ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

হার্টের রোগীদের নিয়ে রিং বাণিজ্য, স্বজনরা থাকে অন্ধকারে

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

হার্টের রোগীদের নিয়ে রিং বাণিজ্য, স্বজনরা থাকে অন্ধকারে

নিখিল মানখিন ॥ রিং বাণিজ্যের শিকার হয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিভিডি) চিকিৎসাধীন এক মহিলা রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। তিনি হলেন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী এক কর্মকর্তার স্ত্রী চামেলি দাস। এনআইসিভিডি’র সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ প্রদীপ কুমার কর্মকার ও তাঁর মাধ্যমে বাইরে থেকে রিং সরবরাহকারী চক্রের সদস্যদের দায়ী করেছেন চামেলি দাসের স্বজনেরা। একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকের রিং পরানো নিয়ে কমিশন বাণিজ্য করার বিষয়টি দীর্ঘদিনের আলোচিত বিষয়। গত বছর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও দেশের যেকোন হাসপাতালে হৃদরোগীর দেহে মেয়াদোত্তীর্ণ রিং প্রতিস্থাপনে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। চামেলি দাসের বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে চামেলি দাসের মৃত্যুর বিষয়টি চিকিৎসার একটি অংশ এবং চিকিৎসা ও রিং পরানো যৌক্তিক ছিল বলে দাবি করেছেন হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এস টি এ আজম। হার্টের সমস্যা নিয়ে গত ১৫ নবেম্বর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সদ্য বিদায়ী এক কর্মকর্তা ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাসের স্ত্রী চামেলি দাস। ওই হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ প্রদীপ কর্মকারের তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা হয়। ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাস জনকণ্ঠকে জানান, স্ত্রীকে দেখার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রিং লাগানোর প্রস্তাব দেন ডাঃ প্রদীপ কর্মকার। তিনি ওই দিনই চামেলি দাসের পরিবারের সদস্যদের রিংয়ের টাকা যোগাড় করার পরামর্শ দেন। অবশেষে ওই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানেই গত ২১ নবেম্বর চামেলি দাসের এনজিওগ্রাম সম্পন্ন হয়। এনজিওগ্রাম করানোর পর একটি ব্লক ধরা পড়ে, যার পরিমাণ ৯৫ শতাংশ এবং বলা হয়, জরুরীভাবে রিং পরাতে হবে। আর হার্টের ব্লকের পরিমাণ ৭০ শতাংশ হলে রিং পরানো হবে এবং এর বেশি হলে অপারেশন করাতে হবে বলে এনজিওগ্রাম করার আগে চিকিৎসক আমাদের জানিয়েছিলেন। আর এনজিওগ্রামে আমার স্ত্রীর হার্টের ব্লক ছিল ৯৫ শতাংশ। চিকিৎসকের নিজের কথা অনুযায়ী আমার স্ত্রীকে রিং পরানো নয়, অপারেশন করার কথা ছিল। ব্রজেন্দ্র দাস আরও অভিযোগ করেন, ডাক্তারী প্রেসক্রিপশনে এনজিওগ্রাম করার আগে ২০ নবেম্বর রাতে ৪টি ট্যাবলেট ও পরদিন সকালে আরও ৪টি ট্যাবলেট খাওয়ার কথা লেখা ছিল। কিন্তু নার্সরা ফাইলটি নিয়ে যাওয়ায় আমরা তা জানতে পারিনি। নার্সরাও আমাদের এ বিষয়ে কিছু বলেননি। সকালে ফাইলটি হাতে পেলে আমরা নার্সদের বিষয়টি জানাই। নিজেদের দোষ ধামাচাপা দেয়ার জন্য নার্সরা তখন তাড়াহুড়ো করে রোগীকে একসঙ্গে ৫টি ট্যাবলেট খাইয়ে দেন। রিং কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ করে ব্রজেন্দ্র চন্দ্র দাস জনকণ্ঠকে বলেন, হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হলেও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতেন আমার স্ত্রী চামেলি দাস। স্ত্রী নিজেই নিজের কাজ করতেন। চিকিৎসকের তাড়াহুড়া করার বিষয়টি বুঝতে পারিনি আমরা। ডাক্তার নিজেই আমাকে হাসপাতালের ভেতরে থাকা একজনের কাছ থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়ে রিং কিনতে বাধ্য করেছেন। