ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ভাবার বিষয় ॥ উন্নয়ন হচ্ছে বেশি কিন্তু কর্মসংস্থান কম

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

ভাবার বিষয় ॥ উন্নয়ন হচ্ছে বেশি কিন্তু কর্মসংস্থান কম

উন্নয়ন কীসের জন্য? উন্নয়ন মানে প্রচলিত অর্থে প্রবৃদ্ধির হার, তার মানে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার। ‘জিডিপি’র হার বাড়ল, মাথাপিছু আয় বাড়ল; অথচ কর্মসংস্থান হলো কম- এর অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে মাথাপিছু আয় হচ্ছে গড়ের হিসাব, এখানে ধনীর আয়ও আছে। রিকশাওয়ালা ও শ্রমজীবীর আয়ও আছে। এমনকি এই হিসাবে বেকারও আছে। এ কারণেই দেখা যায় ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার দিন দিন বাড়ছে, অথচ কর্মসংস্থান হচ্ছে কম হারে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, বাংলাদেশে তাই ঘটছে। বিষয়টি পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে এক গবেষণায়। গবেষণাটি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সহযোগিতা করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। ‘এমপ্লায়ম্যান্ট ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক জরিপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ সেভাবে বাড়ছে না। একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ হারে। ঐ সময়ে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১০ সালে প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। অথচ কর্মসংস্থানের হার হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। সর্বশেষ খবরটি খুবই খারাপ। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। অথচ কর্মসংস্থানের হার মাত্র ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ আমরা যে দাবি করছি তা মূল্যহীন। আমরা বলছি ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার যত বেশি হবে, তত বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাস্তব ও তথ্যে দেখা যাচ্ছে তা সঠিক নয়। অনেক ম্যানুফেকচারিং শিল্প স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাচ্ছে। পোশাক শিল্পেও ধীরে ধীরে ‘অটোমেশন’ হচ্ছে। কৃষি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে যন্ত্রপাতি। হাল চাষ, চারা রোপণ, ফসল তোলা, ধান থেকে চাল করা, নিড়ানি ইত্যাদি কাজের বিপুল অংশ আজকাল যন্ত্রে হয়। হাতের কাজ কম। সিমেন্ট, ওষুধ শিল্প থেকে শুরু করে অনেক শিল্প আজ স্বয়ংক্রিয় মেশিনে চলে। এভাবে প্রতিযোগিতার কারণে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনেক কাজই অটোমেটেড হয়ে যাচ্ছে। এর জন্যই কী প্রবৃদ্ধির হার বেশি হওয়ার পরেও কর্মসংস্থান কম হচ্ছে? বিষয়টি বোঝা দরকার জরুরীভিত্তিতে। কারণ, আমরা শ্রমের ঘাটতিতে ভুগি না। আমাদের দেশ ১৭ কোটি লোকের দেশ। এখানে কর্মসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। অন্যরা ‘অটোমেটেড’ হয়ে যে উপকার পাবে আমরা তা পাব না। স্বয়ংক্রিয় মেশিনে কাজ, রোবটে কাজ করাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। তাদের লোকের অভাব। বাইরে থেকে লোক আমদানি করেও তাদের পোষাচ্ছে না। তবে এও দেখা যাচ্ছে, এই প্রক্রিয়ায় লোক বেকার হচ্ছে এবং এর প্রতিবাদও হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ইস্যুগুলোতে কর্মসংস্থানহীনতা, বিশেষ করে ‘সাদা’ লোকদের কর্মহীনতা, বেকারত্ব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমতাবস্থায় আগেভাগেই আমাদের তাই ভেবেচিন্তে এগোতে হবে। আমাদের দেশে বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে, বিশাল পরিমাণের অর্থ এসবে বিনিয়োজিত হচ্ছে। কিন্তু দৃশ্যত এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে খুবই কম। শ্রমঘন শিল্পের কথা সবাই ভুলেই যাচ্ছে। সবার নজর পুঁজিনির্ভর শিল্পে। এটা শ্রমের অভাবের জন্য নয়, কথিত প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য। তাও কখন, যখন এক কোটির ওপর বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে কাজ করছে। তারা দেশে ফিরে আসলে কী হবে? দেশে দেড় শতাংশ জন্মহার ধরে নিলেও বছরে প্রায় ২৬ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করে। অর্থাৎ এই সংখ্যক শ্রমিক প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। তাহলেই প্রশ্ন এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কর্মসংস্থান বর্তমান প্রবণতায় কীভাবে সম্ভব? বিষয়টি ভাবনার, বিষয়টি উদ্বেগের। টেকসই উন্নয়নের প্রশ্নে এই বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত এই ইস্যুটি এখানে রেখে চলে যাব মূল্যস্ফীতি, রফতানি এবং রেমিটেন্সের মতো সমসাময়িক বিষয়ে। এতক্ষণ যা বললাম তা হচ্ছে ভবিষ্যত ভাবনার বিষয়। এবারে আসছি এই মুহূর্তের ভাবনার বিষয়ে। বড় ভাবনার বিষয় মূল্যস্ফীতি, যে জিনিসটা মানুষকে কুরে কুরে খায়। সরকারী তথ্যে দেখা যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি আবার নীরবে বাড়ছে। আমরা এতদিন স্বস্তিতে ছিলাম। বরং গর্বই করতাম। ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে অথচ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এটা ছিল একটা অসম্ভব কল্পনা। কারণ, সাধারণভাবে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা বর্তমান সরকারের প্রথম দিকে ঘটলেও পরের দিকে বন্ধ হয়। এখন আবার উদ্বেগ বাড়ছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসেই তা ৫ দশমিক ৬২ শতাংশে নেমে আসে। ধীরে ধীরে কমতে কমতে তা আগস্ট মাসে ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশে স্থির হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি আবারও বাড়ে। অক্টোবরে তা ছিল ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এসব সরকারী তথ্য। বাস্তব চিত্র কিন্তু আরও খারাপ। মধ্যবিত্তের কেন, সাধারণ মানুষের খাদ্যবস্তুর মূল্য বাজারে বেশ উর্ধমুখী। এখন ভরা শীতকাল। শাক-সবজির মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। শাক-সবজির সরবরাহে বিঘœ ঘটেছে এমন খবর নেই। তাহলে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে প্রতিটি সবজি কিনতে হবে কেন? মাছের দামেও একই অবস্থা। পুঁটি মাছ যা ছিল গরিবের, তার কেজি চার শ’ টাকা। কী খাবে মানুষ? এসব কী বাণিজ্যমন্ত্রীর দেখার বিষয়, না অর্থমন্ত্রীর দেখার বিষয়? নাকি প্রশাসন দেখবে? আমার কেন জানি মনে হয় সরকারী প্রশাসন ঢিলেঢালা হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। দায়িত্ব পালনের তাগিদ কোথাও নেই। সরকার ব্যস্ত রাজস্ব আদায়ে। সরকার ব্যস্ত গরিবের ওপর ট্যাক্স বসাতে। মানুষকে স্বস্তি দেবে কে? এদিকে ভাল খবর একটা পাওয়া যাচ্ছে রফতানি খাতে। সেপ্টেম্বর মাসে রফতানি হ্রাস পেয়ে অক্টোবরে তা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বরে যেখানে রফতানির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন (বিলিয়ন সমান শত কোটি) ডলার সেখানে অক্টোবরে রফতানির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার। তথ্যে দেখা যাচ্ছে পোশাক রফতানির পরিমাণ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির পরিমাণ। এছাড়া পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানিও অক্টোবরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কৃষিপণ্য এবং কৃষিজাত পণ্যের রফতানি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এই সুসংবাদের সঙ্গে একটা ভাল খবর পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক নীতিমালার সঙ্গে সম্পর্কিত এই সুসংবাদটি। বলা হচ্ছে মার্কিনীরা চীনের মালের ওপর ৩৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসাবে। একইভাবে মেক্সিকান পণ্যের আমদানির ওপর বসাবে ৪৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ‘ট্রান্স আটলান্টিক ট্রেড এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (টিটিআইপি)’ থেকে বেরিয়ে যাবে। বলা হচ্ছে ‘ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (টিটিপি)’ থেকেও তারা বেরিয়ে যাবে। যদি সত্যি সত্যি তা হয় তাহলে এসব আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। চীন, মেক্সিকো, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী। যদি তাদের মালে আমদানি শুল্ক বসে তাহলে আমাদের রফতানি বাড়বে। এটাই পোশাক খাতের খবর। এই দিকটি বিবেচনা করলে সরকারের জন্য তা বিশাল স্বস্তি বয়ে আনবে। কিন্তু কথা হচ্ছে আন্তর্জাতিক খবর ভাল থাকা সত্ত্বেও দেশীয়ভাবে মূল্যস্ফীতি পীড়া দিচ্ছে কেন? বিদেশের বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি মারফত আগে মূল্যস্ফীতি দেশে আসত। এখন তো বিদেশে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে না। তা হলে কেন গরিবের শত্রু মূল্যস্ফীতি এভাবে নতুন করে আমাদের আক্রান্ত করছে? এটা কী অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধির ফল? এটা ফরাসউদ্দিন সাহেবের বেতন কমিশনের ফল? এসব পর্যালোচনা করার দরকার আছে বলে মনে করি। রফতানি ক্ষেত্রের খবর স্বস্তির হলেও ডলার আয়ের অন্যান্য খবর ভাল নয়। আমি বলছি রেমিটেন্সের কথা। রেমিটেন্সের হ্রাসমান প্রবণতা কোনভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে রেমিটেন্স হ্রাস পেয়েছে ১৫ শতাংশ। অবশ্যই কথাটা গেল অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে অনেক কথা। বলা হচ্ছে হুন্ডির মারফত ডলার আসছে। এটা কিভাবে সম্ভব? খোলাবাজারে ডলারের মূল্য কম, ব্যাংকে বেশি এ কথা সবাই জানেন। এরপরও কী প্রবাসীরা ‘হুন্ডিতে’ ডলার পাঠায়? হ্যাঁ, পাঠাতে পারে একটি কারণে। ‘হুন্ডিতে’ লেনদেন নিরাপদ এবং দ্রুত। এতে কোন ঝামেলা নেই। সবচেয়ে বড় কথা ‘হুন্ডিতে’ প্রবাসীরা টাকা পাঠায় বরাবরই। তারপরও তো রেমিটেন্সের পরিমাণ বাড়ছিল। এখন অবশ্যই অন্য কারণ যোগ হয়েছে। বিদেশে চাকরির সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে। বিদেশে প্রবাসীদের আয় কমেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজ কম এখন। তাদের রফতানি পণ্য তেলের দাম ভীষণ কম। অনেক দেশে চলছে বাজেট ঘাটতি। নির্মাণ কাজ বন্ধ। শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। প্রবাসীদের আয়ের ওপর আবার ট্যাক্স বসানো হচ্ছে। ওইসব দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যও বাড়ছে। এসব কারণে রেমিটেন্সে একটা টান পড়েছে। এমতাবস্থায় ভরসা দেখা যাচ্ছে রফতানিতেই। কিন্তু শুধু রফতানিনির্ভরতা পরিণামে আমাদের মঙ্গল বয়ে আনবে না। চীন রফতানি করে উন্নতি করেছে। এখন তারা ‘অভ্যন্তরীণ ভোগ’ এবং বিনিয়োগে মন দিয়েছে। অভ্যন্তরীণ ভোগ বাড়া দরকার। মানুষ সবজি, মাছ খেতে পারল না। এসব বিদেশে রফতানি হলো। মানুষ অপুষ্টিতে ভুগল। এটা কোন কাজের কথা নয়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×