ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

ফিদেল ক্যাস্ট্রো ॥ ভাগ্যাহত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৬

ফিদেল ক্যাস্ট্রো ॥ ভাগ্যাহত মানুষের স্বপ্নদ্রষ্টা

না ফেরার দেশে চলে গেছেন বাংলাদেশের আরেক অকৃত্রিম বন্ধু বিপ্লবী কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। আর সেই স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন এই বিপ্লবী নেতা। আসলে বিপ্লবীদের ধর্মই হচ্ছে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদের বিপ্লবের প্রতি সমর্থন যোগানো। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের প্রতিও জোরালো সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। তাই বাংলাদেশের জনগণের মাঝে এই নেতা সম্পর্কে আছে একটি ভালবাসার দৃষ্টিভঙ্গি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়া ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে বাংলাদেশ সম্মানিত করেছে। ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ দিয়ে সম্মানিত করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল কিউবার এই কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর। ১৯৭৪ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনের সময় বৈঠক হয়েছিল তাঁদের। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন ক্যাস্ট্রোর প্রতি। অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনা হয়েছিল দুই মহান নেতার। সেই সময় বৈঠক থেকে বেরিয়ে ফিদেল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব আর সাহসে এই মানুষটি হিমালয়েরই সমান। আমি তাঁর মধ্যে হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছি।’ ক্যাস্ট্রো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করে তাঁর ঐতিহাসিক মন্তব্যের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কিউবার এই কিংবদন্তির নেতার সমর্থনের জন্য বাঙালী জাতি তাঁকে চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মুক্তি সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে ফিদেল এদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। জাতির পিতার একান্ত অনুরাগী ছিলেন ক্যাস্ট্রো। তিনি পৃথিবীর ভাগ্যাহত মানুষের উন্নত জীবনের জন্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের পতাকাকে সমুন্নতি করতে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের সমর্থন করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। বাঙালী জাতি তা চিরদিন স্মরণ রাখবে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তঁাঁর দলের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। ফিদেল বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত, মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তঁাঁর বাবার সঙ্গে ফিদেলের সম্পর্কের এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তঁাঁর অবদানের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যু বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর সংগ্রামের কথা বিশ্ববাসী আজীবন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ ফিদেল ক্যাস্ট্রো ২৪ নবেম্বর স্থানীয় সময় রাত ১০টা ২৯ মিনিটে মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে কিউবার বিরানে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত এক সচ্ছল পরিবারে ফিদেল ক্যাস্ট্রো জন্মগ্রহণ করেন। ক্যাস্ট্রো দীর্ঘদিন বিপ্লবী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৫৯ সালে কিউবাকে মুক্ত করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। অবশ্য শীঘ্রই মারা যাবেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে কিউবার জনগণ ও তাঁর অনুসারীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। গত বছর কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে দেয়া ভাষণে ৮৯ বছর বয়সী এই নেতা বলেন, তিনি হয়ত শীঘ্রই মারা যাবেন। কিন্তু বিপ্লব নিয়ে তাঁর পরিকল্পনাগুলো বেঁচে থাকবে। বর্ষীয়ান এই বিপ্লবী আরও বলেছেন, ‘শেষ সময়টা আমাদের সবার জীবনেই আসবে। কিন্তু কিউবার কমিউনিস্ট দলের ধারণা এই পৃথিবীতে আজীবন রয়ে যাবে। বিশ্ববাসী জানবে যদি তারা সততার সঙ্গে কাজ করে, তাহলে তারা মানবসভ্যতার জন্য ভাল জিনিস ও সংস্কৃতি তৈরি করতে পারবে। আর এসবের জন্য আমাদের ক্রমাগত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পর পর কিউবায় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত থাকেন দলের বড় নেতারা। এই কংগ্রেস থেকে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নির্বাচিত হন ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ছোট ভাই ও দেশটির বর্তমান প্রধান রাউল ক্যাস্ট্রো (৮৪)। ২০১৮ সালে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন। কংগ্রেসের উদ্বোধন করে ফিদেল ক্যাস্ট্রো জানিয়ে দিয়েছেন, এর পর থেকে ৭০ বছর বয়সেই অবসরে যাবেন দলের নেতারা। আগামী ২০২১ সালে পরবর্তী কংগ্রেসের ঘোষণাও দেন তিনি। সেই কংগ্রেসকে নতুন প্রজন্মের নেতারা নেতৃত্ব দেবেন বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, এবারের কংগ্রেসই হচ্ছে ঐতিহাসিক প্রজন্মের শেষ কংগ্রেস। এই বিপ্লবী নেতা তাঁর নীতির সঙ্গে কোনদিন আপোস করেননি। সম্প্রতি কিউবা সফর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। দীর্ঘ ৮৮ বছর পর কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেশটি সফর করেন। তবে সফরে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে দেখা হয়নি তার। ওবামা চলে যাওয়ার পর এক বিবৃতিতে ফিদেল বলেছেন, কিউবার মার্কিন সাহায্যের প্রয়োজন নেই। এখানে কমিউনিস্ট আদর্শের সঙ্গে দেশ চলবে। এই মহান নেতার পুরো নাম ফিদেল আলেসান্দ্রো ক্যাস্ট্রো রুজ। জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট। ১৯৫৯ সালে তিনি মার্কিন সমর্থিত একনায়ক ফুলগেন্সিও বাতিস্তার সরকারকে উৎখাত করেন। বাতিস্তা সরকারকে উচ্ছেদের পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পৃথিবীর বাঁক পরিবর্তনের এক ঐতিহাসিক সময়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রোসহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাতসহ বেশ কিছু অবিসংবাদিত সাহসী নেতা, যাদের প্রজ্ঞা, মেধা এবং অকল্পনীয় দেশাত্মবোধ মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত। ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে চেনার মধ্য দিয়ে আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছেই চিরচেনা হয়ে থাকলেন।
×