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাক্তার চলে যান তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারে। অন্যদিকে চামেলিকে নেয়া হয় সিসিইউতে। কিছুক্ষণ পর নার্সরা রোগীকে পানি ও জুস খেতে দিতে বলেন। এ সময় রোগী বমি করে। এরপর নার্সরা দ্রুত একটি ইনজেকশন নিয়ে আসতে বলে। আমি সেটা এনে দিলে তা পুশ করা হয়। কিন্তু এতেও রোগীর অবস্থার কোন উন্নতি না ঘটায় আমি দুই দফা ডাঃ প্রদীপের চেম্বারে ছুটে যাই। তিনি একবার এলেও পরে আর আসেননি। পরের বার তাঁর এক পিয়ন পাঠিয়ে রোগীকে এক বেড থেকে আরেক বেডে নেন। একপর্যায়ে অন্য ডাক্তাররা রোগীকে দেখাশোনা করেন। তাঁরা এক ব্যাগ রক্ত দেয়ার কথা বলেন। আমি রক্ত জোগাড় করি। কিন্তু তা দেয়ার আগেই রোগীর মৃত্যু হয়। ব্রজেন্দ্র দাস অভিযোগ করেন, ডাঃ প্রদীপের আচরণ থেকে খুবই পরিষ্কার, রোগীকে রিং পরানোর মতো অবস্থা না থাকা সত্ত্বেও কেবল নিজের কমিশনের জন্যই তিনি দ্রুত রিং পরিয়েছেন। এর ফলেই আমার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনাটি ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিবকে অবহিত করা হয়েছে। তাঁরা ঘটনার পর হাসপাতালেও গিয়েছিলেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই চিকিৎসক ও দালালদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়, আমি তা দেখার অপেক্ষায় আছি। একই সঙ্গে প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে রেখেছি বলে জানান চামেলি দাসের স্বামী ব্রজেন দাস। এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালে গিয়ে ডাঃ প্রদীপ কুমার কর্মকারকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল খোলা পাওয়া গেলেও কল রিসিভ করেননি তিনি। পরবর্তীতে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ এস টি এ আজম জনকণ্ঠকে জানান, বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত অবস্থায় পড়েছি। এটি চিকিৎসারই একটি অংশ। চামেলি দাসের চিকিৎসায় যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা সকলেই পরিশ্রমী ও ভাল চিকিৎসক। তাঁদের আগের খারাপ কোন রেকর্ড নেই। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে পুরো চিকিৎসা ছিল যৌক্তিক। তারপরও এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দু’দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে পুরো অবস্থা জানা যাবে বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ এস টি এ আজম। রিং ব্যবসা ॥ হার্টের রিং ব্যবস্থায় সব ক’টি হাসপাতালেই চিকিৎসক ও রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অলিখিত লেনদেন থাকে। রিংয়ের গুণাগুণ বিষয়ে রোগী ও তাদের লোকজনের জানার কোন সুযোগ থাকে না। এই সুযোগটি ব্যবহার করেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে রিং বিক্রি করা হয়। রিং সরাসরি রোগীর কাছে বিক্রি করা গেলে মূল্য কম পড়ত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের মাধ্যমে বিক্রি করার কারণে মূল্য কমানো যায় না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রিং পরানো নিয়ে কমিশন বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও চিকিৎসক। শতাধিক চিকিৎসক ও ২৫ রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছে হার্টের রিং বাণিজ্য। দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতার পরই রিং বিক্রি হয়। রোগীকে একটি রিং পরানো বাবদ ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসককে কমিশন দেন ব্যবসায়ীরা। এতে রিংয়ের