ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ প্রধানমন্ত্রী সমীপেষু

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৬ নভেম্বর ২০১৬

একুশ শতক ॥ প্রধানমন্ত্রী সমীপেষু

গত ১৯ অক্টোবর ২০১৬ সকাল সাড়ে দশটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চতুর্থ ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের উদ্বোধন করেন। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সভাপতি হিসেবে আমি একটি বক্তব্য পেশ করি। প্রধানত দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার গড়ে তোলা ও ২১ সালের মাঝে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির প্রত্যয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বক্তব্য পেশ করার লিখিত রূপটি আমি এখানে তুলে ধরছি। শুরুতে আনুষ্ঠানিক সম্বোধন করে আমি যেসব কথা বলি তাকে যদি সাজিয়ে তোলা হয় তবে সেটি একটি নিবন্ধ তৈরি হবে যা নিম্নœরূপ হতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি আমার কথাগুলো আপনার সামনে উপস্থাপন করছি আমাদের কথা বলার ৩৬ বছরের ধারাবাহিকতা স্মরণ করে। ’৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের দোতলায় দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে যেমনটি কথা বলতাম তেমনটি হয়ত নয় তবে আমি বরাবরের মতোই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে স্পষ্ট কিছু কথা বলছি। কোথাও কোন ত্রুটি হলে আমাকে ক্ষমা করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যে বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি নিজের হাতে বাংলায় টাইপ করে আওয়ামী লীগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠাতেন, আপনি যে ’৯৬ সালের নির্বাচনী প্রচারে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন সেটি অনেকেরই জানা নেই। আপনি যে ২০০৮ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা করেননি বরং ’৯৬ থেকে ২০০১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করেছেন সেটিও অনেকেরই জানা নেই। আমি এই খাতের পক্ষ থেকে আপনার সেই সব অবদানের পাশাপাশি ২০০৯ সাল থেকে পুরো দেশটির সামগ্রিক অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার জন্যও আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি কৈশোর থেকে আপনাকে ও এই দেশটাকে ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটি ২০০৮ সালে আপনি যখন ঘোষণা করেন তখন এটি নিয়ে অন্যরা হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করেছে। আজ তাদের মুখ বন্ধ। কারণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর ইশতেহারের বিষয় নয়, বাস্তবতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি অবগত আছেন, বাংলাদেশ সরকার ও দেশের বেসরকারী তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রধান লক্ষ্য ও অঙ্গীকার হলো ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এই সময়ে দেশের স্বাধীনতারও ৫০ বছর পূর্ণ হবে। তখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রফতানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এর আগে ২০১৮ সালে এই খাতের রফতানি আয় ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে। একই সঙ্গে আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকেও ১০ বিলিয়নে উন্নীত করতে চাই। কারণ, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির বাজার পুরো ইউরোপের চেয়েও বড়। আমাদের সরকার ও বেসরকারী খাতের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা-বিনোদন এবং ১৬ কোটি মানুষের জীবনধারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে সক্ষম। