ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ শিল্প বিপ্লবের ডিজিটাল স্তর

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৬

একুশ শতক ॥ শিল্প বিপ্লবের ডিজিটাল স্তর

॥ দুই ॥ অর্থনীতি ফোরামের সম্মেলনের পর তাদের ওয়েবসাইট থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা গেছে তার মধ্য থেকে কিছু মন্তব্য আমাদের চোখে পড়েছে। সাইটে আটটি বিশেষ মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো বস্তুত বিশ্বের ডিজিটাল রূপান্তরকেই প্রকাশ করে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা ক্লাওস সোয়াব মন্তব্য করেছেন- “We must develop a comprehensive and globally shared viwe of hwo technology is affecting our lives and reshaping our economic, social, cultural, and human environments. There has never been a time of greater promise, or greater peril.” আমি ধারণা করি যে, এই মন্তব্য আমাদের সারা দুনিয়ার ডিজিটাল রূপান্তর সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা পেতে সহায়তা করবে। সোয়াব সারা দুনিয়ার জন্য সুস্পষ্ট ও বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ধারণা তৈরি করার জন্য অনুরোধ করেছেন, যাতে সবাই বুঝতে পারে প্রযুক্তি কেমন করে মানুষের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও মানবিক পরিবেশকে বদলাচ্ছে। তিনি মনে করেন যে, এমন সুযোগ বা চ্যালেঞ্জ এর আগে আর কখনও আসেনি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও স্থায়ুবিজ্ঞান গবেষক দিলীপ জর্জ মন্তব্য করেছেন- “Imagine a robot capable of treating Ebola patients or cleaning up nuclear waste.” দিলীপ সবাইকে ভাবতে বলেছেন এমন হতে পারে, রোবট ইবোলা ভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসা করবে ও পারমাণবিক বর্জ্য পরিষ্কার করবে। একটি অসাধারণ তথ্য দিয়েছেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েটো। তিনি জানিয়েছেন, মেক্সিকো হচ্ছে দুনিয়ার প্রথম দেশ যে ব্রডব্যান্ড প্রাপ্তিকে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার বলে সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছে। Mexico is one of the only nations whose constitution recogni“es the right of its people to a broadband internet connection.” এটি নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ অর্জন। দুনিয়াবাসী অন্তত একটি দৃষ্টান্ত পেয়েছে যে- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সঙ্গে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে থাকতে পারে। অন্যদিকে কিছু হতাশার চিত্রও আছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ যে সমভাবে হয়নি সেই কথাও বলা হয়েছে। লয়েডসের প্রধান নির্বাহী ইনগা বিয়েল মনে করেন দুনিয়ার বহু মানুষের স্মার্টফোনটাই একমাত্র কম্পিউটার।“For maû people, the smartphone is the first and only computer they have.” ডেলয়েট কনসাল্টিং-এর সিনিয়র গ্রাহক পরামর্শক গ্যারি কোলম্যান মনে করেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এখনও আতুড় ঘরে আছে। তবে ব্যবসা এবং সমাজে দ্রুত পরিবর্তন ও প্রভাবের জন্য এতে যোগ দেবার এখনই সময়। The Fourth Industrial Revolution is still in its nascent state. But with the swift pace of change and disruption to business and society, the time to join in is now.” কুডেলস্কি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আন্দ্রে কুদেলস্কি বলেন, একজন দক্ষ প্রকৌশলী যে কোন সংযুক্ত যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। সমাজ এই সক্ষমতার প্রভাব এখনও অনুভব করতে পারেনি। Aû skilled engineer can take control remotely of aû connected ÔthingÕ. Society has not yet reali“ed the incredible scenarios this capability creates.” ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নোবেল বিজয়ী রবার্ট জে শিলার বলেন, আপনি আগুনের বীমা করার জন্য ঘর পোড়া অবধি অপেক্ষা করতে পারেন না। আমরা সমাজে চরম অস্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। You cannot wait until a house burns down to byu fire insurance on it. We cannot wait until there are massive dislocations in our society to prepare for the Fourth Industrial Revolution.” নরওয়ের নাগরিক বিশ্ব রোয়িং-এর চ্যাম্পিয়ন রবার্ট বারগিট কারস্টেইন বলেন, বিশ্বের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রতিবন্ধীদের জন্য সুপার পাওয়ার দেবে। For people with a disability, the Fourth Industrial Revolution will give us super powers.” একসেনটিওর-এর প্রধান নির্বাহী পিয়েরে নানটার্ম বলেন, শুধু ডিজিটাল রূপান্তরের কারণে ২০০০ সালের পর ফরচুন ৫০০ কোম্পানির অর্ধেক হারিয়ে গেছে। “Digital is the main reason just over half of the companies on the Fortune 500 have disappeared since the year 2000.” অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ বর্ণিত ও কথিত তিনটি শিল্প বিপ্লবের কোনটিতেই যথাসময়ে অংশ নিতে পারেনি। এই সেদিনও আমরা কৃষিনির্ভর একটি দেশ ছিলাম। কৃষিযুগের সমস্ত লক্ষণ আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি তথা জীবনধারায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। ১৯৬৪ সালে আমরা কম্পিউটারের যুগে পা দিলেও এর প্রয়োগ ছিল খুবই সীমিত। ব্রিটিশ-পাকিস্তান তাদের ঔপনিবেশিক শাসনে কখনও আমাদের শিল্পযুগের উপযুক্ত হবার সুযোগই দেয়নি। বাংলাদেশের রূপান্তরের সময়টি শুরুই হয়েছে ১৯৭২ সালে। তার মাঝেও ’৭৫ থেকে ’৯১ সময়ের সামরিক শাসন দেশটির সামনে চলার পথকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ’৯১ পরবর্তী সরকারও দেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর বিষয়ে দূরদৃষ্টি নিয়ে তেমন কিছু ভাবতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরটি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ থেকে দেশটির সামনে যাওয়ার পথটা আবার সুগম হয়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে এই অঞ্চলই নয়, সারা দুনিয়াকে প্রথম একটি ডিজিটাল সভ্যতা গড়ে ওঠার আভাস প্রদান করেন। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই ঘোষণা কেবল দূরদৃষ্টিসম্পন্নই ছিল না, এটি ছিল দুনিয়াকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে একটি নতুন সভ্যতাকে দেখিয়ে দেয়া। সবাই জানেন, বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও ভারত ডিজিটাল রূপান্তরের কর্মসূচী ঘোষণা করে। আমার নিজের কথা যদি বলি তবে ডিজিটাল রূপান্তরের চর্চাটি শুরু করি ১৯৮৭ সালে। গণনা যন্ত্র দিয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনাকে বদলে দিয়ে শিক্ষাকে ডিজিটাল করার সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণ করি ১৯৯৯ সালে। ডিজিটাল সভ্যতার রূপরেখা প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল মাসে নানা মিডিয়াতে। তবে ‘বড় সফলতা অর্জন করতে পারি’ শব্দটিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরে। যেহেতু শেখ হাসিনা সেই ঘোষণার পর সরকার গঠন করেন এবং নতুন প্রজন্ম অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁর ঘোষণাকে স্বাগত জানায়, সেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশের চাকা সামনে যেতেই থাকে। হতে পারে আমরা যে গতিতে যেসব খাতে যে ধরনের পরিবর্তন চেয়েছিলাম সেসব পরিবর্তন আমরা করতে পারিনি। তবে এটি মানতেই হবে ঘোষণার পর সাত বছর ধরে বাংলাদেশ তার প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজকে ডিজিটাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। পুরো কাজটিতে আমাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোর আমলাতন্ত্র, কৃষি সমাজের রাজনীতি ও পুঁজিবাদী ধারার গতানুগতিক অর্থনীতির চাপে পড়ে আমাদের কাক্সিক্ষত ফলাফল পাচ্ছি না। জনগণের মাঝে সচেতনতার অভাব এবং প্রথম শিল্প বিপ্লবের শিক্ষাব্যবস্থার ফলে সামনে যাওয়াটা ক্রমাগতই থমকে যায়। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছেন, অর্থনীতিকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের কথা বলা হচ্ছে, তবুও কায়িক শ্রমকে মেধাশ্রম ও এ্যানালগ শিল্পকে মেধাশিল্পে রূপান্তরের চেষ্টা খুব ক্ষীণ। অনেক সময়ই অপ্রয়োজনে প্রকল্প গ্রহণ ও সেগুলো বাস্তবায়নের ঘটনাও ঘটছে। কখনও কখনও হুজুগ তোলা হচ্ছে এবং তাতে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্তও হচ্ছে। অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের পাশাপাশি ডিজিটাল অপরাধও বাড়ছে। ঔপনিবেশিক আইনের ধারাগুলো এসব অপরাধের জন্য উপযোগী নয়। ফলে নতুন আইন করতে হচ্ছে। মিডিয়ায় রূপান্তরের জন্য নতুন আইন ও নতুন নীতিমালা করতে হচ্ছে। তবে এটি গর্ব করার মতো- সারা দুনিয়া যখন ডিজিটাল বিপ্লবের কথা বলছে তখন আমরা সেটি থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমাদের প্রচুর চ্যালেঞ্জ রয়েছে এই রূপান্তরে। বিশেষ করে যদি নিজেদের মানবসম্পদকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারি তবে আমাদের অবস্থান দুনিয়ার তলানীতে থাকবে। তবে আমাদের সুযোগটা হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যা নবীন এবং তারা আমাদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা দেবে। আমরা যেহেতু এখন আর পশ্চাৎপদ থাকতে চাই না সেহেতু আমাদের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। আমি নিজে মনে করি, মেধাসম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারলে আমরা দুনিয়াতে পিছিয়ে পড়তে পারি না। অন্যদিকে আমাদের অনুভব করতে হবে যে, ব্যক্তিগত বৈষম্য থেকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বৈষম্যের ধারাটিও কার্ল মার্কসের সংজ্ঞায় থাকবে না। রাষ্ট্রের সীমানা, সংজ্ঞা বা অস্তিত্ব ডিজিটাল যুগে ভিন্নতর হবে এটি মাথায় রেখে এখনই সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল নির্ধারণ করতে পারি। আমি নিজের মতো করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশলগুলোর বিবরণ খুব সংক্ষেপে তুলে ধরছি। আমি মনে করি, ডিজিটাল বিপ্লবে বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে শামিল থাকতে হলে আমাদের প্রধান কৌশল হলো তিনটি। এই কৌশলগুলো মানবসম্পদ উন্নয়ন, সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর এবং একটি ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তোলা ও বাংলাদেশকে জন্মের প্রতিজ্ঞায় গড়ে তোলা বিষয়ক। ক. ডিজিটাল রূপান্তর ও মানবসম্পদ খ. ডিজিটাল সরকার গ. ডিজিটাল জীবনধারা ও জন্মের ঠিকানায় রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা। প্রথম কৌশলটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টি নিয়ে। আমরা এজন্য শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। দ্বিতীয় কৌশলটি সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর বা একটি ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠা বিষয়ক। তৃতীয় কৌশলটি মূলত একটি ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন। একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন এটি। এই কৌশলটির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দেশের শিল্প-কলকারখানা ও অর্থনীতির রূপটাকে ডিজিটাল করা বা সামগ্রিকভাবে একটি ডিজিটাল অর্র্থনীতি গড়ে তোলা। আমি বিশ্বাস করি অতীতের মতো বিপ্লব থেকে দূরে থাকার ভুলটা আমরা আর করব না। ঢাকা, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×