ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

সব স্বাধীনতাবিরোধীর নাম মুছে ফেলুন

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

সব স্বাধীনতাবিরোধীর  নাম মুছে ফেলুন

দুজন বিশিষ্ট এবং সম্মানিত নাগরিক কয়েক বছর আগে হাইকোর্টে একটা রিট দায়ের করেন। দেশের সব স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার আবেদন জানান রিটে। এ বছর বিজয়ের মাসের শুরুতে হাইকোর্ট উল্লিখিত আবেদনটি মঞ্জুর করে এবং সব জায়গা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছরের মাথায় এসে এখনও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আর কতদিন এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বিপ্লবের প্রতীক মাও সেতুং অনবরত বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন বিপ্লবের পরে সব সময়ই একটা প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির জন্ম হয় এবং তাদের অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য শুধু মনে মনে চেতনা ধারণ করলেই চলবে না, আক্ষরিক অর্থে বিপ্লবী কার্যক্রম রাষ্ট্রের সর্বত্র জারি রাখা দরকার। ১৯৬৫ সালে কালচারাল রেভিউলেশন শুরুর প্রাক্কালে মাও সেতুং ফ্রেন্স দার্শনিক আন্দ্রে ম্যালরাউস্কের সঙ্গে একটা আলোচনার সময় ঘোষণা করেন, ’Thought, Culture, Customs must be born of struggle, and the struggle must continue for as long as there is still danger of a return to the past’ (সূত্রÑ হেনরি কিসিঞ্জার অন চায়না, পৃঃ ৯৩)। মাও সেতুংয়ের এই মূল্যবান উক্তিটি আজ বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি প্রযোজ্য বলে আমার কাছে মনে হয়। মাও সেতুংয়ের কথার শিক্ষা হলো, অতীতের দুঃস্বপ্ন ও কালো অধ্যায়ে ফিরে আসার আশঙ্কা যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। ২৩ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাকিস্তানী আদর্শ, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির ভয়ঙ্কর কালো অতীতকে পিছনে ফেলে আমরা মুক্ত স্বাধীন হই। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর প্রতিবিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীল ও পরাজিতরা ক্ষমতা দখল করে এবং তাদের হাত ধরেই পাকিস্তানের অভিশপ্ত অধ্যায়ের সব কিছু আবার ফিরে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশ এবং অতীতের পাকিস্তানের মধ্যে আর কোন পার্থক্য থাকে না। পঁচাত্তরের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও তাদের প্রতিভূগণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় সুবিধাভোগীদের বিস্তৃতি ঘটেছে রাষ্ট্রের সর্বত্র, যা এখনও বহাল আছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তারা সব সময় ছিল, এখনও আছে। ফলে দেশের সর্বত্র স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে স্কুল-কলেজ, প্রতিষ্ঠান এবং রাস্তাঘাটের নামকরণ হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৫ বছরের মাথায় এসে রাজনীতির জায়গায় স্বাধীনতাবিরোধীদের যেভাবে পরাজিত করা দরকার ছিল তা এখনও সম্ভব হয়নি। এর একটি প্রধান কারণ পঁচাত্তরের অব্যবহিত পর একজন বীর উত্তম খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধার হাত ধরে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী ও পরাজিত শক্তির রাজনীতিতে পুনর্বাসন হয়। ফলে তার সঙ্গে আরও কিছু মুক্তিযোদ্ধাও পথভ্রষ্ট হন। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখি খেতাবধারী কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আর জামায়াত-রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধীরা একই মঞ্চে বসা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুক্তিযুদ্ধের নায়ক-মহানায়কদের বিরুদ্ধে সীমাহীন মিথ্যাচার করা হয় এবং স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগার, জামায়াত-রাজাকারদের গুণকীর্তন গাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা পালনকারী সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাকে নতুন প্রজন্মের সামনে থেকে নেই করে দেয়া হয়। একাত্তরের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ীদের পাপকে আড়াল করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয় যেন কিছুই ঘটেনি। তাই অন্যতম স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তানের সহযোগী সবুর খানের কবর হয় জাতীয় সংসদ এলাকায়। যিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন করেন তার সমাধি হয় সংসদ ভবনের মূল চত্বরের ভেতরে। অথচ যার জন্ম না হলে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না তাঁর সমাধি হয় রাজধানী থেকে বহুদূরে টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনকারী রাজনৈতিক পক্ষ রাজাকার শিরোমণি শাহ আজিজের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণ করেন, আর ঢাকায় শেরে বাংলা