ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সরকার কবে কঠোর হবে?

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২৩ নভেম্বর ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সরকার কবে কঠোর হবে?

সরকারের সফলতা কি এভাবেই ধুলায় মিশে যাবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একক প্রচেষ্টা আর জনগণের ভালবাসায় এদেশ এখন অন্য উচ্চতায়। পরিশ্রমে মেধায় এবং সাহসে দীপ্যমান দেশ ও জাতিকে কারা বার বার এমন বিপদে ফেলছে? সরকার যতটা চাক্ষুস দল কেন নয়? দলের ভেতরে বাইরে কারা এসব আগুন ও জীবন নিয়ে খেলছে? বঙ্গবন্ধুর আমলের মতো এবারও কি এরা মোশতাকী কায়দায় সব ভ-ুল করে দেবে? একটা নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা দিয়ে শুরু করি। আমরা যখন হাওয়াই গিয়েছিলাম আমেরিকার মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপপুঞ্জে আমাদের দুটো বিষয় খুব মুগ্ধ করেছিল। মনে ধরেছিল অবারিত প্রশান্ত পাড়ে আমেরিকার আদলে গড়া এক আদিবাসী সমাজ। আধুনিকতার পাশাপাশি এদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এখনও সমান চলমান। ভাল লেগেছিল এদের পরিচর্যা করে পেশ করার অভিনব কায়দা। পর্যটকদের মনোরঞ্জনে নয় তাদের হাতেই আছে হাওয়াইয়ের চাবিকাঠি। তাদের কেউ চোখ রাঙ্গাতে পারে না সেখানে। আমেরিকার পতাকাতলে থাকা এই মানুষরা একদা সংগ্রামে আত্মসমর্পণ করলেও আজ তারা সেদেশের গর্বিত নাগরিক। সন্ধ্যার পর যাবতীয় আনন্দ বিনোদনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তারা। এক এক নৃগোষ্ঠী একেক দ্বীপের। এমনও দেখেছি একটি দ্বীপের মাত্র একজন মহিলা। সে নিজেও জানে না তার দেশের আর কোন মানব-মানবী সেদেশে বাস করে কিনা। অথচ সে নিঃসঙ্গ নয়। তার মুখের হাসি কথা বলার ভঙ্গি আর স্বাভাবিকতা বলে দিচ্ছিল কতটা সুখী সে। রাতে যখন একেকটি আয়োজনে আদিবাসীদের নাচ গান আর ডিনারে আমরা মজে ছিলাম একবারের জন্যও বুঝতে পারিনি এরা কোন ধরনের আমেরিকান। এর নাম যদি একদেশ একসমাজ একছাদের তলা না হয় তো সে আর কোথায় আছে? অথচ এই আমরাই আমেরিকানদের বিরুদ্ধে অযথা সোচ্চার। আমাদের দেশের কোন মানুষটির মনে আমেরিকা নেই? আজ যদি আবার ডিবি খুলে দেয়া হয় বা সুযোগ দেয়া হয়, কতজন আছেন যারা ট্রাম্পের ভয়ে আবেদন করবেন না? বা তাকে ঘৃণা করে আবেদন করবেন না? আমেরিকার রাজনীতিতে এই মানুষটির আগমন আমাদের জন্য সুখবর না। আমরা তা চাইনি। কিন্তু সেদেশের মানুষ কাকে নেতা বানাবেন সেটা তাদের নিজস্ব বিষয়। এশিয়া বিষয়ে আমেরিকার নীতিতে এসব পরিবর্তন আদৌ কতটা প্রভাব ফেলবে সেটাও ভাবছি না আমরা। আমেরিকা আমাদের মতো দেশ? এর নিয়ম, রাজনীতি বা বিদেশ নীতিতে কি আমাদের মতো যা খুশি তা চলে? না চলতে পারে? তারা হিসাব কষে অঙ্কের চালে দাবার চালে ঘুঁটি চালে। তারা আমাদের নিয়ে কতটা ভাবে এটাও বুঝতে হবে। এসব বাদ দিয়ে আমরা যখন তাদের নিন্দায় দেশ মাথায় তুলছি তখন ভেতরে ভেতরে বিষাক্ত সাপ ফণা তুলছে। তার ছোবল এখন স্পষ্ট। প্রথমে মূর্তি ভাঙ্গা দেব-দেবীর হাত পা গুঁড়িয়ে দেয়া হিন্দুদের ওপর নির্যাতন সেটা যখন আর কাজ করছে না এবার আমাদের টার্গেট হয়েছে আদিবাসীরা। দেশের সবচেয়ে নিরীহ জনগোষ্ঠী সাঁওতালরা। তারা এতটা মাইক্রস্কোপিক যে বলে না দিলে বোঝাও যায় না। আমরা নিজেদের নিয়ে এত ব্যস্ত, এত মারামারি হানাহানিতে আছি অন্যদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায়? খুন-ধর্ষণ-লুটপাটের এই সমাজে সাঁওতালরা যে একদিন টার্গেট