ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনা কি একনায়ক? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৭ অক্টোবর ২০১৬

শেখ হাসিনা কি একনায়ক? -স্বদেশ রায়

বিদেশী এক সম্পাদক বন্ধু আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি কি মনে কর না শেখ হাসিনা একনায়কতন্ত্র চালাচ্ছেন? আসলে তিনি প্রকৃত গণতান্ত্রিক নন? তাকে বলি, দেখ আমি ঠিক এমন মনে করি না। তাঁর সঙ্গে দ্বিমত হওয়ায় সে বলে, তোমার যুক্তি কি? আমি তাকে বলি- দেখ, তুমি পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাস ও অবস্থান আমার থেকে ভাল জানো। তুমি নিশ্চয় স্বীকার করবে, বাংলাদেশ এখনও সামরিক শাসনের লিগ্যাসি বয়ে চলেছে এবং এটাও ভালভাবে জানো, এই লিগ্যাসির শেকড় অনেক গভীরে। দেশটির সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন, সমাজ ও সমাজের সাধারণ মানুষের সাইকোলজি, এমনকি সিভিল সোসাইটির মেন্টাল ডেমোগ্রাফি সব কিছুকেই এখনও অবধি আচ্ছন্ন করে রেখেছে মিলিটারি কালচারে- যা এই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের জীবনকে সুস্থির হতে দিচ্ছে না। মিলিটারি কালচারের কারণে এখানে দক্ষতার থেকে অর্থ ও আনুগত্য বড় হয়ে দেখা দেয় প্রতিক্ষেত্রে। তাছাড়া সিভিল, মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি, সিভিল সোসাইটি- তারা সকলে রাষ্ট্রের কাছে একটি অনৈতিক স্টেক চায়। এই কালচারটি সামরিক শাসকরাই তৈরি করে দিয়ে গেছে। শুধু এই একটি বিষয় থেকেই বোঝা যায়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতির বাইরে কতগুলো অলিখিত স্টেক হোল্ডার আছে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ১৬০ মিলিয়ন (১৬ কোটি) মুসলিম। বাংলাদেশের মুসলিমরা সহজিয়া, উদার। সত্যি অর্থে পীর, দরবেশ, বাউল- এদের দ্বারা সৃষ্ট সহজিয়া ও গ্রহণমূলক মানসিকতাই বাঙালী মুসলিমের জীবনাচরণ। কিন্তু তার পরে এ সত্য মানতে হবে, বর্তমান বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ মুসলিম মানসের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। যে পরিবর্তন থেকে রাষ্ট্রের জন্য মাঝে মাঝে হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে এক শ্রেণীর মুসলিম তরুণ- যারা নিজেদের পরিবর্তিত করছে জঙ্গীতে। কিছু তরুণ যেমন সরাসরি জঙ্গী হচ্ছে, জঙ্গী অপারেশনে মৃত্যুবরণ করছে তেমনি এদের ছাপ পড়ছে অবচেতনভাবে অনেক মুসলিম তরুণের ভেতর, বিশেষ করে কিশোরদের ভেতর। যে তরুণ ও কিশোরদের ওপর জঙ্গী মানসিকতার প্রভাব পড়ছে তাদের ফেরানোর জন্য সফট ম্যানেজমেন্ট কার্যকরী কিন্তু যারা জঙ্গী অপারেশনে নামছে তাদের জন্য? এর পরেই আসে বিশ্ব টেররিস্ট হাব পাকিস্তানের অধিকতর দৃশ্যমান উপস্থিতি বাংলাদেশে। সত্যি অর্থে বাংলাদেশের একটি বড় অংশের রাজনীতিতে, জনগণের মানসিক ডেমোগ্রাফিতে, ব্যবসা এবং সিভিল সোসাইটিতে পাকিস্তান গেড়ে বসে আছে। অন্যদিকে এই পাকিস্তানেরই টেররিস্ট সংগঠনগুলোর একটি বর্ধিত অংশ বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল। এবং পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশেই বৈধ রাজনৈতিক দল আছে যারা জঙ্গীকে অনুমোদন করে এবং জঙ্গী তৈরি ও প্রশ্রয় দেয়। এই দলটির গোটা রাজনৈতিক জোটটাই বস্তুত পাকিস্তানী জঙ্গী সংগঠনগুলোর বাংলাদেশস্থ শাখা। এরা গত সাড়ে সাত বছরে জঙ্গী অপারেশনের পাশাপাশি যে আকারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে, মানুষ হত্যা করেছে প্রকাশ্যে ও গুপ্ত হামলায় তা পৃথিবীর যে কোন একটি ছোটখাটো গেরিলা যুদ্ধের সমান। মোটা দাগে এই উদাহরণগুলোর সত্যতা যে কেউ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করলে দেখতে পাবে। এর কোনটাই বিন্দুমাত্র অসত্য নয় বা ফেবরিকেটেডও নয়। এখন শেখ হাসিনাকে এগুলো কন্ট্রোল করে রাষ্ট্র চালাতে হচ্ছে। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসিতে যে মিলিটারি শাসনের লিগ্যাসি আছে সেটাকে যে কোনভাবে হোক কন্ট্রোল করতে হচ্ছে। কন্ট্রোল করতে হচ্ছে এক শ্রেণীর সাধারণ মানুষ ও সিভিল সোসাইটির ভেতর যে মিলিটারি শাসনের লিগ্যাসি আছে সেটা। অন্যদিকে গোটা মুসলিম বিশ্ব যেখানে টালমাটাল সেই সময়ে ষোলো কোটি মুসলিমকে একটি ন্যূনতম প্রোগ্রেসিভ ধারার ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে- এ জন্য কখনও সফট ম্যানেজমেন্ট কখনও বল প্রয়োগ দুই পথই তাঁকে নিতে হচ্ছে। এর পরে আসে পাকিস্তানের উপস্থিতি- পাকিস্তানের এই উপস্থিতি যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এ জন্য কখনও যেমন তাকে বল প্রয়োগ করতে হচ্ছে, কখনও আবার তাদের কৌশলে চেপে রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠনের বর্ধিত অংশ হিসেবে যে রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে বার বার তাদেরকে তিনি বল প্রয়োগ করে, আইনের মাধ্যমে তালুবন্দী করতে সমর্থ হয়েছেন। তারা এখন মোটামুটি ঘরে উঠে গেছে। তাই ছোট পরিসরেও এভাবে বাংলাদেশের বাস্তবতা যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশে প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তি ছাড়াও আরও অনেক প্লেয়ার আছে যারা রাষ্ট্রকে নানা কাজে ব্যবহার করতে চায়। শেখ হাসিনাই প্রথম নেতা যিনি এদের কন্ট্রোল করতে পেরেছেন। পেরেছেন বলা যাচ্ছে এ জন্য যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির বাইরে এতগুলো প্লেয়ার থাকা সত্ত্বেও তিনি উন্নয়নের ধারাকে প্রবাহিত করতে পেরেছেন- যা প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে যাচ্ছে। আবার এখানে একটি বিষয় সত্য, উন্নয়ন বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের অবস্থানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজটি সত্যিকার অর্থে শেখ হাসিনাই প্রথম শুরু করেছেন। আবার যে কোন দেশের উন্নয়নের কিছু ন্যাচারাল বাধা ও কিছু বিদেশী বাধা সব সময়ই থাকে। কোন দেশ যখনই শিল্পায়িত হতে যায় তখনই তার সমাজ ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন দেখা দেয়, প্রসব বেদনার মতো উন্নয়নেরও একটি বেদনা সহ্য করতে হয়। সমাজের সাধারণ মানুষ হঠাৎ করে সমাজ ব্যবস্থার এই পরিবর্তনকে মানতে পারে না। তারা এক ধরনের বিরক্ত আবার কখনও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এর পাশাপাশি থাকে উন্নয়নের বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা ও মানসিকতা। এখানেও অনেকে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে কোন দেশের উন্নয়ন যদি অন্য কোন বিদেশী রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তারাও তখন তৎপর হয় ওই উন্নয়ন ঠেকাতে। আবার নষ্ট রাজনীতিক বা অন্য কোন ধরনের প্লেয়াররা এই ধরনের একটি ঝড়ের ভেতর আম কুড়ানোর চেষ্টা করে। তারা তখন উন্নয়নের বিরুদ্ধে মানুষকে ঠেলে দিয়ে একটা নৈরাজ্য তৈরি করতে চায় দেশে। বিদেশী সাহায্য নিয়ে এ কাজ করে। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে তার ব্যতিক্রম নয়। তাই শেখ হাসিনাকে এটাও কন্ট্রোল করতে হচ্ছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রথম রাজনীতিক। তিনি এসব প্লেয়ারকে মোকাবেলা করে, তাদের তালুবন্দী করে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। এর পাশাপাশি আরও দুটো বিষয় ঘটছে, এই উন্নয়নের জন্য যে স্থিতিশীলতা দরকার তা সৃষ্টি করার জন্য শেখ হাসিনাকে আরও বেশি কঠোর হতে হচ্ছে। অন্য দিকে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার দলে বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলে এমন কোন নেতা নেই যিনি উচ্চতায় শেখ হাসিনার অর্ধেক। এ কারণেও শেখ হাসিনা অনেক বেশি দৃশ্যমান। বাংলাদেশ ও পৃথিবীজুড়ে তার উপস্থিতি অনেক বেশি। আবার নিজ যোগ্যতায় এসব প্লেয়ারকে তালুবন্দী করে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা এ পর্যায়ে এনেছেন- যা পূর্ব এশিয়ার অথোরেটিয়ান নেতারা তাদের দেশকে উন্নয়নের জন্য যে স্থিতিশীলতা এনেছিলেন তার সমান। এ জন্য সাধারণ চোখে শেখ হাসিনাকে কেউ একনায়ক মনে করে বসতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনাই প্রথম ও একমাত্র গণতান্ত্রিক নেতা যিনি বাংলাদেশের মিলিটারি শাসনের লিগ্যাসির সৃষ্ট যাবতীয় প্লেয়ার ও উন্নয়নবিরোধী ন্যাচারাল এবং ষড়যন্ত্রকারী সব প্লেয়ারকে মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। [email protected]
×