ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

এখনও সমাজ পচেনি ॥ এখনও মানুষ স্বপ্ন দেখে

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬

এখনও সমাজ পচেনি ॥ এখনও মানুষ স্বপ্ন দেখে

অতঃপর বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে প্রমাণ করল কেন এতদিন অংশ নেয়নি। নির্বাচনে অংশ নিলেও চরিত্র তাদের পাল্টায়নি। বিএনপি প্রার্থী দিনভর বললেন নির্বাচন সম্পূর্ণ সুষ্ঠু, অবাধ ও সুন্দর হচ্ছে। আর ফল প্রকাশের পর প্রার্থী যা বলছেন তাতে করে বলতে হয় দলটি ৩৬ বছরেও এতটুকু বদলায়নি। মিথ্যার ওপর মিলিটারি উর্দি পরিয়ে যে দলের জন্ম তা এতদিনেও যেমন শুদ্ধ হতে পারেনি আর কোনদিন হবে বলেও মনে হয় না। দলীয় প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন ভোট গ্রহণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বললেন নির্বাচন অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে সবকিছু চলছে। কোথাও কোন অনিয়ম অঘটন ঘটেনি, মারামারিও না, এমনকি ঝগড়াঝাটিও না। মহিলারা অবাধে লাইন ধরে ভোট দিচ্ছেন। অথচ বিকেলে ‘মিথ্যের ঢোল’ বলে পরিচিত রিজভী বললেন, ‘বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুষ্ঠু হলেও পর্দার আড়ালে কি হচ্ছে তা জানা দরকার।’ সাখাওয়াত হোসেনও রিজভীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললেন, সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে- ডেইলি স্টার কাগজের রিপোর্ট হলো 'BNP’s mayoral candidate Shakhawat Hossain last night brought allegation of 'subtle rigging’ in the NCC polls and manipulation in election results.’ অথচ ওই নিউজের পাশেই ডেইলি স্টারের লাল রঙের ক্যাপিটাল লেটারে হেডিং Elections Free, Fair' একই সঙ্গে হেডিং হলো No interference made it possible.' ॥ দুই ॥ এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ছোট-বড় প্রায় ১০০০ হাজার দৈনিক পত্রিকা; তিন ডজন টিভি চ্যানেল; ডজনখানেক বেতার এবং অবাক করা ১০ হাজারের মতো অনলাইন নিউজ পেপার পোটাল নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করে চলছে। কোটি কোটি সেলফোন তথা সোশ্যাল মিডিয়ার কথা নাইবা বললাম। কই কেউ তো একটি অনিয়মের কথাও বলতে পারলেন না, দেখাতে পারলেন না। কয়েক শ’ সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষক নারায়ণগঞ্জে ছিল তারাও তো কোন অনিয়মের কথা বললেন না। কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারলেন না। তবু বিএনপির ‘ংঁনঃষব ৎরমমরহম’ বা পর্দার আড়ালে কি হচ্ছে তা আবিষ্কার করছেন। বস্তুত দলটিই তো পর্দার আড়ালের। তা থেকে দিনের আলোয় আসতে আরও সময় লাগবে। অবশ্য এটি তাদের বলতে হবে। কেননা, এতদিন বলে আসছিল মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ নাকি বিএনপিকে দেবে। এবার তো মানুষ বাধাহীন সুন্দরভাবে ভোট দিয়েছে। আর বিএনপি প্রার্থী অসম্মানজনকভাবে হারলেন। তাই তো এমন অহেতুক বক্তব্য। ॥ তিন ॥ ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী এমনি এমনি জয়লাভ করেননি। এর জন্য তাকে নারায়ণগঞ্জের মতো জায়গায় নিরন্তর লড়াই করতে হয়েছে। একদিকে যেমন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন করেছেন। মোট ৬৫%-এর মতো ভোট কাস্ট হয়েছে। অর্থাৎ ভোট কাস্ট হয়েছে ২,৭১,৬৫৫টি। তার মধ্যে ডাঃ আইভী পেয়েছেন ১,৭৫,৬১১ আর সাখাওয়াত হোসেন পেয়েছেন ৯৬,০৪৪ ভোট, অর্থাৎ ডাঃ আইভী ৭৯,৫৬৭ ভোটে বিএনপি প্রার্থী তথা তাদের প্রতীক ধানের শীষকে পরাজিত করেছেন। ॥ চার ॥ অতএব বলতে হয় ‘এখনও সমাজ পচে যায়নি, এখনও মানুষ স্বপ্ন দেখে নিজেকে সুন্দর করার স্বার্থে সমাজকে সুন্দর করতে। ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী তারই প্রতীক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ তথা স্বাধীনতার প্রতীক নৌকার যোগ্য কর্মী, চৌকস কা-ারি। ইনকামবেন্সি বা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করা এবং সেই নির্বাচনে এত বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করা চাট্টিখানি কথা নয় এবং আইভী এই ঝুঁকি তার কর্ম তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে ওভারকাম করেছেন। আইভী ৫ বছর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ঘোষণার পর প্রথমবার স্বতন্ত্র নির্বাচন করেও বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। এর আগে কর্পোরেশন হওয়ার আগেও পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। তখন থেকে তিনি মানুষের কাজ করে চলেছেন। ২০১১ সালে কর্পোরেশন হওয়ার পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত-সমালোচিত শামীম ওসমানের সঙ্গে লড়াই করে জিতেছেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার। ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী এবং শামীম ওসমান উভয়ই দুটি স্বনামধন্য রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। আইভীর পিতা আলী আহমেদ চুনকা আওয়ামী লীগ নেতা হয়ে দলমত নির্বিশেষে নারায়ণগঞ্জবাসীর নেতা হতে পেরেছিলেন। দীর্ঘদিন নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। শামীম ওসমানের পিতা শামসুজ্জোহাও সকলের জোহা ভাই হয়ে নেতৃত্ব দেন। তাছাড়া খান সাহেব ওসমান আলীর উত্তরাধিকার, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় যাদের অবদান অনস্বীকার্য। নারায়ণগঞ্জের মানুষ আইভীকে মনে করে তাদের ঘরের মেয়ে, কারও বোন, কারও মা। এ অর্জন তিনি করেছেন জাতির পিতার আদর্শ আর শেখ হাসিনার মেধা, সাহস, দূরদর্শিতাকে জীবনে ধারণ করে, পিতার সর্বজনীনতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে রাজনীতিতে নেমেছেন, রাজনীতি করছেন, শেখ হাসিনার মতো রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য আদর্শ স্থাপন করেছেন। আইভী দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন, কিন্তু শেখ হাসিনার মতোই তার বিরুদ্ধে একটি অনিয়মের অভিযোগও কেউ তুলতে পারেনি। পত্রপত্রিকায় তার ছবি, বিশেষ করে দৈনিক জনকণ্ঠের মাস্টহেডে তার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকালে সহজেই মনে হবে এ মুখে কোন শঠতা এবং কুটিলতা নেই। তাই তো সাধারণ মানুষ আইভীকে তাদের প্রিয় নেতা মনে করে। ॥ পাঁচ ॥ অথচ আমাদের দেশে কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, যারা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতা করেন, পত্রিকায় কলাম রচনা করেন এবং টিভি টকশোতে যখন কথা বলেন তখন মনে হয় দেশটা গোল্লায় গেছে, এটি এখন আর মানুষের সমাজ নেই, জঙ্গী সমাজে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। আবার একশ্রেণী আছেন যারা এয়ার কন্ডিশনন্ড ড্রয়িং রুমে বসে বলে Ñ ‘ডার্লিং’ এবারের ঈদটা ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর অথবা মালয়েশিয়ায় কাটিয়ে এলে কেমন হয়। যাদের আবার পকেটে মালপানি একটু ভালই আছে তারা আমেরিকা, ইংল্যান্ড চলে যান। আটলান্টিকের তীরে বালিতে হাঁটেন আর বাংলাদেশের সরকার রাজনীতিকদের সমালোচনা করেন। এরা নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে লাখ লাখ টাকা খরচ করে আকাশে উড়াল দেন, অথচ পাশে যে ঘরের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বরকলের ওয়াটার পল বা নীলগিরির জলপ্রপাতের নামও জানেন না। জানতে চাইলে উত্তর হবে ওটি বাংলাদেশের, ও আর দেখার কি আছে? ॥ ছয় ॥ ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীকে অভিনন্দন জানাই কেবল তার জয়লাভের জন্য নয় বরং প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার মতো রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য এবং বুদ্ধিজীবী নির্বিশেষে সকলের জন্য আদর্শ নেতৃত্বের উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। ঢাকা : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×