মূল্য বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ এ কমিশন বাণিজ্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। হার্টের রিং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে মেডি গ্রাফিক ট্রেডিং লিমিটেড, কার্ডিয়াক কেয়ার, ওরিয়েন্ট এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি, কার্ডিয়াক সল্যুয়েশন, ইউনিমেড, বায়োভাসকুলার, ওমেগা হেলথ কেয়ার, গ্লোবাল করপোরেশন, দ্য হার্টবিট, জিন ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল এ্যান্ড সার্জিক্যাল এক্সপোর্ট ইমপোর্ট লিমিটেড, এ্যাডভান্সড মেডিটিস, বিজনেস লিঙ্ক, ইপিক টেকনোলজিস, হার্ট কোয়াক, জেএমআই হসপিটাল রিক্যুইসিট এমএফজি, বিভা ইন্টারন্যাশনাল, এ্যালায়েন্স মেডিকেল, লাইফ লাইন ইন্টারন্যাশনাল, আমিন সার্জিক্যাল, করোনারি কেয়ার এ্যান্ড মেডিক্যাল সার্ভিসেস, আর্টিকুলার, এশিয়া প্যাসিফিক মেডিকেলস, দ্য স্পন্দন লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের যোগজাসশে এ অনৈতিক কাজ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। শুধু হার্টের রিং নয়, হৃদরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পেসমেকার, বেলুন গাইডওয়্যার, ক্যাথেটার, ভাল্ব, অক্সিজেনেটর ইত্যাদি নিয়েও অবৈধ বাণিজ্য চলছে। হাইকোর্টের আদেশ ॥ জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও দেশের যেকোন হাসপাতাল কর্তৃক হৃদরোগীর দেহে মেয়াদোত্তীর্ণ রিং প্রতিস্থাপনে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। গত বছর বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারির পাশাপাশি এ আদেশ দেন। ‘মেয়াদোত্তীর্ণ রিং পরিয়ে হৃদরোগ চিকিৎসার ভয়াবহ তথ্য’ শিরোনামে চ্যানেল ২৪ বিডি. টিভিতে প্রচারিত ও প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে আদালত এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই প্রতিবেদন জানতে পারেনি দেশবাসী। এনজিওগ্রাম, রিং পরানো ও বাইপাস সার্জারি ॥ এক্সরের মাধ্যমে শরীরের ধমনীগুলোকে দেখাকে এনজিওগ্রাম বলে। অবশ্য এ জন্য ধমনীর মধ্যে এক ধরনের ডাই (রঞ্জক পদার্থ বা কন্ট্রাস্ট মিডিয়া) প্রবেশ করানো হয়। এনজিওপ্লাস্টির পরে ওই জায়গার প্রশস্ততা ধরে রাখতে ওই স্থানে রিং বসানোকে স্টেনটিং ( ঝঃবহঃরহম) বলে । যে পথে এনজিওগ্রাম করা হয়েছে ওই পথেই এনজিওপ্লাস্টি করে স্টেনটিং বা রিং পরানো হয়। স্টেনটিং বা রিং পরানোর পরও ওই জায়গায় আবারও চর্বি জমতে পারে। তাই পরবর্তীতে রক্তের চর্বি কমার ওষুধ, রক্ত জমাট না বাঁধার ওষুধ ডাক্তারের পরামর্শ মতো খেয়ে যেতে হয়। দুই ধরনের স্টেন বা রিং লাগানো হয়ে থাকে। ড্রাগ এলুটিং স্টেন (এটি খুব দামী ও ব্যয়বহুল) এবং মেটাল স্টেন। প্রথমে এনজিওগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে, করনারি আরটারির মধ্যে কতগুলো ব্লক আছে বা ব্লকগুলোর অবস্থান কোথায় বা কত শতাংশ ব্লক আছে। যদি দেখা যায় ব্লকের সংখ্যা তিন বা তিনের বেশি (অনেক সময় তিনটাও করা হয়) এবং ব্লকের হার কখনও কোথাও ১০০% এবং সেখানে এনজিও প্লাস্টি বা বেলুনিংয়ের মাধ্যমে স্টেন বা রিং প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয় অথবা রক্তনালীর অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে আছে তখন সেখানে বাইপাস অপারেশান বা করনারি আরটারি বাইপাস গ্রাফটিং করা হয়। যা সাধারণত বাইপাস সার্জারি নামেই বেশি পরিচিত। এই অপারেশনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রক্তনালী বন্ধ হবার কারণে হার্টের যে অংশে রক্ত চলাচল কমে গেছে অথবা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে সেই অংশে রক্তের যোগান নিশ্চিত করা।
×