ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণিল আয়োজনে ঢাকা লিট ফেস্ট শুরু

শিল্প-সাহিত্যের আলোয় দূর হবে সব অন্ধকার

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

শিল্প-সাহিত্যের আলোয় দূর হবে সব অন্ধকার

মনোয়ার হোসেন ॥ তাঁবুতে চলছে সাহিত্যের আলোচনা। মঞ্চে হচ্ছে সাহিত্যবিষয়ক বহুমাত্রিক আলাপ। উঠে আসছে গল্প-উপন্যাস বিষয়ে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের ভাবনা। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত লনে ভেসে বেড়াচ্ছে গানের সুর। তাঁবুতে দেখানো হচ্ছে চলচ্চিত্র। আবার কোন মঞ্চে চলছে কবিদের স্বরচিত কবিতাপাঠ। এছাড়া উৎসবের চারপাশজুড়ে রকমারি বইয়ের সম্ভার নিয়ে ছড়িয়ে আছে বুক স্টল। এভাবেই শিল্প-সাহিত্যের আলোয় বৃহস্পতিবার ঝলমল করে উঠল বাংলা একাডেমির বিশাল আঙিনা। সাহিত্যের আনন্দময় উদ্্যাপনে শুরু হলো ঢাকা লিট ফেস্ট। সম্প্রতি মাথাচাড়া দেয়া উগ্রবাদের বিরুদ্ধে শিল্প-সাহিত্যের আলোকময় শক্তিতে জ্বলে উঠল এই উৎসব। মৌলবাদকে জানান হলো ধিক্কার। তিন দিনের এ আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশসহ ১৮টি দেশের ৬৬ জন কবি-সাহিত্যিক লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও প্রকাশক। আছেন দেশের দেড় শতাধিক কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পী। সকালে বর্ণিল আনুষ্ঠানিকতায় উৎসব উদ্বোধন করেন নোবেলজয়ী ত্রিনিদাদের সাহিত্যিক ভি এস নাইপল। বেলা সাড়ে ১১টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শুরু হয় উদ্বোধনী পর্ব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্মানিত অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন উৎসবের তিন পরিচালক-সাদাফ সায্্, কাজী আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর। সংক্ষিপ্ত কথন শেষে ছিল উদ্বোধন। হুইল চেয়ারে চড়ে মঞ্চে আসেন ৮৪ বছর বয়সী বিশ্বখ্যাত লেখক ভিএস নাইপল। সঙ্গে ছিলেন লেখকের সহধর্মিণী নাদিরা নাইপল। এ সময় অন্য অতিথিদের নিয়ে ফিতা কেটে তিন দিনের এ উৎসব উদ্বোধন করেন ভিএস নাইপল। উদ্বোধনী বক্তব্যে ঢাকায় আগমনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ভিএস নাইপল বলেন, এখানে এসে খুব ভাল লাগছে। উৎসব উদ্বোধন করেও আমি আনন্দিত। এ সময় খানিকটা রসিকতা করে পুরনো এক ঘটনার কথা উল্লেখ করে নাইপল বলেন, একবার একটা অনুষ্ঠানে তাড়াতাড়ি ফিতা কেটেছিলাম। তখন পাশে থাকা আমার এক বন্ধু বলল, এত তাড়াতাড়ি ফিতা কাটতে হয় না। আবেদনটা ধরে রাখতে ধীরে ধীরে কাটতে হয়। আমি বোধ হয় এবারও তাড়াতাড়ি ফিতা কেটে ফেলেছি। ফিতা তো কাটলাম। এখন আমার হয়ে কেউ বক্তৃতাটা দিয়ে দিক। তাঁর কথায় হেসে ওঠেন মিলনায়তন ভর্তি সাহিত্যানুরাগী শ্রোতারা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এ সাহিত্য উৎসবটি একইসঙ্গে আমাদের সংস্কৃতিকে যেমন বিশদভাবে তুলে ধরছে, তেমনি আমাদের সামনে হাজির করছে বিশ^ সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে। ঠিক এ জন্যই উৎসবটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, এ উৎসবের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হবে আমাদের অনুবাদ সাহিত্য। তাহলেই বিশ^ দরবারে তুলে ধরতে পারব আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সাহিত্যকে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, দেশে মুক্তমনা সাহিত্যিক-ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকের ওপর একাধিকবার হামলা হয়েছে। এর ফলে বিদেশীদের অনেকে এদেশে আসতে শঙ্কিত ছিলেন। তবে আমরা থেমে থাকিনি। চেষ্টা করেছি সব শঙ্কা দূর করতে। তাই এ উৎসব আমাদের জন্য বেশ স্বস্তির। উৎসবটি তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য একটি দারুণ সুযোগ, কেননা এখানে এসে তারা নিজেদের অভিমত, অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারছেন। উদ্বোধনী আয়োজনে ছিল সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার পরিচালনায় একগুচ্ছ গান গেয়ে শোনান সুরের ধারার শিল্পীরা। তাদের পরিবেশিত সম্মেলক সঙ্গীতগুলো ছিলÑ ‘শান্তি করো বরিষণ’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আকাশভরা সূর্য তারা’, ও ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’। গানের সুরে পরিবেশিত হয় নৃত্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাচিকশিল্পী ডালিয়া আহমেদ। ৯০টি অধিবেশনে সাজানো এ সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয় ২৩টি অধিবেশন। ১২টায় একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনে লনে মেহেদি হাসান ও তার বন্ধুরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। একই সময় কসমিক টেন্টে প্রদর্শিত হয় জয়া আহসান অভিনীত ও ইন্দ্রনীল রয় পরিচালিত চলচ্চিত্র ভালোবাসার শহর। বেলা ১টায় মূল মঞ্চে বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ফিকশন : হিডেন রিয়েলিটি’ শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন ড্যানিয়েল হান, নিকোলাস লেজার্ড ও আনজুম হাসান ও নায়েল এলতোখি। কেকে টি স্টেজে ইমাজিনিং হিস্টোরি শীর্ষক আলোচনায় সাদ জেড হোসাইনের সঞ্চালনা অংশ নেন সাজিয়া ওমর ও বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী। এ সময় লনে কবিতাপাঠ করেন ব্যান্ড তারকা মাকসুদুল হক ও স্টিভেন পাওলার । বেলা দুটোয় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকার বৈশিষ্ট্য বিষয়ক আলোচনা ‘আমেরিকা : একসেপশনাল নো মোর’। এতে অংশ নেন ভারতের এনডিটিভির প্রধান সম্পাদক সাংবাদিক বারখা দত্ত, মার্কিন কবি জেফরি ইয়াং বেন জোদাহ ও আরব সাহিত্যের কিউরেটর মার্সিয়া লিন্যাক্স কিউলি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্পর্কে বলেন, বিশে^র এক এক জায়গায় এটির এক এক ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় ভুগতে পারে বাংলাদেশ, ইউরোপীয় সামরিক জোট ন্যাটো টিকবে কিনা সেটা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে বর্তমানে যে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছেÑসেটাও ব্যাহত হতে পারে। একই সময় দেশের জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী কেকে টি স্টেজে নিওরোসায়েন্সের এ্যাসথেটিক্স বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সময় লনে সাম্প্রদায়িকতার এপার ওপার নিয়ে আলোচনা করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি জহর সেন মজুমদার, অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান, পশ্চিমবঙ্গের প্রাবন্ধিক সেমন্তী ঘোষ ও আহমেদ রেজা। এই আলোচনায় বক্তারা বলেন, বহুত্ববাদী বৈচিত্র্যময় সত্তা পরিচিতির বিপরীতে একক পরিচয় বড় হয়ে উঠছে আমি ‘ভারতীয় বাঙালি হিন্দু’ বা ‘বাংলাদেশী বাঙালি মুসলিম’। বহুজাতিক পরিচয়কে তুলে না ধরে সবাই হিন্দু মুসলিম পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে উঠছে। এমনটা