ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নৌকা দিয়ে সাজানো রিক্সা চালিয়ে গোপালগঞ্জ থেকে সম্মেলনে নূরু মিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

নৌকা দিয়ে সাজানো  রিক্সা চালিয়ে  গোপালগঞ্জ থেকে  সম্মেলনে  নূরু মিয়া

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ভোরের আলো ফুটতেই উদ্যানের প্রতিটি ফটকে নেতা-কর্মীদের দীর্ঘ লাইন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা হচ্ছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। অপেক্ষার প্রহর শেষে আর্চওয়ে পেরিয়ে তারা ঢুকছিলেন উদ্যানের ভেতর। দেহ তল্লাশি শেষে মূল মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সে কি উচ্ছ্বাস। নির্ঘূম রাত আর ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলে আগত নেতাকর্মীদের মুখে এক অন্য ‘হাসি’। ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে কারও কারও অস্ফুস্ট উচ্চারণÑ ‘গর্বিত’। আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের এ এক খ-চিত্র। রাস্তায় আসার পথে নেতাকর্মীদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান ঢাকার নেতাকর্মীরা। ভেতরে প্রবেশের পর নির্দিষ্ট আসন। অঞ্চল ভিত্তিক আসন বিন্যাস। যার আসন যেখানে, তাকে সেখানেই বসতে হবে। দেশী-বিদেশী অতিথিদের জন্য আলাদা স্থান। নির্দিষ্ট স্থান ছিল কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের। সকাল ৯টার আগেই প্রতিটি আসনে এসে বসেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। পরে আর ফাঁকা ছিল না কোন আসন। ত্রিপল দিয়ে ঘেরা স্থানেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে অনেককে। ১০টার পর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় উদ্যানের চতুর্দিক। সম্মেলন উপলক্ষে শুক্রবারই ঢাকায় এসেছেন কিশোরগঞ্জের তৌফিকুল হক অনু। রাত কাটিয়েছেন ফকিরাপুলের একটি হোটেলে। ভোরের আলো ফুটতেই ছুটে আসেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কাউন্সিলর হয়ে আসা অনুর সঙ্গে কথা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বহুবার সম্মেলনে এসেছি। এবারের আয়োজন নজর কেড়েছে সবার। বলতে গেলেÑ এ এক বর্ণিল আয়োজন। সবকিছুই অত্যন্ত সুশৃঙ্খল।’ প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে এসেছেন জামালপুরের ফিরোজ আলী। তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। ইতিহাসের অংশ হতে পেরে উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে এই তরুণ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অত্যন্ত সুশৃঙ্খল আয়োজন সবার নজর কেড়েছে। প্রথমবারের মতো জাতীয় সম্মেলনে অংশ নিতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছে।’ এই তরুণের প্রত্যাশা, কাউন্সিলরদের ভোটে আগামী দিনের সঠিক নেতৃত্ব পাবে আওয়ামী লীগ। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। ঠিক দশটায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করেন। নৌকা আকৃতির বিশাল মঞ্চে উঠে হাত নেড়ে তিনি যখন শুভেচ্ছা জানালেন, তখন পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রকম্পিত হয়ে উঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ সেøাগানে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে যান মঞ্চের সামনে ডানদিকে জাতীয় পতাকার স্ট্যান্ডের পাশে। কাছেই আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকার স্ট্যান্ড। সেটির পাশে দাঁড়িয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। আগে থেকেই ৭৩টি সাংগঠনিক জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক একেকটি স্ট্যান্ডের সঙ্গে দাঁড়িয়ে। ঠিক মঞ্চের সামনে ততোক্ষণে স্থান করে নিয়েছেন লাল-সবুজে সজ্জিত নারী-পুরুষ শিল্পীরা। তারা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলে ধীরে ধীরে আকাশের দিকে উঠতে থাকে জাতীয় পতাকা। উঠতে থাকে আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকাও। গান শেষে দলীয় সভাপতির হাতে এলো শান্তির পায়রা, নেতাদের হাতে পায়রা ও বেলুন। একযোগে সবাই উড়িয়ে দিলেন, নিমিষেই রঙিন হয়ে উঠে আকাশ, দূরের আকাশে উড়ে গেল শান্তির পায়রা। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দ্রুত মঞ্চে আসন নেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। জেলা কমিটির নেতারা বসেন মঞ্চের সামনের নির্ধারিত আসনে। ঘোষণা এলো সম্মেলন উদ্বোধনের। এগিয়ে গেলেন দলীয় সভানেত্রী। বললেন, ‘সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি’। ঠিক এভাবেই নৌকা আকৃতির বিশাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে দুদিনের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন ঘোষণার পর ‘আলোর অগ্নিযাত্রা’ শীর্ষক সঙ্গীত ও নৃত্যের সাংস্কৃতিক পরিবেশনার সঙ্গে দলীয় সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, লালন গীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং তিনটি দেশাত্মবোধক গান গেয়ে শোনানো হয়। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন দফতর সম্পাদক আব্দুল মান্নান খান। এরপর প্রয়াতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সম্মেলন অভ্যর্থনা উপ-কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের পর সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ বক্তব্য রাখেন। তারপর বক্তব্য রাখেন বিদেশী রাজনৈতিক দলগুলোর আমন্ত্রিত নেতারা। তাদের বক্তব্য শেষে সভাপতির ভাষণ রাখেন শেখ হাসিনা। সকালের আনুষ্ঠানিকতা এটুকুই। তবে উৎসবের রং ছড়ায় উদ্যান ঘেরা বাইরের রাস্তায়ও। দুপুর সাড়ে ১২ টায় দেখা গেছে, শাহবাগ মোড় থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো রাস্তায় বসে আছে অসংখ্য মানুষ। মুহূর্তে মুহূর্তে আসছে মিছিল। শাহবাগ মোড়ের প্রায় কাছে জাতীয় জাদুঘরের সামনে যুবলীগের বিশাল অভ্যর্থনা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন যুবলীগ কর্মীরা। হলুদ শাড়িতে মিছিল নিয়ে আসছিল আদাবরের মহিলা আওয়ামী লীগ। চোখে ধরার মতো একটি মিছিল! দুপুর ১২টায় উদ্যানের ভেতর দেখা গেছে, ছবির হাট থেকে শুরু করে রমনা কালী মন্দির পর্যন্ত কোথাও পা ফেলার স্থান নেই। প্রচ- গরম আর দাবদাহে অনেকেই বের হয়ে আসতে চাইছিলেন উদ্যান থেকে। কিন্তু তখনও বের হওয়ার জন্য কোন ফটক খুলে দেয়া হয়নি। এ সময় রমনা কালী মন্দির ও বাংলা একাডেমির মধ্যবর্তী স্থানে উদ্যানকে ঘিরে রাখা দেয়াল টপকে অনেককে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তবে দেয়াল টপকে বের হওয়া মানুষের সংখ্যাই ছিল অধিক। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে বাংলা একাডেমির গেট দিয়েও বহু নেতাকর্মীকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। একই সময় পার্শ্ববর্তী আরেকটি গেট দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন ক্লান্ত হয়ে যাওয়া নেতাকর্মীরা। বেলা ১১টায় খোলা মাঠে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেছে বহু নেতাকে। তারা ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় ছিলেন মশগুল। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভিকে দেখা গেল খোলা মাঠে বসে আছেন। নেত্রীকে কাছে পেয়ে অনেকেই তার সঙ্গে তুলছিলেন সেলফি। রমনা কালি মন্দিরের আশপাশে মাটিতে ঘাষের উপর বসে থাকতে দেখা যায় তরুণ নেত্রীদের। গোপালগঞ্জ থেকে নৌকা দিয়ে সাজানো রিক্সা চালিয়ে সম্মেলনে এসেছেন নৌকাপাগল নূরু মিয়া। এতে তার খরচ হয়েছে ২৬ হাজার টাকা। তিনি নিজের জায়গা বিক্রি করে এই অর্থের যোগান দিয়েছেন। দুপুরে নূরু মিয়াকে দেখা গেল টিএসসির সামনের রাস্তায়। এ সময় তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে অনেককে ছবি তুলতে দেখা যায়। একই অবস্থা নেত্রকোনার সিদ্দিকের। সুদূর নেত্রকোনা থেকে ‘ভ্যানের নৌকায়’ ছয়দিনের পথ পাড়ি দিয়ে হাজির হয়েছেন আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে। শনিবার দুপুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে দেখা মেলে এই বঙ্গবন্ধুপাগলের। নৌকাপাগলের। এ সময় তিনি জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে নৌকা আকৃতির তিন চাকার ভ্যানের উপরে বসে ছিলেন দুই শিশু পুত্রকে নিয়ে। উৎসুক জনতা ভিড় জমায় সিদ্দিকের সেই নৌকা আকৃতির ভ্যানের সামনে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই তার সঙ্গে সেলফি তুলতে দেখা যায়। তবে সিদ্দিক ও নূরু মিয়া উভয়ই সাক্ষাত পেতে চান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। সম্মেলনে ঢোকার কার্ড ছিল না যাদের তারাও শামিল হয়েছেন এই উৎসবে। মৌলভীবাজারের বড়লেখার সীমান্তবর্তী শাহবাজপুর থেকে সম্মেলনে এসেছেন শওকত আলী। তিনি সাধারণ কর্মী। উদ্যানে প্রবেশের কার্ড নেই। তিনি জানান, কাউন্সিলর হিসেবে তার কার্ড না থাকায় রাস্তায় বসে মাইকেই তিনি বক্তব্য শুনছেন।
×