ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

জয়নুলের অনন্য সৃষ্টি ‘নবান্ন’

ফসলকেন্দ্রিক উৎসব বাঙালী জাতিসত্তার অনিন্দ্য প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

ফসলকেন্দ্রিক উৎসব বাঙালী জাতিসত্তার অনিন্দ্য প্রকাশ

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ হেমন্ত এখন। ফসলের মাস। নতুন ধান কাটা চলছে। চলছে ধান শুকানো ও মাড়াইয়ের কাজ। কৃষক ব্যস্ত। কৃষাণীরাও বসে নেই। গ্রামবাংলার চিরচেনা এই দৃশ্য বহু শিল্পী এঁকেছেন। নানা রং-রূপে প্রকাশিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। কিন্তু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যে ছবিটি এঁকেছিলেন তা আর সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। ‘নবান্ন’ শিরোনামে আঁকা ছবিতে ফসলকেন্দ্রিক ব্যস্ততা বা উৎসব নয় শুধু, গ্রামীণ জীবন অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বর্ণিল প্রকাশ। ‘নবান্ন’ ৬৫ ফুট দীর্ঘ ও ৬ ফুট প্রস্থের স্ক্রল পেইন্টিং। এখানে সমৃদ্ধ সোনার বাংলাকে বড় ভালবেসে আঁকেন শিল্পাচার্য। জলরঙে আঁকা ছবি এখন বাংলাদেশের চারুকলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মারক। ক্রিমশান কালো রং আর রেখা গ্রামীণ জীবনের গল্প বলে। হাল্কা রং মোমের আঁচড়ে যে ড্রইং, দেখে মুগ্ধ কেবল মুগ্ধই হতে হয়। স্ক্রল পেইন্টিংয়ে আলাদা আলাদা দৃশ্যকল্প। স্বতন্ত্র শিল্পকর্মের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থিত। আবার একসূত্রে গাঁথা। দীর্ঘতম ছবিতে শিল্পাচার্যের স্পেসের ব্যবহার দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। রংতুলির আঁচড় যেখানে পড়েনি, সচেতনভাবে ফাঁকা রেখে দিয়েছেন যেটুকু জায়গা, সেটুকুও অনায়াসে মূল শিল্পকর্মের অংশ হয়ে উঠেছে। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলার ঘরে ঘরে ফসলকেন্দ্রিক যে ব্যস্ততা, উৎসব অনুষ্ঠান আনন্দ হাসিরাশি- সবই এখানে অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পাচার্য। শুরুটা করা হয়েছে ধানকাটা দিয়ে। এখানে তুলির বলিষ্ঠ আঁচড়ে আঁকা শ্রমজীবী মানুষ। পরের দৃশ্যে সেই ধান মাথায় করে কাঁধে করে বাড়ি ফেরা। ততক্ষণে প্রস্তুত উঠোন। সেখানে বিছিয়ে দেয়া হয়েছে ধানের আঁটি। চলছে গাছ থেকে ধান আলাদা করার কাজ। এ কাজে কৃষকের সঙ্গে যোগ দিয়েছে গবাদিপশু। ফসল ঘরে তোলার প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ঢেঁকিতে শব্দ তুলে কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন তারা। শ্রমজীবী নারীদের বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট। ফসল ঘরে তোলার কাজ শেষ হলে শুরু হয় উৎসব পার্বণ। বিয়ের ধুম পড়ে। ছবিতে ঐতিহ্যবাহী পালকি। বর্ণাঢ্য আয়োজনে বরযাত্রা। ছবির আছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক। জয়নুল শেষ করেন নিঃস্ব মানুষের কথা বলে। সব হারানো মানুষের দলকে শহরের দিকে ছুটতে দেখা যায়। সমৃদ্ধির ইতিহাসের পাশাপাশি তিনি বলতে প্রয়াসী হন ব্যথাভরা বঞ্চনাপূর্ণ জীবনের কথাও। শেষ চিত্রকর্মটি যেন বলে ওঠে- এই যে সুখ, সুন্দর বেঁচে থাকা, সুন্দর থাকে না সব সময়। নানা প্রতিকূলতার মুখে টিকতে না পেরে নিঃস্ব মানুষ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে শহরমুখী হয়। এভাবে স্ক্রল চিত্রটি আর কেবল নবান্নের হয়ে থাকে না। গ-ি ছাড়িয়ে যায়। চিরায়ত বাংলার প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ জীবন ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের আদি আচার-অনুষ্ঠান, জীবনাচরণ কিছুই বাদ যায় না। এভাবে ‘নবান্ন’ বাঙালী জাতিসত্তার অমূল্য স্মারক হয়ে ওঠে। শিল্পপ্রেমী মানুষ তাই অনেক সময় নিয়ে ছবিটি দেখেন। মন্ত্রমুগ্ধ চোখে দেখে যান। ‘নবান্ন’ এখন সংরক্ষিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হওয়ায় খুব সহজ হয় না প্রদর্শনী। সর্বশেষ শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনীতে ছবিটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন জয়নুলভক্তরা।
×