ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৮ নভেম্বর ২০১৬

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি-

মামলা হচ্ছে আইনের জগতে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। মামলার মাধ্যমে কারও অধিকার খর্ব হলে তা পুনরুদ্ধার করা এবং কোন অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধীকে সাক্ষী-প্রমাণের ভিত্তিতে শাস্তি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই শ্রেণীভুক্ত বহু পরিবার মামলায় জড়িয়ে নিঃস্ব হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। যথাযথ তদারকির অভাবে কারও কারও মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। এতে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। দেশে বিরাজমান এই ধরনের পাহাড় পরিমাণ মামলার জট বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর জোর দেয়া হয় গত কয়েক বছর আগে। লক্ষ্য- বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলে যেমন শত্রুতা কমবে অন্যদিকে সময় ও অর্থ বাঁচবে। সেই ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রশাসন (ইউনিয়ন পরিষদ)সহ বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়। এর সুফলও মেলে। সুফলের একটি চিত্র উঠে এসেছে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক সাম্প্রতিক জরিপে। জরিপের সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ন্যায়বিচার পাচ্ছে। তাদের ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্র্যাকের ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’ (এডিআর) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তালাক বা দেনমোহরজনিত দ্বন্দ্ব, সংঘাতসহ পারিবারিক নানা বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীদের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে সচেতনতার মাধ্যমে নিজের গুরুত্ব উপলব্ধি ও উন্নত জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। এতে সুবিধাবঞ্চিত নারীরা প্রাপ্ত ক্ষতিপূরণ বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করছেন। জরিপে ২০১০ থেকে ২০১১ সালে ব্র্যাকের এডিআর সুবিধাভোগীদের মধ্যে যেখানে স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল ২০ শতাংশ, সেখানে ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। দর্জি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, কারুশিল্প, পশুপালন ইত্যাদির মাধ্যমে যারা জীবিকা অর্জন করেন, তাদের ক্ষেত্রে যেখানে ২০১০-২০১১ সালে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল ৪০ শতাংশ, ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ শতাংশে। উল্লেখ্য, ১৯টি জেলায় ভুক্তভোগী ১৯৩ জন মহিলা ও ১৯৩ জন পুরুষসহ মোট ৩৮৬ জনের ওপর এ গবেষণা জরিপ পরিচালিত হয়। অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর আরও গুরুত্বারোপ এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কার্যকর নেটওয়ার্ক তৈরি, অভিযুক্তকে কাউন্সেলিং করা, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন এবং সরকার ও অধিকারভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের অভিযোগ গ্রহণের জন্য প্রান্তিক মানুষকে সচেতনতা আনয়নে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করা গেলে এই ধরনের মামলার জট আরও দ্রুত কমে আসবে। দেশে উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা কয়েক লাখ। কেবল হাইকোর্ট এবং আপীল বিভাগেই রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ মামলা। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গী, নাশকতা, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধের মামলার স্তূপ পড়ে আছে আদালতে। নিষ্পত্তির অভাবে এই ধরনের অপরাধের বিচার সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। ফলে বাড়ছে জঙ্গী হামলা-সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ অপরাধ। এ বাস্তবতায় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা যদি আইন করে বাধ্যতামূলক করা যায় তাহলে দরিদ্র ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর পারিবারিক মামলার ভিড় আদালত পর্যন্ত পৌঁছবে না। কমে আসবে অন্যান্য মামলা জট। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ব্যবস্থাটি চালু রয়েছে। কথায় কথায় আদালতে যাওয়ার বদলে নিজেদের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করার একটি গ্রহণযোগ্য সংস্কৃতিও গড়ে তোলা দরকার। এজন্য মানুষকে সচেতন করার একটা ভূমিকা তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা পালন করতে পারেন। পাশাপাশি নীতি-নির্ধারকদের আরও সম্পৃক্ত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের এ সংক্রান্ত যে সহায়তা কার্যক্রম আছে তা প্রান্তিক মানুষকে জানাতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে ব্র্যাকের মতো অন্যান্য বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহকে মানবাধিকার ও আইনী সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে।
×