ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ কুসংস্কার প্রতিরোধে প্রিয় নবী (সা)

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ কুসংস্কার প্রতিরোধে প্রিয় নবী (সা)

আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষ আল্লাহর সেরা সৃষ্টি- আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষকে তিনি সুন্দর অবয়ব দান করেছেন, বুদ্ধি-বিবেক দান করেছেন, ভাল-মন্দ বিচার করবার শক্তি দিয়েছেন, সত্য সুন্দর পথে চলবার জন্য হিদায়াত দান করেছেন, পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা দিয়েছেন, যুগে যুগে নবী রসূল পাঠিয়ে মানুষকে সৎ পথের দিশা দিয়েছেন, নবী-রসূলগণের কাছে সহীফা কিংবা কিতাব নাযিল করে পথচলার সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। পৃথিবীতে নবী-রসূল আগমনের ধারাবাহিকতায় সবার শেষে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু করেছেন সরকারে দোআলম নূরে মুজাস্সাম হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ্ (সা)-কে পৃথিবীতে তাঁর তশরীফ আনয়নের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবী-রসূল আগমনের পরিসমাপ্তি ঘটে, তিনি সর্বশেষ নবী-খাতামুন্নাবিয়ীন, তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন। তিনি নবী-রসূলগণের নেতা-সাইয়েদুল মুরসালিন। তাঁকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত আদম আলায়হিস সাল্লামের সৃষ্টিরও বহু পূর্বে নবুওয়াত ও রিসালতের অভিষেকে অভিষিক্ত করা হয় আর আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা ইসলামের পূর্ণতা দান করার জন্য সর্বশেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। আইয়ামে জাহিলিয়াতের ঘন তমসা উৎখাত করার জন্য তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। শিরক, কুফর, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের শেকড় উৎপাটন করতে তিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তিনি সিরাজুম মুনীরা-সমুজ্জ্বল চেরাগ। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন : ‘হে নবী! নিশ্চয় আপনাকে আমি পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে তাঁরই দিকে আহ্বানকারীরূপে ও সমুজ্জ্বল চেরাগরূপে।’ (সূরা আহ্যাব : ৪৫-৪৬)। সিরাজুম মুনীরার অর্থ যেমন সমুজ্জ্বল চেরাগ হয় তেমনি দীপ্তিমান সূর্যও হয়। চেরাগ বা প্রদীপ জ্বালালে যেমন অন্ধকার দূর হয়ে যায় এবং সেই চেরাগ থেকে বহু চেরাগ জ্বালালে যেমন চেরাগের আলো ফুরিয়ে যায় না কিংবা সূর্য উদয় হলে যেমন অন্ধকার-অমানিশা দূর হয়ে চারদিকে আলোয় ভরে যায় তেমনি প্রিয় নবী (সা)-এর আবির্ভাবে আইয়ামে জাহিলিয়াতের ঘনকালো অন্ধকার থেকে মানুষের আলোয় উত্তরণ ঘটল। টমাস কারলাইলের ভাষায় বলা যায়, ‘ঞযবংব অৎধনং, ঃযব সধহ গধযড়সবঃ, ধহফ ঃযধঃ ড়হব ঈবহঃঁৎু, রং রঃ হড়ঃ ধং রভ ধ ংঢ়ধৎশ যধফ ভধষষবহ, ড়হব ংঢ়ধৎশ, ড়হ ধ ড়িৎষফ ড়ভ যিধঃ ংববসবফ নষধপশ, ঁহহড়ঃরপবধনষব ংধহফ; নঁঃ ষড়, ঃযব ংধহফ ঢ়ৎড়াবং বীঢ়ষড়ংরাব ঢ়ড়ফিবৎ নষধৎবং, যবাবহ যরময ভৎড়স উবষযর ঃড় এৎধহধফধ.’- ‘একটি জাতি নাম তার আরব জাতি, একজন মানুষ তাঁর নাম মুহাম্মদ (সা) আর একটি শতাব্দী, এটা কি তাই নয় যেন একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তা নিপতিত হলো এমন এক যমীনের ওপর যা দেখে মনে হচ্ছিল কালো এবং অজ্ঞাত বালুকা- কিন্তু দেখ! দেখ! সেই বালুকা বিস্ফোরিত হলো বারুদের মতো আকাশ সমান আলো আর সেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত।’ প্রিয় নবী (সা) কুফর ও কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মানবকে উদ্ধার করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর দেয়া জীবন ব্যবস্থা প্রদান করলেন। তাঁর আবির্ভাবকালে কুসংস্কার পৃথিবীজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করেছিল। আরব ভূমিতে কুসংস্কারের ব্যাপকতা প্রচ-ভাবে ছিল। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রিয় নবী (সা) কুসংস্কার ধ্বংস করার আন্দোলিত দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা অব্যাহত রইল। আমরা জানি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে মক্কার মানুষ খুব অপমান বোধ করত, লজ্জায় মুখ ঢাকত এমনকি অনেক পিতাই কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। প্রিয় নবী (সা) এই কুসংস্কারকে উৎখাত তো করলেনই সেই সঙ্গে এটাও ঘোষণা করলেন, ‘যে মাতার প্রথম সন্তান কন্যা সে পুণ্যময়ী।’ কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার মুখম-ল কালো হয়ে যায় এবং অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয় তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে ওকে রাখবে, না মাটিতে পুঁতে দেবে। সাবধান, তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কত নিকৃষ্ট!’ (সূরা নাহল : ৫৮-৫৯)। কেউ নিঃসন্তান হলে কিংবা কারও পুত্র সন্তান হয়ে মারা গেলে সেই পিতাকে আব্তার অর্থাৎ লেজকাটা বলে আরব দেশের মানুষ বিদ্রƒপ করত এবং তাকে অলক্ষুণে বলে তার সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে থাকত, যেমনটা আমাদের দেশেও এমন কুসংস্কার কোথাও কোথাও পরিলক্ষিত হয়, যে পিতার সন্তান হয় না কিংবা মাতা বাজা বা বন্ধ্যা তাদের কারও সঙ্গে সকালে দেখা হলে সেদিনটাকেই অশুভ মনে করা হয়। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা)-এর এক শিশুপুত্র ইন্তেকাল করলে তাঁকে মক্কার কাফির মুশরিকরা আব্তার বলে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে থাকে। এই সময় আল্লাহ জাল্লা শানুহু প্রিয় নবী (সা)-কে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাওসার (কল্যাণের প্রাচুর্য এবং জান্নাতের এক খাস প্রস্রবণ) দান করেছি, অতএব আপনি আপনার রবের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি দিন। নিশ্চয়ই আপনার প্রতি যারা বিদ্বেষ পোষণ করেছে ওরাই আবতার।’ (সূরা কাওসার)। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সা)-এর সহধর্মিণী হযরত মারিয়া (রা) গর্ভে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। এই পুত্রের নাম হযরত ইব্রাহীম (রা)। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর কবর শরীফ জান্নাতুল বাকীতে সংরক্ষিত রয়েছে। এই হযরত ইবরাহীম রাদিআল্লাহু তায়ালা যেদিন ইন্তেকাল করেন সেদিন সূর্যগ্রহণ ছিল। সবাই বলাবলি করছিল যে, ইবরাহীম (রা)-এর ইন্তেকালে সূর্যও শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে তাই তাতে গ্রহণ লেগেছে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এই ধারণাকে বাতিল করে দিলেন। হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, যেদিন ইবরাহীম ইন্তেকাল করলেন। সেদিন লোকজন বলাবলি করছিল ইবরাহীমের ইন্তেকালের কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। তখন রসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : ‘কারও মৃত্যু অথবা জন্মের কারণে কখনও সূর্য কিংবা চন্দ্র গ্রহণ হয় না। তোমরা যখন তা (সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ) দেখবে তখন সালাত আদায় করবে এবং আল্লাহর নিকট দু’আ করবে।’ (বুখারী শরীফ)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী (সা) বলেছেন : নিশ্চয়ই কারও মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না বরং, তা আল্লাহ্র নিদর্শনগুলোর দুটো নিদর্শন। সুতরাং তোমরা যখনই গ্রহণ লাগতে দেখবে তখনই সালাত আদায় করবে।’ (বুখারী শরীফ)। উল্লেখ্য, এই সালাতকে বলা হয় সালাতুল কুসূফ। কুসংস্কার এক ধরনের মানসিক রোগ যা শয়তান দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সামাজিক জীবনে শেকড় গেড়ে বসে এবং অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়, যে অন্ধ বিশ্বাস দোজখে যাবার পথ প্রশস্ত করে দেয়, মানবিক মূল্যবোধকে নস্যাত করে দেয়। মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় নফ্সে আম্মারার প্রভাবে। নফ্সে আম্মারা শয়তান দ্বারা প্রভাবিত কুপ্রবৃত্তি। এই কুপ্রবৃত্তিই কুসংস্কারের উদ্ভব ঘটিয়ে তার প্রসার ঘটায় সমাজ জীবনে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা) কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানব সমাজকে পরিচ্ছন্নতার পথ প্রদর্শন করেন, তিনি সকল প্রকারের শয়তানী কার্যকলাপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং সৎপথ ও সৎকর্মের দিশা প্রদান করেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু কুরআন মজীদ নাযিল করেন মানুষকে সৎপথের দিশাস্বরূপ, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কার স্বরূপ। ইরশাদ হয়েছে : ‘রমাদান মাস, এতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াত সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী আল-কুরআন।’ (সূরা বাকারা : ১৮৫)। কুরআন মজীদ আল্লাহর কালাম। আল্লাহ ওহী প্রেরণ করে মানুষ মানুষকে সত্যপথের দিশা দিয়েছেন প্রিয় নবী (সা)-এর মাধ্যমে। প্রিয় নবী (সা) আইয়ামে জাহিলিয়াতের সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, শিরক ও কুফর চিহ্নিত করে সেগুলোকে ধ্বংস করলেন। আরব দেশে প্রায় ২৫০ প্রকারের মদ ছিল। মদ্যপান, নর্তন, গীত, জুয়া, মূর্তির বেদীতে রাখার তীর দ্বারা ভাগ্যের শুভ-অশুভ নির্ণয় করা প্রভৃতি শয়তানী কর্মকা- আরব সমাজকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। তিনি এই অন্যায় ও মানবতাকে অপদস্তকারী কার্যকলাপ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নির্দেশ পেয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ‘ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! মদ, জুয়া মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কার্যকলাপ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহ্র যিকরে ও সালাতে বাধা দিতে যায়।’ সূরা মায়িদা (৯০-৯১)। আরবদের মধ্যে আইয়ামে জাহিলিয়াতে ভূত-প্রেতের বিশ্বাস তীব্রভাবে ছিল। তারা মূর্তির সামনে অথবা মূর্তি পূজার বেদীতে হ্যাঁ বা না লেখা তীর একটি তূণে রেখে লটকিয়ে রাখত। ভাগ্য নির্ণয় কিংবা শুভ-অশুভ নির্ণয় করার জন্য ওই তূণ থেকে তীর টেনে উঠিয়ে যদি দেখা যেত হ্যাঁ লেখা তীর উঠেছে তা হলে মনে করা হতো যে উদ্দেশ্যে তীর তোলা হয়েছে তা শুভ আর যদি ‘না’ লেখা তীর উঠত তাহলে অশুভ মনে করা হতো। তারা বাড়ি থেকে বাইরে দূরে কোথাও গেলে রতম নামক গাছের ডালে গিরো দিয়ে যেত। যদি ফিরে দেখত গাছের ডালের বেঁধে দেয়া গিরো অবিকল রয়েছে তাহলে মনে করত তার স্ত্রী অন্য পুরুষের সঙ্গে ব্যভিচার করেনি, আর যদি গিরো খোলা অবস্থায় দেখত তাহলে মনে করত স্ত্রী ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিল। এমনি ধরনের অসংখ্য অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারে জর্জরিত ছিল তারা। শুধু আরব ভূমিতেই নয় পৃথিবীর সর্বত্রই নানা ধরনের কুসংস্কারে ছেয়ে গিয়েছিল। কাহিন বা গণকের দৌরাত্ম্য ছিল ব্যাপক হারে। কাহিনরা নানা ধরনের ভড়ং দেখিয়ে গণনা করে ভূত-ভবিষ্যত বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করত। মানুষ তাদের কথায় বিশ্বাস করত। শিরক ও কুফরের বিষবাষ্প মারাত্মকভাবে ছড়াতো কাহিনরা। তারা বলত জিনদের দ্বারা তারা খবরাখবর জানতে পারে। কাহিনদের কার্যকলাপ যে ভাঁওতাবাজি এসব বিষয়ে কুরআন মজীদে ও হাদিস শরীফে বিস্তর বিবরণ রয়েছে। শয়তান যে মানুষের মধ্যেও আছে এবং জিনের মধ্যেও আছে তা উল্লেখ করে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : প্রতারণার উদ্দেশ্যে তাদের একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে।’ (সূরা আন্আম ১১২)। কাহিনদের উৎপত্তি হয়েছিল জাদুকর, ওঝা ও ভূত-প্রেত পূজকদের মধ্য থেকে। কাহিনরা ছন্দোবদ্ধ বাক্য দ্বারা এক ধরনের ভাবাবেশ মিশ্রিত পরিবেশ সৃষ্টি করে মায়াজাল সৃষ্টি করত। প্রিয় নবী (সা) এসব উৎখাত করেন। সেকালে এমনও কুসংস্কার ছিল যে, প্যাঁচার ডাককে অশুভ মনে করা হতো যেমন আজকের দিনে টিকটিকি ডেকে উঠলে বলা হয় আমার কথা যে ঠিক তা সাক্ষ্য দিচ্ছে টিকটিকি। প্রিয় নবী (সা)-এ রকম যাবতীয় ধারণাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সেকালে আরব দেশে কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনরা দু’হাত দিয়ে কপাল থাপড়াত এবং মাথার চুল ছিঁড়ে হায়রে হায় বলে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করত। মেয়েরা আওলাকেশী হয়ে মাথায় কাদামাটি মেখে লাশের পেছনে পেছনে বিলাপ করতে করতে গোরস্তানে যেত। মাতম ও আহাজারি করার জন্য যারা বেশি আহাজারি করতে পারত এমন সব স্ত্রীলোককে ভাড়া করে এনে আহাজারি করানো হতো। এ ছাড়াও মৃত ব্যক্তির লাশ যতক্ষণ বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া না হতো ততক্ষণ বাড়ির উঠানে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হতো। প্রিয় নবী (সা) এগুলো বন্ধ করে দেন। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আমর ইবনুল আস (রা) তাই মৃত্যু শয্যায় থাকা অবস্থায় বলে যান : আমি মরে গেলে কেউ যেন চিৎকার করে না কাঁদে এবং আগুন না জ্বালায় (মুসলিম শরীফ)। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন : রসূলুল্লাহ (সা) আহজারিকারিণী ও তা শ্রবণকারীর প্রতি অভিসম্পাত করেছেন।’ (আবু দাউদ) বাম হাত দিয়ে পানাহার করা এক বড় কুসংস্কার। পানাহারে বাম হাত ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : লাতা’তাকুলু বিশশিমালি ফাইন্নাশ, শায়তানা ইয়া’কুলু বিশ্শিমালÑ বাম হাত দিয়ে খেয়ো না, কেননা শয়তান বাম হাত দিয়ে খায়। (মুসলিম শরীফ)। কবর জিয়ারতে অনেক ফায়দা লাভ করা যায়। প্রিয় নবী (সা) জান্নাতুল বাকী, ওহুদ প্রান্তর প্রভৃতি স্থানে গিয়ে নিয়মিত জিয়ারত করতেন। কিন্তু তিনি কবর সিজ্দা করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) রসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন যারা কবর সিজ্দা করে ও কবরে বাতি জ্বালায়।’ (নাসাঈ শরীফ)। কবরকে সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যে বাতি জ্বালানো নিষিদ্ধ, তবে জিয়ারতকারীদের সুবিধার্থে আলোর ব্যবস্থা করা যায়। প্রিয় নবী (সা)-এর পিতৃপুরুষ হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নির্দেশে হজের ঘোষণা দেন। তখন থেকে আল্লাহর বিধানানুযায়ী যিলহজ মাসে হজ পালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে শয়তানের প্ররোচনায় এতে নানা প্রকারের শিরক কুফর ও কুসংস্কার অনুপ্রবেশ করে। যেমন : মীকাত থেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে আসা, (একমাত্র হাশিমীরা একখানা তহবন্দ পরিধান করত), কুরায়শরা আভিজাত্যের অন্ধ-অহমিকায় ৯ যিলহজ আরাফাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে অবস্থান না করে মুযদালিফায় অবস্থান করত এবং রাতেও অবস্থান করত। প্রিয় নবী (সা) উলঙ্গ হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন, আরাফাতে দিবাভাগে অবস্থান এবং ১০ যিলহজ রাতে মুযদালিফায় অবস্থান ব্যবস্থা চালু করলেন। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : যখন তোমরা আরাফাত হতে প্রত্যাবর্তন করবে এবং মাশ’আরুল হারাম (মুযদালিফা উপত্যকায় অবস্থিত পাহাড়)-এর নিকট উপস্থিত হবে তখন আল্লাহর যিকর করবে।’ (সূরা বাকারা: ১৯৮)। এ ছাড়া যেসব শিরক ও কুফর ছিল প্রিয় নবী (সা) সে সবও চিরতরে উৎখাত করেন। তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ যিলহজ শুক্রবার বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণে বলেন: ‘আজ আমার পায়ের তলায় আইয়ামে জাহিলিয়াতের সর্ব প্রকারের অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার শিরক ও কুফর দলিত-মথিত হলো।’ তিনি সেই দীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন: ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের সুন্নাহ, তোমরা তা আঁকড়ে থাকলে পথভ্রষ্ট হবে না।’ বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় দেড় শ’ কোটি মুসলমান। এখনও আমাদের অনেকের মধ্যে অনেক কুসংস্কার জট পাকিয়ে আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে কুসংস্কার বা বদ্রুস্ম মানবিক মূল্যবোধকে যেমন বরবাদ করে দেয়, তেমনি মূল্যবান ইমান ও আকিদাকেও বরবাদ করে দেয়। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরিফ উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা) সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×