ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তা চুক্তি জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

তিস্তা চুক্তি জরুরী

একদা প্রমত্তা ও খরস্রোতা তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বাংলাদেশ অংশে কমছে দিন দিন। নদীর উজানে পানির প্রবাহ কমতে থাকায় এবং ভাটি এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ধু ধু বালুচর পড়ায় বর্তমানে একটি সরু নালার আকার ধারণ করেছে কল্লোলিনী তিস্তা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের খবর অনুযায়ী, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ ছিল ৪ হাজার কিউসেক। বর্তমানে সেটি এসে দাঁড়িয়েছে ১২শ’ কিউসেকে। নিকট অতীতের গড় প্রবাহের তুলনায় গতবারের চেয়েও এবার তা কমেছে ১০ শতাংশ। ফলে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বোর্ড আসন্ন বোরো মৌসুমে মাত্র আট হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ফলে তিস্তা ও সংলগ্ন এলাকাজুড়ে এখন শুধুই ধু ধু বালুচর; কৃষকের বুকজুড়ে শুধুই হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস। ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের একাংশের অধিবাসীদের এই হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাস চলতেই থাকবে। উল্লেখ্য, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের আওতায় নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলায় ১ লাখ ১১ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। তবে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তার উজানে বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহ অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ফলেই একদার প্রমত্তা নদীটির এহেন করুণ দশা। অন্তত বর্তমানে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার যে মুমূর্ষু অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়, তাতে একে ‘মৃৎবত’ নদী ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সে অবস্থায় তিস্তা নদী রক্ষার লক্ষ্যে এবং সেচ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে ভারতকে ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ পানি ছাড়তে দিল্লীকে দীর্ঘদিন থেকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে ঢাকা। সত্যি বলতে কী, তিস্তা চুক্তি এখন বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের শুধু নিকট প্রতিবেশীই নয়; বরং দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত অকৃত্রিম বন্ধু ও সুহৃদ। দিল্লী বাংলাদেশের কাছে করিডর, ট্রান্সশিপমেন্ট, শুল্কমুক্ত পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্য সুবিধাসহ যখন যা চেয়েছে, তখনই তা পেয়েছে সহজে। ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সহযোগিতা সর্বদাই স্মরিত হয়ে থাকে। সে তুলনায় বাংলাদেশের চাহিদা ও প্রাপ্তি অনেক কম। উদাহরণত বলা যায়, উজানে পানির প্রবাহ ও প্রাপ্তির কথা। ভারত কোন অবস্থাতেই আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও আইনকানুন ভঙ্গ করে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ অবরুদ্ধ করতে পারে না। অথচ ভারত তাই করেছে প্রথমে গঙ্গা এবং পরে তিস্তা ও অন্যান্য নদ-নদীতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করে। সর্বশেষ ব্রহ্মপুত্রেও বাঁধ নির্মাণের কথা শোনা গেছে। বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রেই ন্যায়ানুগ ও যুক্তিসঙ্গত প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে দুঃখজনক হলো গঙ্গার পানি নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তা হয়নি; বরং ঝুলে আছে দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম দিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তবে শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সফর বাতিল করায় তা আর হয়ে ওঠেনি। অভিযোগ রয়েছে তিনি তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নন। তদুপরি বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের সঙ্গে তার খারাপ সময় যাচ্ছে। আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরেও তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। সে অবস্থায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ‘গুজরাল ডকট্রিনের’ মতো তিস্তা চুক্তি সম্পাদন করতে পারে কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×