ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

১১ মাসে বর্বরতার ৩৯৮ ঘটনা

ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর খুন ॥ কখনও নারী কখনও শিশু

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬

ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর খুন ॥ কখনও নারী কখনও শিশু

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এর শিকার কখনও নারী আবার কখনও শিশু। সংবাদপত্রে এসব ঘটনা প্রকাশ পেলেও সঠিকভাবে কি তদন্ত করছে প্রশাসন? উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা। ঘরে কিংবা বাইরে, শহরে কিংবা গ্রামে সব জায়গাতেই ঘটছে এ ধরনের পৈশাচিক ঘটনা। দিন দিন এ চিত্র ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যা। অপরাধ বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এ অবস্থা সমাজের চরম অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। মানুষ নৈতিকতার শূন্যের কোটায় পৌঁছলেই কেবল এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। বিচারহীনতাও কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনাকে উৎসাহিত করে বলে মত তাদের। তাদের মতে, এমন বর্বরতার শাস্তি না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা ও মামলার সংখ্যা বাড়ছে। শিশু ধর্ষণের পরিমাণ বাড়ছে। জয়পুরাহাটের ১৫ বছরের শামীমা আরও একটি উদাহরণ। ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে গত ছয়দিন অজ্ঞান শুয়ে আছে সে। কবেনাগাদ তার জ্ঞান ফিরবে সে বিষয়টি অজানা কর্তব্যরত চিকিৎসকের। গত ২৩ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয় সে। পরিবারের ধারণা, তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে কে বা কারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তা জানে না পরিবার। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কালাই থানার পরিদর্শক বিশ্বজিৎ বর্মণের সঙ্গে ঢামেক হাসপাতালে দেখা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এ ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। আমরা প্রাণপণে মূল অপরাধীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা প্রতিটি কোণ থেকেই মামলাটি দেখছি।’ সেদিন রাতের মর্মান্তিক ঘটনার পর শামীমার মা তার মেয়েকে প্রথম দেখেন। ফজরের নামাজ পড়তে উঠে শামীমার ঘরে গেলে তিনি শামীমাকে উল্টো হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেন। পুরো মুখে রক্ত মাখা অবস্থায় দেখে তিনি সবাইকে ডাকতে থাকেন। এ ঘটনায় তিনি কাউকে সন্দেহ করছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার কোন ধারণা নেই কিভাবে ঘটনাটি ঘটেছে। আমি ওর কোন চিৎকারও শুনতে পাইনি।’ শামীমার ঘটনাটি বছর শেষের আরও একটি আলোচিত ঘটনা। এ বছরের শুরুতে অর্থাৎ মার্চ মাসে সোহাগী তনু কিংবা বছরের মাঝামাঝিতে ঘটা খাদিজার ঘটনাটি সবগুলোই লোমহর্ষক। তনু এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। খাদিজা বেঁচে থাকলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। এখন তো শামীমার অবস্থাও শঙ্কামুক্ত নয়। বছরের শুরু থেকে নবেম্বর মাস পর্যন্ত গত ১১ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৯৮ শিশু। মাসওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ৩৩, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৪, মার্চে ২৯, এপ্রিলে ৪২, মে মাসে ৪৪, জুনে ৩৯, জুলাইয়ে ৩৩, আগস্টে ৩৭, সেপ্টেম্বরে ৩৪, অক্টোবরে ৩২ ও নবেম্বরে ৩৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৩৭টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৮টি শিশু, ৩১টি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ধর্ষিত হয়েছে আর ৫টি শিশু গৃহকর্মীর কর্মস্থলে ধর্ষিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ১৫টি শিশু। অর্থাৎ প্রতি দুই মাসে একজন শিশু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে ৫৪ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া ইভটিজিং, শ্লীলতাহানি, যৌন হয়রানি, মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে আরও ৭৮ শিশু। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এসব তথ্য দিয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শামীমার ঘটনাটির ওপর আলোকপাত করেই বছরটা শেষ হচ্ছে। বছরের পর বছর এই ধরনের কর্মকা- হাতের নাগালের মধ্য দিয়ে ঘটে যাচ্ছে কিন্তু আমরা দুঃখপ্রকাশ করা ছাড়া কিছুই করতে পারছি না। শুধু মেয়ে শিশুরা নয়, ছেলে শিশুরাও প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। তাদেরও খুন করা হচ্ছে। সরকার ও প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে শিশু নির্যাতনকে রুখতে। আইনী বিচারের হাত থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে অনেক অপরাধী। মাত্র দু’একটি মামলায় আমরা প্রশাসনের অগ্রগতি দেখছি। কিন্তু অনেক অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। শামীমা তার নিজ বাড়িতে ধর্ষণ হয়েছে। এমনকি তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। পার হয়ে গেছে ছয় দিন কিন্তু এখনও পুলিশ অপরাধীকে খুঁজে পায়নি। আমরা চাই অপরাধীর সঠিক শাস্তির বিধান। এছাড়া প্রত্যেক এলাকাভিত্তিক সচেতনতাও দরকার এ ধরনের কার্মকা- এড়াতে।’ ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ বলছে, ৫ বছরের শিশু থেকে ১৮ বছরের শিশু কেউই ঝুঁকিমুক্ত নয়। ধর্ষিত শিশুদের অধিকাংশের বয়সই ৫-১২ এর মধ্যে। এদের নানা কৌশলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ৫-১২ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে চকলেট, খেলনা বা কোন শৌখিন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কোন নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ১৩-১৮ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে এবং কোন নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। এর আগের বছর ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫২১টি। যাদের মধ্যে ৯৯টি শিশু গণধর্ষিত হয়েছে, ৩০টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৪টি শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৯৯টি। যাদের মধ্যে ২২টি শিশু গণধর্ষিত হয়েছে, ২১টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ২৩টি শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৩ এবং ২০১২ সালে যথাক্রমে ১৭০ এবং ৮৬টি শিশু ধর্ষিত হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। চলতি বছর গত ২৪ অক্টোবর রাজশাহীর পবা উপজেলায় চার বছর বয়সী এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করে রুহুল আমিন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার একটু আগে ফাঁকা মাঠে একা পেয়ে ওই শিশুকে ধর্ষণ করে। এর আগে ১৬ মে মৌলভীবাজারে চকলেট খাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে এক যুবক। ২৭ এপ্রিল লালমনিরহাট শহরে আপেল খাওয়ার লোভ দেখিয়ে বাসায় নিয়ে ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করে মকবুল হোসেন। ঘটনার দিন রাতে শিশুটির বাসায় আর কেউ না থাকার সুযোগে তাকে আপেল দেয়ার কথা বলে নিজের বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। সর্বশেষ গত ১৮ অক্টোবর দিনাজপুরের পাঁচ বছর বয়সী এক কন্যাশিশু নিখোঁজ হয়। পরদিন ভোরে শিশুটিকে তার বাড়ির কাছে হলুদ ক্ষেতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। জ্ঞান ফেরার পর শিশুটি জানায়, তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারের পরিচিত একজন ব্যক্তি তাকে ব্যথা দিয়েছে। শিশুটি দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর আশঙ্কামুক্ত হয়েছে। পূর্ব-পরিচিতদের কাছ থেকেই শিশুরা প্রতারিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমির। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ৯৯ শতাংশ ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের পরিবারের লোকেরা। পরিচিত হওয়ার কারণে প্রতিবাদ করার আগেই শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আমরা বলি মেয়েরা ঘরের বাইরে নিরাপদ না কিন্তু পরিবারের কাছেও নারী ও শিশুরা নিরাপদ না। এজন্য এ জাতীয় ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। পরিবারের সদস্যদের মানসিকতার পরিবর্তন হলেই এ ধরনের কর্মকা- আর ঘটবে না।’ শামীমার মামলাটি টেনে তানিয়া আমির বলেন, ‘শামীমা রাতে ঘুমাচ্ছিল তার রুমে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল। তার মা-বাবা, ছোট দুই ভাইও যথারীতি পাশের রুমে ঘুমাচ্ছিল। যদি কোন আগন্তুক শামীমার ঘরে ঢুকে ঘটনাটি ঘটাতো তাহলে অবশ্যই সে চিৎকার করত। যেহেতু তার চিৎকারের শব্দ কেউ শুনতে পারেনি। তাহলে অবশ্যই অপরাধী তার পূর্ব পরিচিত। বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটছে। অনেক অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে। আবার অনেক অপরাধী পারিবারিকভাবে সমঝোতা করে নিচ্ছে।’ এদিকে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেছে। তারা বলছে- প্রথমত, নির্যাতন করার পরও অপরাধীকে আইনের আওতায় না আনা। এ সম্পর্কিত আইন থাকলেও তা উপেক্ষিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মামলা হলে যে চার্জশীট দেয়া হয় তাতে আইনের ফাঁক ফোকর থাকে। নির্যাতিত শিশু দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত আর অপরাধীরা ক্ষমতাবান প্রভাবশালী ফলে মামলা গতি হারায়। শিশুর পক্ষে সাক্ষী পাওয়া যায় না। দরিদ্র অভিভাবক অনেক সময় অল্প টাকায় আসামির সঙ্গে আপস করে মামলা তুলে নেয়া। আবার অনেক সময় ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে গরিব হওয়া সত্ত্বেও সম্মান খোয়ানোর ভয়ে নির্যাতিত শিশুর অভিভাবক মামলা করেন না। আবার মামলা করলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীর নোংরা জেরা এবং দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলায় তাদের পক্ষে মামলা চালিয়ে নেয়াও সম্ভব হয় না। ফলে সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম মনে করে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে রায় দ্রুতগতিতে কার্যকর করলে এ অপরাধ কমে যাবে। যেসব নির্যাতিত দারিদ্র্য শিশুর পিতামাতার মামলা করার বা মামলা চালানোর সামর্থ্য নেই তাদের সরকারী সহায়তা নিশ্চিত করারও দাবি জানায় সংস্থাটি। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে বছরের পর বছর ধরে মামলা চলতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া কিছুদিন পার হওয়ার পর ঘটনাটি মানুষের মনের আড়াল হলেই অপরাধীরাও পুলিশি হেফাজত থেকে কোনমতে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সঠিক আইনী শাস্তি না পাওয়ায় এ ধরনের ঘৃণ্য কর্মকা- আরও বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিগত দু’দশকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এবং শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশে আইনী কাঠামো শক্তিশালী হয়েছে। সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী নানা উদ্যোগ। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্পষ্টত নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং ভয়াবহতা ও নৃশংসতা বেড়েছে। সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে তাই পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, নারী ও শিশুরা নিজ পরিবারেই নির্যাতিত হচ্ছে বেশি। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী ও শিশু চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। ফলে সহিংসতার শিকার হয়েও তারা তা সহ্য করছে বাধ্য হয়ে।
×