ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব

আকাশ আলোকিত করে তারার মতো ভেসে বেড়ায় ফানুস

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

আকাশ আলোকিত করে তারার মতো ভেসে বেড়ায় ফানুস

মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে ॥ প্রবারণা পূর্ণিমা। রাখাইনদের ধর্মীয় বৃহৎ উৎসব। আর এই তিথিতে বরাবরের মতো এবছরও ১৫ অক্টোবর, শনিবার রাত থেকে তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করছে কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠী। অনুষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত আকাশে ফানুস ওড়ানোর উৎসব। ধর্মীয় প্রার্থনাসহ সকল নিয়ম পালন করেন এ সম্প্রদায়। প্রত্যেক বছর পূর্ণিমার এ তিথিতে রাতের বেলা দক্ষিণ উপকূলের কলাপাড়ায় আকাশে ভেসে বেড়ায় ফানুসের আলো। যেন তারার মেলা। আর আনন্দে মাতোয়ারা থাকে রাখাইন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর থেকে সবাই। অতিথিসহ স্বজনদের জন্য থাকে বিভিন্ন ধরনের পিঠে-পুলির আয়োজন। বিন্নি চালের গুঁড়ায় বানানো ওই পিঠে খেতে আলাদা স্বাদ, না খেলে বোঝানোর নয়। এ উৎসবে শামিল হয়ভিন্ন ধর্মের মানুষও। তবে আগের সেই জৌলুস নেই। প্রায় আড়াই শ’ বছরের এ উৎসবের কলেবর এখন অনেক ছোট ও ম্লান হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের আর্থিক যোগানে হাত বাড়াতে হয় সরকারের কাছে। এক সময়ের দাপুটে আদিবাসী এ রাখাইন জনগোষ্ঠী এখন উৎসবের এ ছন্দ ধরে রাখতে পারছেন না। আর্থিক দৈন্য এর প্রধান কারণ। রাখাইন পল্লী পক্ষিয়াপাড়ার বাসিন্দা পরিবেশবাদী সমাজকর্মী টেনথান মং জানান, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধত্ব¡ লাভের আগে প্রায় ২৬ শ’ বছর আগে অনোমা নদীর তীরে তিনি তার চুল কেটে ফেলেন। কিন্তু এ চুল মাটিতে না পড়ে স্বর্গরাজ ইন্দ্র গ্রহণ করেন এবং তবতিংস স্বর্গে চুলোমনি ধাতুচৈত্ত হিসেবে এর পুজো করেন। পূর্ণিমার এ তিথিতে অলিক এ ঘটনা ঘটে। ধাতুচৈত্তকে শ্রদ্ধা করে প্রতিবছর প্রবারণা পূর্ণিমার তিথিতে আকাশে ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে এ উৎসব চলে আসছে। এখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা আড়াই শ’ বছর ধরে পালন করে আসছে ফানুস উৎসব। শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে তিন রাতব্যাপী এই উৎসব চলবে এবছর। দিনভর ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় আকাশে ফানুস ওড়ানোর উৎসব। কিন্তু আগের মতো এখন আর সেই জৌলুস নেই এ উৎসবে। এক সময়ের দাপুটে এ জনগোষ্ঠী বহুবিধ সমস্যা জমিজমা দখলের কারণে এখন পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে। তার পরও সাধ্যমতো উৎসবের মধ্য দিয়ে চলে ফানুস ওড়ানো। ১৯৬০ সালের শেষের দিকেও প্রত্যেকটি রাখাইন পাড়া থেকে প্রবারণা পূর্ণিমার সময় টানা তিন দিনের এই ফানুস উৎসবে প্রতি সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ১৫০/২০০টি ফানুস ওড়ানো হতো। আকাশ আলোকিত করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফানুস তারার মেলার মতো ভেসে বেড়াতো। শুধুমাত্র রাখাইন উপজাতি নয়, এই উৎসবে সমাবেশ ঘটত অন্য ধর্মের হাজারো মানুষের। একসময় (’৬০ সালের দিকে) বৃহত্তর পটুয়াখালী ও বরগুনায় রাখাইন পাড়া ছিল এক শ’ ৬৮টি। আর রাখাইন পরিবার