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আমি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কিছু বিষয় নিয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। শুরুতেই তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি নিয়ে কথা বলতে চাই। ’৯৫-’৯৭-’৯৮ সালে আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যে এদেশ থেকে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি রফতানি করব। আপনি আমাদের ওপর আস্থা রেখে কম্পিউটারের ওপর থেকে সকল শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করেছিলেন। আপনার সেদিনের দূরদৃষ্টি সিদ্ধান্তের জন্য আজকে বাংলাদেশ ডিজিটাল রূপান্তরে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমি বরাবরের মতো আপনার কাছে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কিছু বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করছি। ১. তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রফতানি প্রণোদনা : দেশের রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে সরকার মোট ২০টি খাতে শতকরা ২ থেকে ২০ ভাগ পর্যন্ত রফতানি ভর্তুকি/নগদ সহায়তা প্রদান করে। আইটি রফতানিকে উৎসাহিত করার জন্য পৃথিবীর বহু দেশ নির্দিষ্ট হারে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। আমরা আপনার কাছ থেকে ভর্তুকি/নগদ সহায়তার জন্য ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা আকারে রফতানি প্রণোদনা চাই। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবার ওপর প্রযোজ্য ৪.৫% ভ্যাট ও আইটিইএস কোম্পানির জন্য বাড়ি ভাড়ার ওপর প্রযোজ্য ৯% ভ্যাট সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করার আবেদন জানাই। ২. অভ্যন্তরীণ বাজার : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অভ্যন্তরীণ বাজারে সুরক্ষার দাবি জানালে কারও কারও কাছে ধান বানতে শিবের গীত মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশের বাজার অন্যকে ছেড়ে দিয়ে আমরা রফতানিতে সফলতা অর্জন করতে পারি না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা আমাদের নিজেদের বাজারে সরকারী-বেসরকারী সব খাতেই চরমভাবে অবহেলিত। আমার সরকারের কাজ, আমার ব্যাংকের কাজ, আমার শিল্পের বা ব্যবসার কাজ কেন আমি করব না? আমি সারা দুনিয়ার কাজ করি, নেপাল-ভুটান সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর করতে পারি নিজের দেশের কাজ কেন আমি করতে পারব না? অথচ আমরা বিশেষত বিদেশী অর্থায়নে ডিজিটাল রূপান্তরের কাজ করতে নানা বৈষম্যমূলক শর্তের জন্য কাজ করতে পারি না। আমরা যে সফটওয়্যার এক কোটি টাকায় দিতে পারি সেই সফটওয়্যার কোন কোন প্রতিষ্ঠান ৫০ বা ১০০ কোটি টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে কেনে। এই বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা থাকা উচিত যে, দেশে যেসব সেবা বা সফটওয়্যার পাওয়া যাবে তা বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবে না এবং বিদেশী সকল প্রতিষ্ঠানকে কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে কাজ করতে হবে এবং কাজ শেষে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে হবে। ৩. শিক্ষার রূপান্তর : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি অবাক হতে পারেন এটি জেনে যে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতক ডিগ্রী নিয়ে আসা পলিটেকনিক বা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছেলেমেয়েদের সরাসরি কাজে নিযুক্ত করতে পারি না। এর প্রধানতম কারণ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ডিজিটাল যুগের উপযোগী নয়। এর পাঠ্য বিষয়, পাঠদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন ও উপাত্ত ডিজিটাল যুগের জন্য মানসম্মত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পক্ষ থেকে আমরা আপনাকে মানব সম্পদ তৈরিতে বিপুল আকারে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান, কম্পিউটার ও ভাষা ল্যাব তৈরি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি, গবেষণা, আবিষ্কার, উদ্যোক্তা তৈরি ইত্যাদি কাজ করার জন্য অভিনন্দিত করি। আমরা মনে করি, আপনি এর পাশাপাশি দেশের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের হাতে আপনার নির্দেশনা অনুযায়ী পরিকল্পিত উপায়ে ডিজিটাল যন্ত্র তুলে দেয়ার ও সব শিক্ষণীয় বিষয়কে ইন্টারএ্যাকটিভ মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির কাজটিকে ত্বরান্বিত করবেন। আমরা এমন এক খাতে কাজ করি যেখানে মানুষ হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাই দেশের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও মানব সম্পদ উন্নয়ন না হলে আমরা সফল হতে পারব না। ৪. ইন্টারনেট : প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কাছে কৃতজ্ঞতা যে আপনি এই দেশটাকে অনলাইন ইন্টারনেটের যুগে স্থাপন করা ছাড়াও ৩জির যুগে টেনে তুলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে থ্রিজির যুগেও আমরা ইন্টারনেটের ন্যূনতম গতি পাই না-ইন্টারনেট সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মাঝে নেই। আমাদের সন্তানরা গ্রামে বসে কাজ করতে পারে যদি সে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পায়। আমি জানি সরকার ইন্টারনেটের প্রসারে অত্যন্ত যতœবান। কিন্তু প্রিয় নেত্রী তার পরও আমরা কাজ করার মতো ইন্টারনেট পাই না। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ব্যবসায়ী কেউই আমরা ইন্টারনেটের গতি ও মূল্যে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। আপনি আমাদের দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুলভে দিন দেশের প্রতিটি গ্রাম আউটসোর্সিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। অন্যদিকে আমরা দেশে ই-কমার্স নীতিমালা ও ডিজিটাল সার্ভিসেস নীতিমালা চাই, যার সহায়তায় দেশ-বিদেশে লাখো কোটি টাকার তথ্যপ্রযুক্তি বাজার তৈরি করতে পারি। এমন দুটি নীতিমালা ও তার প্রয়োগেই ই-কমার্স ও ডিজিটাল সার্ভিসেস খাতে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানসহ হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ৫. অর্থায়ন : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন একটি শিল্পের বিকাশের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বিনিয়োগ। দুর্ভাগ্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের কোন পথই খোলা নেই। মেধা সম্পদের এই খাতে প্রচলিত ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করে না। দেশে বস্তুত কোন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইক্যুইটি এন্টারপ্রেনরশিপ ফান্ড এখন বন্ধ। আমরা ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছি। ইইএফ ফান্ড চালু করাসহ আমাদের জন্য ২০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ অর্থায়ন তহবিল গঠন করার আবেদন জানাই। ৬. মেধা সম্পদ ও মেধাশ্রম আইন : প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আপনি কেবল ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেননি-৪১ সালে একটি উন্নত দেশ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজের অঙ্গীকারও করেছেন। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ মানেই জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং মেধাভিত্তিক শিল্প। এই দুটির জন্য আমাদের মেধার সুরক্ষা চাই এবং মেধাভিত্তিক শিল্প আইন চাই। কপিরাইট ও প্যাটেন্ট আইনসহ ডিজিটাল রাইটস আইন প্রণয়ন বা নবায়ন ছাড়াও আমাদের জন্য একটি মেধাভিত্তিক শিল্পের জন্য মেধাভিত্তিক শ্রম আইন চাই। ৭. কম্পিউটার বানাব এবং রফতানিও করব : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গত ৬ আগস্ট ২০১৬ ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় বলেছিলেন আমরা দেশে কম্পিউটার বানাব এবং রফতানিও করব। গত ১৪ মাসে আমরা আপনার সেই স্বপ্নের পথে কিছুটা পথ হেঁটেছি। সরকারী প্রতিষ্ঠান টেলিফোন শিল্প সংস্থার বাইরে দেশের অন্যতম বৃহৎ ইলেকট্রনিক কোম্পানি ওয়ালটন এই মেলাতেই দেশীয় ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ প্রদর্শন করছে। আপনি আমাদের হার্ডওয়্যার শিল্পকে গড়তে চান বলে দেশে কম্পিউটারের যন্ত্রাংশকে সম্পূর্ণভাবে শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত করুন এবং সম্পূর্ণ প্রস্তুত কম্পিউটারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভ্যাট বহাল রাখুন। প্রয়োজনে তার ওপর অতি সামান্য শুল্কও আরোপ করা যেতে পারে। একইভাবে দেশ থেকে হার্ডওয়্যার রফতানির ক্ষেত্রেও নগদ সহায়তা প্রদান করুন। আমি আমার ২৯ বছরের তথ্যপ্রযুক্তি জীবনে কখনও দেখিনি যে আপনার কাছে আমাদের কিছু চাইতে হয়েছে। সরকারে থাকুন বা বিরোধী দলে আপনি বাঙালী জাতির জন্য এক স্বর্ণকন্যা। আপনার হাত ধরেই বিশ্বের সেরা একটি দেশে পরিণত হব আমরা। আপনিই গড়বেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা। আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, আপনারও সৈনিক। ঢাকা, ৪ নবেম্বর, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected], www.bijoydigital.com
×