ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

বব ডিলানের নোবেল বিতর্কের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২৯ অক্টোবর ২০১৬

বব ডিলানের নোবেল বিতর্কের নেপথ্যে

বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য গোটা সাহিত্য বিশ্ব এবং বিশ্ব সাহিত্যেও হৈচৈ হচ্ছে খুব। বিভিন্ন স্তরে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। শিল্প-সাহিত্যপ্রেমীরা, বিশেষ করে যারা সিরিয়াস লেখক ও পাঠক, তারা এক কথায় হতাশ ও হতবাক! তবে বঞ্চিত ও বিষণœ কী? তা বোধহয় নয়। কেননা, বিদগ্ধ ও প্রকৃত কবি-সাহিত্যিকরা নিজেদের আবেগ-অনুভূতি সংযত ও সংহত করতে জানেন। এবং এও জানেন যে, সিরিয়াস সাহিত্যের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরল ও জনগণমনরঞ্জনকারী এবং বিনোদনক্ষম শিল্প-সাহিত্যের একটি ধারাও পাশাপাশি চিরকালই প্রবহমান। অধিকাংশ আমজনতা সব দেশে সর্বকালে সর্বদাই এহেন শিল্পরসে নিমজ্জিত ও গুণমুগ্ধ। এবার বব ডিলানকে নোবেল দেয়ায়, বিশেষ করে সাহিত্যের জন্য, বিশ্বের তাবত আমজনতা, তাদেরও অধিকাংশ পাঠক নয়Ñ দর্শক-শ্রোতা নিঃসন্দেহে সবিশেষ খুশি হয়েছে; চাই কী আনন্দে বিভোর ও হতবিহ্বল। কেননা, বব ডিলান মূলত গায়ক, পপ গায়ক, গীতিকার এবং অধুনাতন কবি অভিধায় ভূষিত হলেও মূলত তিনি একজন পারফরমার, এনটারটেইনার এবং কিছু ক্ষেত্রে এক্টিভিস্ট। যেমন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক প-িত রবিশংকর এবং আরেক বিখ্যাত পপস্টার জর্জ হ্যারিসনের অনুরোধে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ অথবা, মার্কিন সরকারের যুদ্ধংদেহী ও যুদ্ধবাদী মনোভাব ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে; কানাডার রুবিন কার্টারের মিথ্যে ফেঁসে যাওয়া নিয়ে হৃদয়ছোঁয়া গল্পগাঁথা হ্যারিকেন, সর্বোপরি মানবতা ও মানবাত্মার নিপীড়ন বঞ্চনা শোষণ হাহাকার ও আর্তনাদের বিরুদ্ধে সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার ও উচ্চকণ্ঠ। আর সেজন্যই বলেছি যে, বব ডিলান মূলত একজন এ্যাক্টিভিস্ট, গায়ক ও সক্রিয় মানবাধিকারকর্মী, যিনি গান তথা সঙ্গীতের মাধ্যমে, প্রতিবাদী কথা ও সুরের মাধ্যমে সর্বদাই মুক্তিকামী মানুষের কথা উচ্চারণ করেছেন সুবৃহৎ জনসমাবেশে, দীর্ঘবাদনে, গিটার ও হারমোনিকা সহযোগে। এর বাইরেও তিনি প্রচুর প্রেমের গানও লিখেছেন, যেগুলো অপূর্ব গীতল তথা লিরিক্যাল, সুরমূর্ছনায় ভরপুর, রসে টইটম্বুর সর্বোপরি হাহাকার ও বেদনা-বিষণœতায় ভরা। এসব গানও নিঃসন্দেহে দর্শক-শ্রোতার হৃদয়-মনে প্রবল দোলা দিয়ে যায়, মনপ্রাণ আপ্লুত করে নিঃসন্দেহে এবং আর্তি ও অনুভূতিগুলো কেবলই বয়ে যায় মৃদুমন্দ বাতাসে, কখনও বা ঝড়ো উন্মাতাল হাওয়ায়। এসব ক্ষেত্রে বব ডিলানের সিদ্ধি ও প্রসিদ্ধির ব্যাপকতা ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে দ্বিমত পোষণ অথবা সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তবে শিল্প-সাহিত্যের চিরকালীন আবেদন, নন্দনতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, গভীরতা, আত্মোপলব্ধি, সর্বজনীনতা ও বিশ্বজনীনতার কথা যদি ওঠে, এবং সাহিত্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার ও সম্মান নোবেল পুরস্কারের ক্ষেত্রে অনিবার্য উঠবেই, তাহলে বব ডিলানের বিষয়টি নিঃসন্দেহে নানা বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দেবে। এবং এক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। আর সে কারণেই গত কয়েক বছর ধরে নোবেল কমিটির কাছে বব ডিলানের নামটি সাহিত্যের জন্য নির্বাচিত গ্রন্থ তালিকায় এলেও তারা কখনই নিঃশঙ্ক ও নিশ্চিত ছিলেন না তাকেই পুরস্কারটি দেয়ার ব্যাপারে। এবং শেষ পর্যন্ত এবার যখন দেয়া হলোই, তখন তার স্বপক্ষে সাফাই গাইতে হলো সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ড্যানিয়ুসকে। বব ডিলান, যে ব্যক্তিকে গোটা বিশ্ব একবাক্যে একজন জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে চেনে-জানে, তার নাম ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই যে হতবাক, হতবিহ্বল হবেন, একই সঙ্গে বিস্ময়বিমূঢ় ও হতাশ, এমনকি নোবেল কমিটির ওপর বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ, সে সম্পর্কে তারা বিলকুল অবগত ছিলেন। আর তাই আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতে বাধ্য হয়েছেন, ডিলানকে বেছে নেয়া বিস্ময়কর মনে হতে পারে বটে, তবে পেছন ফিরে তাকালে আপনারা দেখতে পাবেন গ্রিক কবি হোমার, সাফো প্রমুখ যা লিখেছেন, সেগুলো একই সঙ্গে কবিতা ও গান। পড়া ও শোনার জন্য। মাঝে মধ্যে যন্ত্রানুসঙ্গে। বব ডিলানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাকে পড়াও যায় এবং পড়াই উচিত। ইংরেজী সাহিত্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি এক মহান কবি। সচিব মহোদয় ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক, ডিলান টমাস প্রমুখের কথাও বলেছেন বটে। বব ডিলানের গানের, কবিতার একাধিক সংকলন, গদ্য কবিতার সংকলন টারানটুলা, আত্মজীবনীমূলক রচনাত্রয়ী ত্রুনিকলসের কথা স্মরণ করেও আমরা বলব, পাঠকের চেয়ে বেশি শ্রোতা কিন্তু বব ডিলানের গানই অনেক বেশি শোনে ও আপ্লুত হয়; আনন্দিত ও একাত্মতা অনুভব করে তার সঙ্গে। বরং এই মুহূর্তেও আরও অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ কবি-সাহিত্যিক আছেন, যাদের বই অনেক বেশি পাঠকপ্রিয় বব ডিলানের তুলনায়। মূলত এসব কারণেই আরও বেশি বিতর্ক ও সমালোচনা। নোবেল কমিটি বলেছে, বব ডিলানকে পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে জুরি বোর্ডের সদস্যরা প্রশ্নাতীত মতৈক্যে পৌঁছেছেন। তবে ১৮ জনের কতজন কোনদিকে কী মত দিয়েছেন এবং আর কার কার নাম এবারের তালিকায় বিবেচনাধীন ছিল, তা জানা যাবে না বোধকরি কোনদিন। বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাতকারে বব ডিলান নিজেই বলেছেন, আই এ্যাম নট এ পোয়েট, আই এ্যাম এ ট্র্যাপিজ আর্টিস্ট..., আমি অন্যের জন্য গান লিখি না, লিখি নিজের জন্য... ইত্যাদি। বিচারের আরও একটি দিক অবশ্যই আলোচ্য। সুইডিশ একাডেমি বলেছে, এই পুরস্কার দেয়া হচ্ছে আমেরিকার মহান সঙ্গীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক অভিব্যক্তি সৃষ্টির জন্য। তিনি আমেরিকার লোকসঙ্গীত ও পল্লীসঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করেছেন, ভেঙ্গে-চুরে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। এটুকই বা কতটুকু সত্য? তাহলে পিট সিগার, পল রবসন, ল্যাংস্টন হিউজ, উডি গাথরি ও অন্যদের অবস্থান কোথায়? বব ডিলান বিভিন্ন সাক্ষাতকার ও স্বীকারোক্তিতে নিজেই বলেছেন, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, জন লেনন, উডি গাথরি, ব্লুজ গায়ক রবার্ট লেরয় জনসনসহ আরও অনেকের নাম। আত্মজীবনী ক্রনিকলসে বব ডিলান লিখেছেন, জন লেনন আমার গানের ভেতর ব্লুজ, বিলি কিং খ্যাত জ্যাজ এবং ফোকের ঐতিহ্যের ধারা খুঁজে পেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে স্বভাবতই উঠে এসেছে বিটলস, রক, ব্লুজ, রোলিং স্টোনের কথাও। বস্তুত মনে রাখতে হবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বহু ও বিচিত্র ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির প্রায় অবাধ চারণভূমি এবং তাদেরই একজন সমজ্জ্বল প্রতিনিধি বব ডিলান। তিনি নিজেও উত্তরাধিকারসূত্রে একজন