যতদিন থাকবে পরিস্থিতি ততদিন উন্নতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। বক্তারা আরও বলেন, সাম্প্রদায়িকতা মূলত রাজনৈতিক। একক পরিচয়কে তুলে ধরে যে রাজনীতি এটা ভোটের রাজনীতি। কারণ একক পরিচয়ের ধুয়া তুলে একটা অংশকে আলাদা করে ফেলা হয়। যার ভোট সেই রাজনৈতিক দলের পক্ষে নিশ্চিত হয়ে যায়। এ সময় ব্র্যাক স্টেজে অনুষ্ঠিত হয় ক্রাইম পেজ দ্যা আর্ট অব সাসপেন্স শীর্ষক অধিবেশন। বেলা সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফখরুল আলম আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বিষাদ সিন্ধুর ইংরেজী অনুবাদ ‘ওশান অব সরো’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় লনে কবিতা পাঠ করেন প্রথিতযশা বাংলাদেশী কবিরা। ‘সময়ের কবিতা সময়ান্তরের কবিতা’ শীর্ষক অধিবেশনে কবি আসাদ চৌধুরীর সঞ্চালনায় কবিতাপাঠ করেন কাজী রোজি, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আসাদ মান্নান, শিহাব শাহরিয়ার, কুমার চক্রবর্তী, পাবলো শাহী, মুস্তাফিজ শফি, ওবায়েদ আকাশ, হাসান মাহমুদ, জুয়েল মাজহার, মাহমুদ শাওন প্রমুখ। একই সময় ব্র্যাক স্টেজে অভিনয়শিল্পী ইরেশ যাকের আলোচনা করেন ভারতের প্রাবন্ধিক অন্তরা গাঙ্গুলির বই ‘তনয়া তানিয়া’ নিয়ে। এ সময় বটতলায় ছিল আবৃত্তি পরিষদের কবিতা আবৃত্তি। এদিনের একটি আকর্ষণীয় অধিবেশনে দেখানো হয় ভিএস নাইপলের ওপর নির্মিত বিশেষ ডকুমেন্টারি ‘দ্য স্ট্রেঞ্জ লাক অব নাইপল’। এটি প্রদর্শিত হয় কসমিক টেন্টে। বিকেলে মূল মঞ্চে বারখা দত্তের সঙ্গে আলোচনায় বসেন উৎসব পরিচালক সাদাফ সায্্। আলোচনার বিষয় ছিল বারখা দত্ত রচিত বিতর্কিত গ্রন্থ ‘দ্য আনকোয়াইট ল্যান্ড’। একই সময় ভ্রমণপিপাসু অস্ট্রেলিয়ান লেখক টিম কোপ কেকে স্টেজে আলোচনায় বসেন তার লেখা ‘জার্নি এ্যান্ড কোয়েস্ট অব ইন ট্রুথ’ বইটি নিয়ে। একই সময় পুলিৎজার বিজয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভূত কবি বিজয় শেষাদ্রি আমেরিকার কবিতা নিয়ে ব্র্যাক স্টেজে আলোচনা করেন জেফরি ইয়াংয়ের সঙ্গে। একই সময়ে রিচার্ড বিয়ার্ড লাইভ এডিটিংয়ের ওপর কসমিক টেন্টে বিশেষ ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন। সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় মূল মঞ্চে প্রয়াত সব্যসাচী সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের জীবনী নিয়ে আলোচনা করেন ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ হক, কবি সাজ্জাদ শরীফ, সাহিত্যিক আহমেদ মাজহার ও পারভেজ হোসেন। এ সময় শামসুল হক রচিত নীল দংশনের একাংশ মঞ্চস্থ হয় মূল মঞ্চে । সব শেষে সন্ধ্যার পর বটতলায় বাউলিয়ানা ঘরানার সঙ্গীত পরিবেশন করেন বেশ কয়েকজন লোকসঙ্গীত শিল্পী। আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচী শুরু হবে সকাল ১০টায়। চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। এদিন মূল মঞ্চে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় অনুষ্ঠিত হবে ‘দি রাইটার এ্যান্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড : ভি এস নাইপল’। এতে উৎসব পরিচালক আহসান আকবরের সঙ্গে নিজের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন নোবেলয়ী সাহিতিক্য ভিএস নাইপল। যাত্রিক আয়োজিত ঢাকা লিট ফেস্টে সহযোগিতা করছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এবারের আয়োজনের মূল পৃষ্ঠপোষক ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউন।
×