হতে পারে সেটা আমরা ভুলে গেলেও সময় ভোলেনি। কার অপরাধ কি অপরাধ তা নিয়ে ভাবার আগে একটা বিষয় ভাবুন একদেশে একসমাজে আমাদের প্রতিবেশী এরা আজ কতটা অনিরাপদ। মারা যাবার পরও তাদের ভয় যাচ্ছে না। অনাহারে ঘরবন্দী হয়ে দিন কাটাচ্ছে তারা। এর পেছনে যে রাজনীতিই থাকুক আওয়ামী লীগ বা সরকারের দায়িত্ব তাকে চিহ্নিত করে আশু এর প্রতিকার করা। সরকারের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে সেটা সবাই জানে। কিন্তু সরকারী দলের মানুষরা সে ফাঁদে পা দিচ্ছেন কেন? অনেকে যে স্বেচ্ছায় এসব করছেন সেটাও বিবেচনায় রাখা দরকার। সরকার যখন বলে উন্নয়নের রথ ধাবমান, আমরা পুলকিত হই। এও মানি মানুষের জীবনে নানাভাবে এখন সচ্ছলতা দৃশ্যমান। কিন্তু ভেতরের ঘুণ পোকা যে সমাজকে কেটে টুকরো করে এখন জাতিগত বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে তুলছে তার কি হবে? এর আগে সাঁওতালদের ওপর এমন আক্রোশ দেখিনি। আগেই বলেছিলাম লোভ ও হিংসার হাত অনেক লম্বা। যা সাম্প্রদায়িকতার নামে গজিয়ে এখন বিভেদের বৃক্ষে পরিণত হয়ে গেছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানের পর আদিবাসী তাও ক্ষুদ্র অসহায় প্রতিরোধবিহীন একদল মানুষের ওপর এমন নির্লজ্জ আক্রমণের সমাজ কোন মুখে ট্রাম্পের নিন্দা করে? দেশে এখন এমন এক সময় চলছে যার নাম এককেন্দ্রিকতা। রাজনীতি নিজে যখন তা লালন পালন করে, পুষে বড় করে তার ছোবল তো খেতেই হবে। বিচার ও শাস্তিহীনতা এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে মানুষ পুরো একটি সম্প্রদায় বা জাতিগোষ্ঠীকে মারতেও ভয় পাচ্ছে না। এককেন্দ্রিকতা যদি দলে থাকে, সমাজে থাকে সেখানে অন্যের অস্তিত্ব স্বীকার না করাই হবে স্বভাব। সরকারী দল ও বিরোধী রাজনীতি কারও এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। একদল আক্রমণকারী আরেক দল তামাশা দেখা বা নীরবে প্রশ্রয় দেয়ার কাজে নিয়োজিত। অথচ যত দেশে গেছি যত উন্নত ও সুস্থ জাতি দেখেছি তারা এদের আগলে রেখেছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ মূল মাটি থেকে অনেকদূরের এক আমেরিকা। সেখানকার জীবন বিনোদন ও পর্যটন ধরে আছে আদিবাসীরা। ইন্দোনেশিয়ার বালি কম্বোডিয়ায়ও দেখেছি তা। আমরা? কোন বিদেশী অতিথি বা অতিথির দল এলে তাদের সামনে শোকেসে রাখা পুতুলের মতো এদের হাজির করি। নেচে গেয়ে মন ভোলানোর জন্য। হাততালি দিয়ে বলি বা বাহ এরাও আমাদের দেশে থাকে? দেখিনিতো। এমন সমাজে মূলধারায় তারা কোথায়? তাদের ওপর এমন নির্যাতন ও হামলার পর কাউকে দেখেছেন কলম ধরতে? আমাদের কথা বাদ। আমরা তো আহা উহু করব। যাদের সাপে কাটল তাদের তো এমন একজনও নেই যে বলতে পারে বা লিখতে পারে। এমন কেউ থাকার কথা সমাজ মিডিয়া কেউ ভাবেও না। যারা মিডিয়ায় নেই, সিনেমায় নেই, গানে নেই, আনন্দে নেই, ক্রিকেটে নেই, ফুটবলে নেই তাদের বাড়ি পুড়লেই কি আর না পুড়লেই বা কি? আমি বরং দেখি অজস্র ট্রাম্প ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে। অথচ এরাই তার বিরুদ্ধে সোচ্চার। সাঁওতালরা কোথায় পালাবে? তারা তো ভারতমুখী নয়। তাদের জায়গা তো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদেও নেই। দরিদ্র অসহায় নিরীহ এদের বিদ্রোহের ইতিহাস যতটা লাল এরা আজ ততটাই রক্তহীন পাংশু। সাঁওতালদের প্রতি এই অন্যায় প্রকৃতি সহজভাবে নেবে না। নিতে পারে না। মাটির সন্তানদের ওপর এই জুলুমের বিচার না হলে মাটিই একদিন প্রতিশোধ নেবে। কেউ কি আছেন তাদের জন্য? [email protected]
×