অভিবাসী মার্কিন ইহুদী এবং ইসরাইল ও স্বধর্মের প্রতি তার রয়েছে ষোলআনা পক্ষপাত। মার্কিন সিভিল রাইটস বা মানবাধিকার আন্দোলন এবং এর সাঙ্গীতিক প্রতিবাদের পেছনেও রয়েছে আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আগত ক্রীতদাসদের অসহায় করুণ মর্মন্তুদ আর্তনাদ, হাহাকার, বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়ন, অকথ্য অবর্ণনীয় অত্যাচারের নীরব ও সরব প্রতিবাদ, হুঙ্কার এমনকি গভীর গোপন দীর্ঘশ্বাস, বুক নিংড়ানো সকরুণ কান্না ও সুরমূর্ছনা। সর্বোপরি আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের উৎখাত জনিত অশ্রুপাত ও শাপমোচন। নোবেল কমিটি তার সংক্ষিপ্ত ধারাভাষ্যে যদি বিষয়টি যৎসামান্য উল্লেখ করত, তাহলে নিঃসন্দেহে আরও ভাল হতো। বব ডিলানকে নোবেলপ্রাপ্তিতে আমরা শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালবাসা জানাব নিশ্চয়ই। তবে অতীতের সকরুণ ইতিহাস ও ঐতিহ্যটি যেন আমরা কখনই ভুলে না যাই। আশা করি ভুলবেন না কবি ও সঙ্গীতশিল্পী বব ডিলানও। গত ১০৯ বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে বব ডিলানের অবস্থান ১১৩তম। উল্লেখ, তিনি প্রধানত একজন গায়ক ও গীতিকার, সর্বোপরি পারফর্মার, এক্টিভিস্ট, মানবতাবাদী। নোবেল কমিটি যে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী গায়ক হিসেবে সুপরিচিত একজনকে সাহিত্যের জন্য নোবেল দিচ্ছে এবং এর জন্য সঙ্গতকারণেই বহু বিতর্ক ও সমালোচনা হতে পারে, এর জন্য প্রস্তুত ছিল সর্বতোভাবে। আর এ জন্যই সচিব মহোদয় সাফাই গেয়েছেন, বব ডিলানকে গীতিকার ও কবি হিসেবে পড়া উচিত ও আবশ্যক। তবে বাস্তবতা হলো ডিলান ভক্তরা তাকে পড়বে না; বরং শুনবে, বার বার শুনবে এবং রোমাঞ্চিত ও শিহরিত হবে এবং অবাক বিস্ময়ে মেনে নেবে যে, তাদের অন্যতম একজন প্রিয় গায়ক সম্মানিত হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারে। বব ডিলানের সমর্থনে প্রসঙ্গত সাফো, হোমার এবং আরও কোন কোন কবির নাম এসেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, একবারও উচ্চারিত হয়নি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম। সত্য বটে, মাঝে-মধ্যে ইংরেজী ও জার্মান ভাষায় আজও কিছু কিছু রবীন্দ্রচর্চার খবরাখবর মিললেও, (বর্তমানে চীনা ভাষায়ও) সুইডিশ কিংবা নরডিক ভাষায় বোধকরি রবীন্দ্রচর্চা ও প্রসঙ্গ প্রায় অনুপস্থিত। তা না হলে সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ড্যানিয়ুস এই কাঁচা ভুলটি করতেন না কিছুতেই। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথকে যখন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় এবং এর মাধ্যমে ইউরোপে কবির কাব্যপ্রতিভা হয় প্রতিষ্ঠিত, তখন তিনি প্রধানত পরিচিতি পেয়েছেন গীতাঞ্জলির কবি হিসেবেই। এ সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে রবীন্দ্রনাথের অন্যবিধ কিছু কবিতা ও গদ্য ইংরেজীতে অনুদিত হলেও, তার পরিমাণ ছিল যৎসামান্য। বরং গীতাঞ্জলি বা সং অফারিংসের গুটিকতক, অনুর্ধ পঞ্চাশটি গান, পরবর্তীকালে নোবেলপ্রাপ্ত আরেক বিশ্বখ্যাত কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে অনুদিত ও পরিমার্জিত হয়ে আরেক বিখ্যাত ইংরেজ ভাস্কর রোদেনস্টাইনের জোরালো সুপারিশ সমেত পৌঁছে যায় সুইডিশ নোবেল কমিটির কাছে। ঘটনার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে আরও। ইয়েটসের আগে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায় পরে সেই সুসম্পর্ক আর বজায় থাকেনি তার সঙ্গে। এ থেকে সাহেবদের পরশ্রীকাতরতার একটি নমুনা পাওয়া যায় বৈকি। বর্তমান সুইডিশ নোবেল কমিটি তাদের ওয়েবসাইটে গেলে এ সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানতে পারতেন এবং বলতে পারতেন যে, প্রথমবারের মতো শুধু বব ডিলানকে নয়, বরং ইতোপূর্বে কবি ও গীতিকার হিসেবে সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে। সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই লিখছি, গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি তথা সমগ্র গীতবিতানের সমতুল্য কোন ‘গানের বই’ শুধু বিশ্বসাহিত্য কেন, বিশ্ব ব্রম্মা-েও নেই এবং মানুষ যদি কোনদিন বসবাসের অযোগ্য (!) এই পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গলগ্রহ অথবা অন্য কোন গ্ল্যালাক্সিতে পা বাড়ায়, তবে তাকে অন্তত একটি ‘গীতবিতান’ নিলেও চলবে। একই সঙ্গে সুর-সঙ্গীত ও কথার এমন গভীর ও আত্মিক মহামিলন পৃথিবীর খুব কম সঙ্গীতেই পাওয়া যায় অথবা পাওয়া যায় না বললেই চলে। এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত তথা গানের কথা উদ্ধৃত করে বক্তব্যের সারবত্তা প্রমাণের চেষ্টা বৃথা বর্ধিত কলেবরের ভয়ে। সাহেবরা যে রবীন্দ্রনাথকে জানে না, বোঝে না, সেটা তাদের দুর্ভাগ্য। আর আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে দূরে সরিয়ে রাখি, সেটি নিতান্তই অজ্ঞতাসঞ্জাত। বব ডিলানকে বলা হয়েছে মানবতাবাদী, মানবাধিকারকর্মী। ভাল কথা। তবে মনে রাখতে হবে যে, এ দেশেরই একজন চারণ কবি বড়ু চন্ডীদাস সেই মধ্যযুগে ঘোষণা করেছিলেন, শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।... মানবতাবাদী, মানবসভ্যতা ও যুদ্ধবিরোধী শান্তির শাশ্বত ললিত বাণীর এমন অমোঘ উচ্চারণ বিশ্বের অন্য কোন সাহিত্যে এত সুলভ ও সহজ কিনা, তা অন্তত আমাদের জানা নেই। প্রসঙ্গত লালনের কথা আর নাই-বা বললাম। আমরা জানি, বব ডিলানও ছেঁড়াফাড়া জিনসের প্যান্ট, রংবেরঙের তাপ্পিমারা ব্লেজার এবং দোমড়ানো হ্যাট মাথায় হাতে গিটার ও হারমোনিকা সহযোগে একজন স্বভাবসুলভ চারণ কবি। কিন্তু বাংলার বাউলদের মতো একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত, দারিদ্র্যপীড়িত চারণ কী, যারা যথার্থই সুফী-ফকির-দরবেশ- মুসাফিরের সঙ্গে তুলনীয়। বেশি কী বলব কিংবা লিখব, বাংলার বাউলরা যে কিছুই চান না এবং পান না। প্রত্যাশাও করেন না। এ রকম স্বভাবচারণ কী কেউ কোনদিন কখনও মার্কিনমুলুকে অথবা ইউরোপে হতে পারবে? উপসংহার টানি অবশেষে। এই লেখার উদ্দেশ্য বব ডিলানকে ছোট কিংবা বড় করা নয়, তিনি স্বমহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বপ্রতিষ্ঠিত, মহান সঙ্গীতজ্ঞ ও কবি। মহৎও বটে। এই লেখা পর্যন্ত নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে যোগাযোগের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে তিনি কোন কথা বলেননি। পাবলিক কনসার্টে অংশগ্রহণ করলেও মুখ খোলেননি মিডিয়ার কাছে। বরং মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বিনয় তো মহৎ মানুষকেই মানায়। সর্বশেষ, স্বদেশে ও বিদেশে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত ১০ ডিসেম্বর বব ডিলান স্টকহোমে স্বশরীরে উপস্থিত থাকবেন কিনা, নোবেল পুরস্কার ও পদক গ্রহণের জন্য! নোবেল পুরস্কার তার কৌলিণ্য ও গৌরব হারিয়েছে অনেক আগেই। তলস্তয় কিংবা গান্ধী নোবেল পাননি। তাতে তাদের কিছু হয়নি, ম্লান হয়েছে নোবেল। এস্টাব্লিশমেন্ট ও প্রথাবিরোধী গায়ক-কবি হিসেবে বব ডিলানও পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতেই পারেন। তাতে তার গৌরব ও মহত্ত্ব বাড়বে বৈ কমবে না। তবে নোবেলে টাকার অঙ্কটাও বিশাল, লোভনীয়। অতঃপর একজন চারণ কবি ও গীতিকার হিসেবে দেখা যাক, বব ডিলান কী করেন? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে বব ডিলানকে জানাই অভিনন্দন ও অভিবাদন।
×