নগরের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ও নভোথিয়েটার থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম অপসারণ করেন। এসবের পরিণতিতে দেখা যায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে এক সময়ে মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদির মতো একাত্তরের ঘাতকদেরও সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে। ১৯ ডিসেম্বর জনকণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা খবর দেখলামÑ যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদির ছেলে পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিজয়ের শুভেচ্ছা স্মারক উপহার দেয়া হয়। খবরে আরও প্রকাশ, মাসুদ সাঈদির কাছ থেকে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করেন। ধর্মীয় রাজনীতির পরিণতিতে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও মুক্তিযোদ্ধাদের আজ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। উপজেলা চেয়ারম্যান তো তুলনামূলকভাবে ছোট পদ। বড় বড় স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। গ্রামগঞ্জে, শহরে, পৌরসভায় মেম্বার, চেয়ারম্যান হয়েছেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই তাদের নামে রাস্তাঘাট, ভবন, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়েছে। কৃষক, শ্রমিকের সন্তান শতকরা ৮০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা তাদের করুণার পাত্র হয়েছেন, যার সর্বশেষ উদাহরণ পিরোজপুরে যুদ্ধাপরাধীর ছেলের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার গ্রহণ। এসব কথা বলে শেষ করা যাবে না। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ভৈরব সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং সেতুর নামকরণ করা হয় জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের নামে। কিন্তু সেতুর অল্প কিছু কাজ বাকি থাকতেই আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হয় এবং ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে জামায়াত-বিএনপি সরকার। বাকি কাজ শেষ করে সেতুটির উদ্বোধন করেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তারা সৈয়দ নজরুল ইসলামের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন একজন ধর্মীয় ব্যক্তির নামে। নামটি এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে না। এই নাম পরিবর্তনের প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিএনপির অর্থমন্ত্রী প্রয়াত সাইফুর রহমান তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ‘কোথাকার কোন্ নজরুল ইসলাম, আমি তাকে চিনি না’। ১৯৭৫ সালের পর দুই সামরিক শাসক ও তাদের ‘প্রতিভূরা’ এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কদের অপমান করেন এবং রাষ্ট্রকে পাকিস্তানের কালো অধ্যায়ের চাদরে মুড়ে দেন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ আবার সংগ্রাম শুরু করে। যার ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহালসহ বাহাত্তরের সংবিধান প্রায় আমরা ফিরে পেয়েছি, যদিও স্বৈরশাসক এরশাদ কর্তৃক প্রণীত বড় একটা ক্ষত এখনও বহাল আছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনকারী দু’জন সামরিক শাসককেই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী এবং অবৈধ শাসক হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষণা করেছে। মশহুর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন এবং দ- কার্যকর হয়েছে, বাকিদের বিচার অব্যাহত আছে। এসব অর্জন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালীর নতুন সংগ্রামের ফসল। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় রাজাকার শাহ আজিজ ও সবুর খানসহ বড় কয়েকজনের নাম রাস্তাঘাট ও প্রতিষ্ঠান থেকে মুছে ফেলার জন্য সম্প্রতি হাইকোর্ট হুকুম দিয়েছে। শুধু কয়েকজনের মধ্যে এই আদেশ সীমাবদ্ধ নয়। আদালত বলেছে, সকল স্বাধীনতাবিরোধীর নাম মুছে ফেলতে হবে। তাই দেশের গ্রামগঞ্জে, শহরে যেখানেই স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম আছে তা মুছে ফেলার উদ্যোগ এলাকার জনগণকে নিতে হবে। এ কাজের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। মাও সেতুংয়ের পথ ধরে সংগ্রাম অব্যাহত থাকলে সব রকমের অপশক্তির কবল থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হবে। সংগ্রাম অব্যাহত রাখাটা জরুরী। আত্মতুষ্টিতে ভুগলে আবারও যে কোন সময় মহাবিপদ নেমে আসতে পারে। বিপদ এখনও কেটে যায়নি। জয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে একদিন জনগণের পক্ষ থেকেই দাবি উঠবেÑ অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের যারা পুনর্বাসন করেছেন তাদের অপরাধও কম নয়, সেসব নামও বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলতে হবে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক, নিউ অরলিনস, ইউএসএ থেকে
×