হলো না; কবি কামাল চৌধুরীর ‘সাহসী জননী বাংলা’ শিরোনামের কবিতা থেকে- ‘ভেবেছিলি অস্ত্রে মাত হবে বাঙালী অনার্য জাতি, খর্বদেহ/ ...ভাত খায়, ভীতু কিন্তু কী ঘটল শেষে?/ কে দেখালো মহাপ্রতিরোধ অ আ ক খ বর্ণমালা/ পথে পথে তেপান্তরে ঘুরে উদ্বাস্তু আশ্রয়হীন/ পোড়াগ্রাম মাতৃ অপমানে কার রক্ত ছুঁয়ে শেষে হয়ে গেল ঘৃণার কার্তুজ।’ শত সংগ্রাম, রক্ত ও অশ্রু গেলো তবু যেনো সেই কাক্সিক্ষত ভোর, সেই প্রার্থিত স্বাধীনতা ফিরে আসেনি, তাই কবির কণ্ঠে গভীর আক্ষেপ- ‘সে আসেনি/ কান্নাধোয়া ¯িœগ্ধ বৃষ্টি বুকে প্রতীক্ষার জানালায় ব্যাকুল দাঁড়ানো চোখের হাসির মতো/ যুবতী মাঠের জোছনায়-রাঙা পায়ে।’ কবি সোহরাব পাশার ‘তবে কেন এত আয়োজন’ শিরোনামের কবিতায় এমনই স্নিগ্ধ কাতর উচ্চারণ আমারা শুনতে পাই । কবি মাহমুদ আল জামান-এর ‘যখন ফিরছি’ নামের কবিতাটি একজন যুদ্ধ শেষে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে লেখা যেখানে পথের বর্ণনায় রয়েছেÑ বিক্ষত নারী, ভাঙ্গা থালা, নদীতে যুবার লাশ আর লোকালয় জুড়ে ভগ্ন-বিধ্বস্ত ছায়াÑ ‘যখন ফিরছি/ আলপথের ধারে/ ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে ছিল দুটি/ বিক্ষত নারী/ যখন ফিরছি/ নিকানো উঠোনো ভাঙা থালা/ নদীতে যুবার লাশ স্পষ্টস্বরে/ মাকে ডাকছে।’ আরও অসখ্য কবি আছেন যাদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা, ঘটনাচক্র, ইতিহাস ও দিনপঞ্জি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ভাষায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে তাঁদের মধ্যেÑ কবি সুফিয়া কামাল, কবি আহসান হাবীব, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি আবু বকর সিদ্দিক, কবি শহীদ কাদরী, কবি বেলাল চৌধুরী, কবি রফিক আজাদ, কবি সিকদার আমিনুল হক, কবি মহাদেব সাহা, কবি আবুল হাসান, কবি রবিউল হুসাইন, কবি হুমায়ুন কবির, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি মাকিদ হায়দার, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি শিহাব সরকার, কবি আবিদ আজাদ, কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি আবিদ আনোয়ার, কবি মিনার মনসুর, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু এবং কবি দুলাল সরকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংঘাত, অনধিকার চর্চা, বৈষম্য, শোষণ-পীড়নসহ নানান রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। অস্ত্র থাকলেই কেবল যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না, কারণ যুদ্ধ করে মানুষ, অস্ত্র নয়। যুদ্ধের সাথেও ন্যায্যতা ও নৈতিকতার প্রশ্নটি প্রচ্ছন্নভাবে যুক্ত থাকে। যোদ্ধার মনে অনীতি ও অবিচারের প্রশ্নটি যখন সংক্রমিত হয়, তখন সে হতোদ্যম হয় এবং পরাজয় মেনে নেয়। এই সাক্ষ্য বহন করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও শত্রুপক্ষ একই ধারার বিজিত হয়েছে। আমাদের বিজয়ের পেছনে যেমন রয়েছে মুক্তিকামী মানুষের জনযুদ্ধে প্রাণপণ ঝাঁপিয়ে পড়ার সংগ্রামী চেতনা; তেমনি ভূমিকা ছিল কবি-লেখক, শিল্পীরÑ কালি, তুলি এবং কথার দীপ্ত প্রভাব। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত কবিতায় একদিকে ছাড়িয়ে আছে ‘শোষণের সহস্র কাহিনী’ অন্যদিকে আছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উত্তুঙ্গ অভিলাষ। এ কবিতামালা বাঙালীর হাজার বছরের সংগ্রামশীল পরিক্রমার অবিচ্ছিন্ন আখ্যান। অসংখ্য কবির রচনা হলেও তা যেন নিবিড় গ্রন্থনায় আমাদের পূর্ণাঙ্গ জাতিসত্তাকে তুলে ধরে। কাক্সিক্ষত ঊষার আশ্বাসে, রক্ত ও অশ্রু মহিমায় বাক্ঋদ্ধ এই কবিতামালা আজও ছড়িয়ে যায়Ñ কম্পিত স্বরের মূর্ছনা।
×