ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ৮ নভেম্বর ২০১৬

ঢাকার দিনরাত

এ দফায় শনিবার। সারাদিন ধরে ঝরল বৃষ্টি। টিপ টিপ ঝিরঝির, রুমঝুম টুপটাপ। তেত্রিশ ডিগ্রীর উষ্ণ রাজধানীতে ঠাণ্ডার আমেজ নিয়ে এসেছিল সুদূর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপ। তাপমাত্রা নেমে এলো পঁচিশে! এই অকাল ও আকস্মিক বৃষ্টি অবশ্য বহু কর্মব্যস্ত ঢাকাবাসীর জন্য বাড়তি ঝামেলাও বয়ে এনেছিল। শনিবারে সাধারণত শহরে শনির দশা তেমন লাগে না। বলছি যানজটের কথা। কিন্তু এবারের শনিবারটি ছিল ব্যতিক্রম, দারুণ বৃষ্টিমথিত এবং করুণ যানজটের ভজঘটযুক্ত। বিকেল সাড়ে চারটায় বাংলামোটর-কারওয়ানবাজার-পান্থপথে সারি সারি গাড়ি দেখে কে বলবে আজ রবিবার নয়! সন্ধ্যার পর আঁলিয়াসের সামনে থেকে মহাব্যস্ত সড়কটির উত্তর মাথা ২৭ নম্বর ধানম-ি পৌঁছতে পৌনে এক ঘণ্টা! ইস এই রাস্তাটি যদি দোতলা হতো! নাসিরনগর থেকে ঢাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে উপর্যুপরি সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে; স্থানীয় সংসদ সদস্যও উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে আর তার প্রতিক্রিয়ায় ঢেউ আছড়ে পড়েছে রাজধানী শহরেও। প্রতিদিনই বিভিন্ন সংগঠনের পতাকাতলে নানা শ্রেণীপেশার মানুষ সড়কে নেমে আসছেন, প্রতিবাদ-ক্ষোভ জানাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা জনৈক মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। পুরনো ঢাকার শাঁখারিবাজারের বাসিন্দারা প্রদীপ প্রজ্বলন করলেন দলে দলে; শ্রী শ্রী জন্মাষ্টমি উদযাপন পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন মানববন্ধন করেছেন। প্রসঙ্গত কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। ধর্ম-পরিচয়ের ভিত্তিতে দেশভাগের পর মুসলমান ও হিন্দু দুটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বহু মানুষ সীমানার এপার-ওপার স্থানান্তরিত হওয়ার নিয়তি বাধ্য হয়ে মেনে নেন। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশে মুসলমান ও ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তার মানে এ নয় যে আগে থেকে তা প্রতিষ্ঠিত ছিল না। ছিল, কিন্তু দেশভাগের পর মানুষের ওই দেশান্তর আরোপ করা হয়। প্রচ্ছন্ন বলপ্রয়োগও ছিল তাতে। বাংলাদেশ থেকে যেসব হিন্দুর ভারতে যাওয়া হয়নি কিংবা ভারত থেকে যেসব মুসলমানের বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) আসা হয়নি- এই উভয় ধরনের মানুষের মনোজগত আর আগের মতো যে থাকেনি তা বলার জন্য সমাজতাত্ত্বিক হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আবার উভয় দেশের অভিবাসনকারী নাগরিকদের মনের ভূগোলেও পরিবর্তন সাধিত হয়। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘু শ্রেণীর মানুষের ভেতর এক অভিন্ন বোধ জেগে থাকে। বা বলা সঙ্গত প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকে এক বিশেষ বোধ, যাকে বলতে পারি বিপন্নতা বা নিরাপত্তহীনতা (বাংলাদেশ-ভারতের বেলায় শেকড়-উপড়ানো শূন্যতার বোধও); কেবল সামাজিক বা রাষ্ট্রিক বিশেষ পরিস্থিতিতেই তা নিষ্ক্রিয়তা থেকে স্থানচ্যুত হয়। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানী বর্বর হানাদাররা খুঁজে খুঁজে হিন্দুনিধন শুরু করলে সাত পুরুষ ধরে বাংলাদেশে বসবাসকারী অনেক হিন্দুর মনোজগত তছনছ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আবার তাঁদের মনে স্থিতি ও আস্থার বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনে। একাত্তরের আগে, ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারির হামলা ছাড়া বাংলাদেশে খুব জোরালো সাম্প্রদায়িক হামলার দৃষ্টান্ত নেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায়। সে কারণেই আন্তর্জাতিক পরিম-লে বরাবরই বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়েছে। কালে কালে তা ঐতিহ্যেই পরিণত। বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ধর্মভীরু বটে, তবে ধর্মান্ধ নয়। তাছাড়া ইসলাম ধর্মের, শুধু একটি ধর্মের কথাই বা বলি কেন, সকল ধর্মেরই মূল বাণী শান্তি ও মানবকল্যাণ; অপর ধর্মাবলম্বীদের নির্মূল করা নয়। যদিও বিশ্বব্যাপী শান্তির ধর্ম হিসেবে পরিচিত ইসলাম ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ন্যায্য অধিকার দিয়েছে। এই দেশের মাটিতে একাত্তর সালেই বিপুল সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ওপর চূড়ান্ত বর্বর আচরণ হয়েছিল, আর তার উদ্যোক্তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালী সেনাবাহিনী। পাকিস্তান রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সেই বিষম অন্যায় পরিচালিত হয়েছিল। বলা দরকার, তাদের সহযোগিতা করেছিল অল্প কিছু বাঙালী- যারা মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও মূলত তারা ছিল ধর্মব্যবসা বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতিভূ। ধর্মের ভুল দোহাই পেড়ে রাজনীতিচর্চা এবং তার ফলস্বরূপ মানবকল্যাণের উল্টোপথে যাত্রার সূচনা হলেও এদেশের অধিকাংশ বাঙালী মুসলমান বাঙালী হিন্দু, বাঙালী খ্রীস্টান বা বাঙালী বৌদ্ধের ওপর বিধর্মীর দৃষ্টিকোণ থেকে হামলে পড়েনি। স্বাধীন দেশে ধর্মবিচারে জাতিবৈর কখনোই বড় নেতিবাচক উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। বরং কখনও কখনও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ব্যক্তি বা দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয়ে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আশির দশকে ভারতে বাবরী মসজিদ ইস্যুকে এদেশে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ। ঢাকাবাসী হিন্দুদের ভেতর সাময়িক আতঙ্ক ঢোকাতে সমর্থ হয়েছিলেন সেই স্বৈরশাসক। রাজনৈতিক মুনাফা লোটার অপকর্মে অবশ্য তেমন সফল হননি। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি বরাবরই লোকদেখানো কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে ভারতবিরোধিতা এবং যখনই তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, সংখ্যায় খুব ব্যাপক না হলেও, হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে হিন্দুদের ওপর যত আক্রমণ হয়েছে তার প্রায় সবগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের নীতি, ধর্ম সেখানে কোন অনুঘটক নয়। যদিও ধর্মীয় উপাসনালয়ে আগুন দেওয়া হচ্ছে, হিন্দুদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হচ্ছে, লুটপাট হচ্ছে তাঁদের ব্যবসাকেন্দ্রে। মানুষের ভেতরে এখনও মনুষ্যত্ববিরোধী উপাদান রয়ে গেছে এবং ধড়িবাজ রাজনীতিকরা সেটা উস্কে দিয়ে মানব-ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করছে। ২০১৩ সালের নবেম্বরে পাবনার সাঁথিয়ার ঘটনাটি তারই ধারাবাহিকতা। আর চলতি বছরের নবেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও ও নেত্রকোনায় যে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার পেছনের অপশক্তিকে শনাক্ত করাও কঠিন নয়। উপসংহারে বলব, সভ্যতা ও মানবতার স্বার্থে সংখ্যালঘুদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বিশেষ দায় রয়েছে। কেবল বাংলাদেশে নয়, প্রতিটি দেশেই। শাসকশ্রেণীর তো রয়েছেই। বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন অতীতের কারণে একটি অভিন্ন নীতিমালা থাকায় কোন সমস্যা দেখি না। ভারত সর্বোচ্চ মূল্যে সেখানকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধান করবে; সমভাবে বাংলাদেশও তার সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে অভিন্ন নীতি অনুসরণ করবে। ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি এক ধরনের সূক্ষ্ম অপমানসূচক মনে হয় আমার কাছে। সংখ্যা দিয়ে মানুষকে মেপে ফেলার রীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিশ্চয়ই এই দুই দেশের মানুষ একদিন সেই পর্যায়ে যাবে যখন আর শব্দটি ব্যবহারের প্রয়োজনই পড়বে না। যাহোক, সকল নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমাদের সরকারের যা সংবিধানসম্মত। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাঞ্ছনীয় ইতিবাচক বাড়তি পদক্ষেপ গ্রহণ। অস্বীকার করা ঠিক হবে না যে পল্লী অঞ্চলের গ্রাম, পাড়া বা শহরের সড়ক/ মহল্লার বাসিন্দাদের ওপর ন্যস্ত রয়েছে অলিখিত বিশেষ কর্তব্য। রাজনৈতিক দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সে কর্তব্য সাধন করা চাই। এক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের বা সংযোগের কোন বিকল্প নেই। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মুরুব্বি ধার্মিক, সমাজসেবক, সংস্কৃতিকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন পেশার ব্যক্তির একসঙ্গে ওঠাবসার সংস্কৃতি গড়ে তোলা চাই। জ্যেষ্ঠ নাগরিকরা এভাবেই হয়ে উঠবেন অনুজ নাগরিকদের অভিভাবক। শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায়ের লক্ষ্যে নয়, আরো বহু প্রয়োজনে। তাঁদের সম্মিলিত চোখ নজর রাখবে যাতে করে সমাজের কেউ দিকভ্রান্ত পথভ্রষ্ট না হয়; সৃষ্টিক্ষম প্রতিভাকে প্রাণিত করা, অশ্লীল ইচ্ছাকে নিবৃত করাসহ কত কিছুই না আছে তাঁদের করার। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো শত শত মানব চাই প্রতি বর্গমাইলে। এই মহানযজ্ঞে চাই তরুণসমাজের ব্রতচারী সম্পৃক্তি। যত কথাই আমরা বলি না কেন, এখন পর্যন্ত তরুণরাই ভরসা। তাদের মন এখনও যথেষ্ট কলুষতামুক্ত। রাজনৈতিক বিভাজন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি এসব বিষ থেকে মুক্ত থাকার সহজাত হৃদয় নিয়ে তারা অপেক্ষায় আছে দেশ ও দশের জন্য কিছু করার। তাই পাবনার সাঁথিয়ায় সম্প্রীতি বিনষ্টকারী অপশক্তির অপকর্মের পর লেখা আমার ‘অশ্রু ও আগুন’ কবিতাটি এখনও প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। সম্প্রীতির ঘর পুড়ে গেছে পুনরায় গৃহছাই আর চিতাভস্মে পার্থক্য খুঁজো না জমিন না হয় বুনে দেবে গৃহ হারানো বিশ্বাস ফিরে পাবে কি নিস্পৃহ ভাঙা মনে পাবে উপশম সুস্থিতি ক’জনা? ধুলায় গড়ায় সভ্যতার রায়! প্রতিটি অশ্রুর ফোঁটা জমা রাখে অদৃশ্য আগুন আগুনের বক্ষ ফেটে অশ্রু ঝরে শতগুণ অশ্রুসীমাহীন, তবু অবাক আগুন লেলিহান- কিছুতে নেভে না শুভবোধ কেন জবুথবু পড়শিকে বুকে টেনে হে নেবে না? সৃষ্টির অনল কোথা পাই- প্রেমের ক্রন্দন অন্ধকারে জ্বলে ওঠ বাতিঘর সুপ্রীতি নন্দন মন্দিরে আঘাত হেনে যারা পায় সুখ আবাল্য বন্ধুকে যারা করতে চায় ভিটেহীন মানবসন্তান বটে তারা, তবু মনুষ্যত্বহীন আর মস্তিষ্কের কোষে বর্ধমান গভীর অসুখ স্বপ্ন দেখি রুখে দাঁড়াবেই বাংলাদেশ সাথি পাবে সাঁথিয়া’রা, বরিশাল পাবে মিত্র নিশ্চিত নিপাত যাবে বিষ ও বিদ্বেষ পাড়াগাঁয় ফুটবে শতফুল, পাখি গাইবে বিচিত্র... মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় যা বলেছেন তা নিশ্চয়ই শুভবোধে জাগ্রত বহু মানুষেরই মনের কথা। মুনতাসীর মামুন বলছেন, ‘অসাম্প্রদায়িক দলে সাম্প্রদায়িকদের লাইন কেন? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকদের ওপর হামলার যে ঘটনা ঘটেছে, এতে আমরা হতাশ হয়েছি। এ ঘটনার পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমরা গত পঞ্চাশ বছরে কী অর্জন করলাম? সমাজ কেন এতটা বদলে গেল? ১৯৭১ সালে আমাদের মূল স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা পিছিয়ে পড়ছি কেন।’ শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য: ‘বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক হিন্দুদের দোষ দিচ্ছেন। এটা তো আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর কথা হতে পারে না। আমরা আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রীর কাছ থেকে এটা আশা করি না। এটা সাম্প্রদায়িক ও জামায়াতের মন্ত্রীর কথা হবে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর কথা নয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, প্রশাসনের কোন গাফিলতি তিনি দেখেননি। কিন্তু এটা তো হতে পারে না। রামুর ঘটনায় আমরা দেখেছি ঘটনার পরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর দ্রুত সেখানে ছুটে গেছেন। প্রশাসন তৎপর ছিল। ফলে ঘটনার পর আর কোন হামলা হয়নি। রামুতে বিজিবি ও সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু নাসিরনগরে কেন সেনা মোতায়েন করা হয়নি? ফলে এখানে হামলার পর আরও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এখনও আরও হামলার আশঙ্কা আছে। সরকারকে বলব আরও কঠোর হতে। কোন ধরনের ছাড় যেন অপরাধীরা না পায়। নতুন কোন উন্মাদনায় কেউ যেন উন্মত্ত হতে না পারে। কারণ এরই মধ্যে নেত্রকোনায় হামলা হয়েছে। নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।’ ফেসবুক থেকে ফেসবুক এখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। দুই কথাসাহিত্যিক আফসান চৌধুরী ও জাকির তালুকদারের আলোচিত পোস্ট এখানে তুলে দিচ্ছি। আফসান চৌধুরী লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের শেষ ভরসা আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগেরই কিছু লোক নাসিরনগরের ঘটনায় জড়িত। তাহলে কার কাছে যাবে তারা?... আমার ছাত্রী কথা বলতে পারছিল না, কষ্টে উত্তেজনায়। ওর আত্মীয়স্বজন সরাসরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাসিরনগরে। ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা স্যার। সবসময় বলছে দেশে থাকতে। আমি এখানে পড়েছি দেশ ছাড়বো না বলে। কিন্তু এখন কই যাব স্যার। আগে আযান শুনতাম পবিত্র কাজের আগে। এবারে আযান দিয়ে মন্দির ভাঙল। আমাদের ঠিকানা কই স্যার?’ যে কষ্ট তার, যে অপমান ও লজ্জা আমার তার একমাত্র উত্তর দেওয়া যায় প্রতিরোধ করে। এদেশের সংখ্যালঘুদের কোন সক্রিয় সংগঠন নেই, তাই প্রয়োজন সেটাই। হিন্দু ও মুসলমানের যৌথ সামাজিক ও সাংগঠনিক প্রতিরোধ ছাড়া এটা কমবে না। ঢাকায় সেই প্রতিরোধের চেহারা এখনও দেখা যায়নি।’ জাকির তালুকদার লিখেছেন: ‘কে পারবে সাম্প্রদায়িক হামলা ঠেকাতে? নাসিরনগর, নেত্রকোনা, ঠাকুরগাঁ, সোনাগাজী... মাত্র দুইদিনের মধ্যে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। মনে হচ্ছে এটা কোন বড় পরিকল্পনার অংশ। ঘটনা ঘটার পরে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, প্রতিবাদ, চাপান-উতোর, আশ্বাস প্রদান ইত্যাদি চলছে যথানিয়মে। কিন্তু দরকার এটা বন্ধ করা। পারলে চিরদিনের জন্য। পারতেই হবে আসলে। কিন্তু কথা হচ্ছে, করবেটা কে? বা পারবে কে? নিকট এবং দূর অতীতের ইতিহাস বলে, সরকার একা এটা করতে সক্ষম নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পারবে না একা। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগ পারবে না। কারণ তাদের নিজেদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িক সদস্য খুব একটা অল্প নয়। সরকারকে তাই ভিন্ন পথ ভাবতেই হবে। দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কম হলেও আছেন। এরা সরকারকে এই ধরনের কাজে সাহায্য করতে চান। কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এই মানুষগুলো নিজেরা সরকারের কাছে যান না। সরকার তাদের নিয়ে সম্প্রীতি কমিটি গড়ে তুলতে পারেন। তবে সাক্ষীগোপাল কমিটি করলে হবে না। ক্ষমতায়ন করতে হবে জনগণের, তথা শুভবুদ্ধির মানুষদের। ইনাদের সুপারিশ এবং কর্মসূচীগুলোকে পাত্তা না দিলে হবে না। ইনারা দৃশ্যমান ফলাফল চাইবেন। নিজেরা কোন পুরস্কার চাইবেন না। ধান্ধাবাজরা ভাবে, দেশের সব মানুষই তাদের মতো ধান্ধাবাজ। তাই এইরকম মানুষ যে সব জনপদেই কম-বেশি আছেন, তা তারা মানতে চাইবে না। সরকারকেই ঠিক করতে হবে তারা কী চায়!’ মহান মানব ‘কবে আবার এমন একজন মানুষ জন্ম নেবেন বাংলাদেশে! যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন সন্তানের চিকিৎসার জন্য কিংবা অন্য কোন উপলক্ষে তারা বুঝবেন আমার এ-কথার অর্থ কী।’ ডা. এম আর খানের প্রয়াণের পর কবি আবিদ আনোয়ারের এ মন্তব্য ঢাকার বহু মানুষের। শুধু ঢাকাই বা বলি কেন, সারাদেশের অসংখ্য মানুষ অন্তিম শ্রদ্ধা জানিয়েছেন এই মহান মানুষটিকে চোখের জলে। একটি সাক্ষাতকার পড়েছিলাম তাঁর। তাতে চিকিৎসকের কর্তব্য সম্পর্কে কিছু কথাও বলেছিলেন। বলেছিলেন, “ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহীম রোগী আসলে বলতেন, ‘আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ যে আপনি আমার কাছে এসেছেন এবং আমি আল্লাহর কাছেও কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে আপনার সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন।’ আমাদেরও এই দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করা উচিত। একজন রোগীর টাকা নেই বলে সে আমার চিকিৎসা পাবে না এমনটি হওয়া উচিত নয়। কেউ কেউ হয়ত আপনাকে টাকা দিতে পারবে না। কিন্তু দোয়া তো আপনি ঠিকই পাবেন। এই পেশার এটাই একটা মাহাত্ম।” জাতীয় অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ সাতক্ষীরার কৃতী সন্তান ডা. এম আর খান পেনশনের টাকা দিয়ে গড়েন ডা. এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট। দুস্থ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, তাদের আর্থিক-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে এ ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন। তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছে জাতীয় পর্যায়ের শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠা করেছেন শিশুস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। গড়ে তুলেছেন সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল, যশোর শিশু হাসপাতাল, সাতক্ষীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার, রসুলপুর উচ্চবিদ্যালয়, উত্তরা উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালসহ অনেক প্রতিষ্ঠান। এছাড়া তিনি দেশ থেকে পোলিও দূর করতে উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন, কাজ করেছেন ধূমপানবিরোধী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান ‘আধূনিক’-এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে। প্রতিষ্ঠানতুল্য এই মানুষটির জীবনী স্থান পেয়েছে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল হু ইজ হু অব ইন্টেলেকচুয়ালে। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, আন্তর্জাতিক ম্যানিলা এ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক পুরস্কার। সবচেয়ে বড় পুরস্কার রোগগ্রস্ত অসংখ্য নারী-পুরুষের আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ। তাঁর অনুপস্থিতিতে এ শহর অনেকখানি নিঃস্ব হলো- একথা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। ৬ নবেম্বর ২০১৬ [email protected]
×