ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি ॥ ধরাছোঁয়ার বাইরে টাম্পাকো মালিক

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২ নভেম্বর ২০১৬

হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি ॥ ধরাছোঁয়ার বাইরে টাম্পাকো মালিক

রহিম শেখ ॥ ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড ইস্যু ও ভুয়া মূসক চালানের মাধ্যমে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে টাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড। চারদলীয় জোট সরকারের সংসদ সদস্য শিল্প উদ্যোক্তা টাম্পাকো ফয়েলসের মালিক সৈয়দ মকবুল হোসেন লেচু মিয়া। সাবেক এ আমলা তৎকালীন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য থাকায় রাজস্ব ফাঁকি দিলেও ক্ষমতার জোরে পার পেয়ে যান। গাজীপুরের টঙ্গী বিসিকের সভাপতি থাকার সুবাদে টাম্পাকো ফয়েলস কোম্পানির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ছিল না কারও। বিএনপি’র এই নেতার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠলেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক বন্ড ইস্যু ও ভুয়া মূসক চালানের প্রমাণাদি রয়েছে জনকণ্ঠের কাছে। গত মাসে এ প্রতিষ্ঠানটিতেই অগ্নিকা-ের ঘটনায় ৩৯ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। যেখানে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো (বিএটি), গোল্ডলিফ, ডার্বি, হলিউড নামের ব্র্যান্ডের সিগারেটের ফয়েল তৈরির উপকরণ তৈরি হতো। এ ঘটনায় ৪টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তবে দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও কোন তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। হতাহতের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হলেও পলাতক রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক মকবুল। জানা গেছে, ১৯৭৮ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জের সৈয়দ মকবুল হোসেন (লেচু মিয়া) টাম্পাকো ফয়েলস শুরু করেন। সৈয়দ মকবুল ১৯৭৫ সালে সরকারের উপসচিবের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে শিল্পোদ্যোক্তা হন। মকবুল হোসেন সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে দুইবার সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রথমবার ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯১ সালের পর তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তিনি অঢেল অর্থ ব্যয় করে পাশ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এক-এগারোর পর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো (বিএটি), গোল্ডলিফ, ডার্বি, হলিউড নামের ব্র্যান্ডের সিগারেটের ফয়েল তৈরির উপকরণ সরবরাহ করত টাম্পাকো। এছাড়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নেস্লের ফয়েল সরবরাহ করতো প্রতিষ্ঠানটি। সেই সুবাদে সহজেই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের পাহাড় গড়ে তুলেন তিনি। হয়ে যান দেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা। একে তো সাবেক উচ্চপদস্থ আমলা অপরদিকে দুই দুইবার সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে বিসিকের অন্যতম নেতা হয়ে ওঠেন তিনি। ফলে টঙ্গী বিসিক এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে ওঠে তার। এত হতাহতের পরও লাপাত্তা এই শিল্পপতি। শুধু বহুজাতিক সংস্থাই নয়, টাম্পাকো দেশের বড় বড় গ্রুপের সঙ্গে ব্যবসা করত। ফলে টাম্পাকোর মাধ্যমে অবৈধ সুবিধা নিয়েছে বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান। দেশী-বিদেশী মোট ৩১টি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে আকিজ গ্রুপ, বিডি ফুডস, মেরিডিয়ান, ফু-ওয়াং, ইউনিভার্সাল ফুডস, আবুল খায়ের গ্রুপ, মোল্লা সল্ট, হক বিস্কুট, এটিএন ফুড, নাবিস্কো বিস্কুট ও আফতাব ফুডস। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, টাম্পাকো ফয়েলস কোম্পানির করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার হলো- ৫১২১০০০৬৫১। ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কোম্পানি এ্যালুমিনিয়াম ফয়েলস ও কর্ক টিপিং পেপার আমদানি করেছে। অসাধু কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে আমদানিকৃত কাঁচামাল রাতের আঁধারে বের করে খোলাবাজারে বিক্রি করেন টাম্পাকোর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কিছু কর্মচারী। এছাড়া বিক্রির সময় কর ফাঁকির অপকৌশল হিসেবে মালামালের সঠিক পরিমাণ কখনও চালানে দেখানো হয়নি। এ্যলুমিনিয়াম ফয়লস ববিন গোল্ডেন ১১৫ মিলিমিটার ২০০০ মিটার ও ৬০ মিলিমিটার ১৫০০০ মিটার এবং কর্ক টিপিং পেপার ৫২ মিলিমিটার ২৪০০ মিটার ও ৫০ মিলিমিটার ও ২৪০০ মিটার থাকার কথা। অথচ এখানে ভ্যাট ফাঁকি দিতে এ্যলুমিনিয়াম ফয়েলস দেখানো হতো ৫৫ মিলিমিটার ১০০০ মিটার এবং কর্ক টিপিং পেপার ৪৮ মিলিমিটার ১৫০০ মিটার। টাম্পাকো ফয়েলস বিভিন্ন ভুঁইফোঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এসব এ্যালুমিনিয়াম ফয়েলস আমদানি করে। টাম্পাকোর চালানপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূসক কপি এবং ডেলিভারি চালানে একই নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কোম্পানির ক্ষেত্রে ভুয়া নাম ব্যবহার করা হয়েছে। ফয়েল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ভ্যাটের ১৫ শতাংশ অর্থ নিয়মিত আদায় করতো টাম্পাকো। এসব কারচুপির মাধ্যমে সরকারের হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া কম দাম দেখিয়ে ভুয়া চালানের মাধ্যমে দেশের বহু কোম্পানির কাছে মালামাল বিক্রি করছে টাম্পাকো ফয়েলস। যেসব কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ভুয়া চালান তৈরি করত টাম্পাকো সেসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রিভার ভিউ এন্টারপ্রাইজ টঙ্গী, এসএইচ ট্রেডার্স উল্লেখযোগ্য। অভিযোগ রয়েছে মূসক ১১ নামের চালানে কম দাম উল্লেখ করে চালান ইস্যু করে প্রতিষ্ঠানটি। আর এ কপি জমা দেয়া হতো উত্তরা সার্কেল-২ এ। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে উত্তরা সার্কেল-২ এর কর অঞ্চলের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, টাম্পাকোর কর ফাঁকির অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। তিনি বলেন, কর ফাঁকিবাজ যেই প্রতিষ্ঠান হোক না কেন আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শিষ্টের পালন ও দুষ্টের দমন নীতিতে বিশ্বাস করে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে টাম্পাকো ফয়েলস’র স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মকবুল হোসেন লেচু মিয়ার ব্যবহৃত মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জের সুন্দিশাইল গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি সেখানে নেই। উপজেলার আমুড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রুহেল আহমদ জনকণ্ঠকে মুঠোফোনে জানান, কারখানায় অগ্নিকা-ের পর মকবুল হোসেন গ্রামের বাড়িতে যাননি। এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শুনেছি তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। টাম্পাকো ফয়েলস’র জেনারেল ম্যানেজার মোঃ শফিকুর রহমানেরও মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, টাম্পাকো ফয়েল কারখানায় গত ১০ সেপ্টেম্বর সকালে বিস্ফোরণে আগুন ধরে যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটির চারটি ভবনের তিনটি ধসে পড়ে। ঘটনার পর একটানা দীর্ঘ ৪ দিন ফায়ার সাভির্সের ২৫টি ইউনিট রাতদিন চেষ্টা চালিয়ে ওই কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের সদস্যরা উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। এ দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন পৌনে ৭৫ জন।
×