ছিল পাঁচ হাজার এক শ’ ৯০টি। আর বর্তমানে বরগুনা ও পটুয়াখালীতে মোট রাখাইন পাড়া রয়েছে মাত্র ৪৫ টি। যার মধ্যে কলাপাড়ায় ২৯টি, লোক সংখ্যা মাত্র ১১শ’ ৬৬ জন। ১৯৯৮ সালের তথ্য এটি। তার পরও ব্যাপক উৎসবের মধ্যে এ বছর রাখাইনদের তিন রাত অবধি ফানুস উৎসব শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটি রাখাইন পাড়ার লোকজন আগেভাগেই ফানুস বানানোর অর্থ সংগ্রহ করে নেয়। তবে এবছরও সরকারীভাবে ২০টি রাখাইন পল্লীর জন্য ফানুস উৎসবের সহায়তায় ৫০০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। যা আবার সিন্ডিকেট পার্টির কারণে মাত্র ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। গোড়া আমখোলা পাড়ার যুবক এনথানচিং জানান, এ বছর তারা ৩৫টি ফানুস বানিয়েছে। গত বছর বানিয়েছিলেন আরও ১০টি বেশি। যার মধ্যে প্রথম রাতে ৭/৮টি আকাশে উড়িয়েছেন। বাকিটা পরের দুই রাতে। প্রায় নয় হাজার টাকা তাদের খরচ হয়েছে এসব করতে। মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধবিহারাধ্যক্ষ উত্তম রাখাইন জানান, তারা এ বছর শনিবার রাতে তিনটি ফানুস আকাশে ছেড়েছেন। মোট তৈরি করেছেন ২০টি। গত বছরের চেয়ে ১২টি কম। এজন্য তাদের প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বেতকাটা পাড়ার ধর্ম বিজয় বৌদ্ধবিহার কমিটির সভাপতি মংচো জানান, শনিবার রাতে তাদের ফানুস উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। মংচোর দাবি সরকারি সহায়তা বাড়ানো প্রয়োজন। তিনি জানান, সাধারনণত চার/পাঁচ ধরনের ফানুস তৈরি করেন রাখাইনরা। যার মধ্যে রয়েছে মালা ফানুস, প্যারাসুট ফানুস, বেনসান ফানুস, লেজ ফানুস, ম্রাকেচা ফানুস উল্লেখযোগ্য। কলাপাড়া কেন্দ্রীয় বৌদ্ধবিহার এলাকার বাসিন্দা রাখাইন সমাজকল্যাণ সমিতির নেতা টেনস্যুয়ে জানান, ফানুস তৈরি করতে চাইনিজ রঙিন কাগজ, বাঁশ, সুতি কাপড়, ছাতার জাঙ্গা, কেরোসিন, মটিয়া তেল, সুতা, মোম, গুণা এসব প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে এসব জিনিসপত্র সঠিক মানের পাওয়া যায় না। কাগজ অনেক মোটা যা আকাশে বেশি সময় ওড়ে না। নিচে পড়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও রয়েছে। যে কারণে ঝুঁকি থেকে যায়। তারপরও কলাপাড়ার অধিকাংশ রাখাইন পাড়ায় কম হলেও ২০/৩০টি করে ফানুস প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসবে আকাশে ওড়ানো হয়। প্রবীণ রাখাইন নেতা উথাচিং জানান, আসলে এসব উৎসবে এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত সহায়তা দেয়া প্রয়োজন। কারণ অধিকাংশ রাখাইনর গরিব। জমি-জমা অন্যায়ভাবে দখল করে নেয়া হয়েছে। এখনও দখল হচ্ছে। জালিয়াতির মাধ্যমে একটি চিহ্নিত চক্র কুয়াকাটা এলাকার মূল্যবান জমি দখল করে নিচ্ছে। এসব কারণে মানসিকভাবে উৎসবের আমেজ আর থাকে না। তারপরও বুদ্ধের সন্তুষ্টি লাভের আশায় উৎসব করে যাচ্ছি আমরা রাখাইন সম্প্রদায়। সরকারীভাবে এ উৎসব পালনে চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয় বলে রাখাইনদের দাবি। এছাড়া ফানুস উৎসবের প্রস্তুতির জন্য অন্তত আরও সাত দিন আগে সরকারী চাল বিতরণ করার দাবি রাখাইনদের। শত দৈন্য থাকলেও প্রাবরণা পূর্ণিমা উপলক্ষে ফানুস উৎসবকে কেন্দ্র করে রাখাইন পল্লীতে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। নারী-পুরুষ সবাই মিলিত হয় এ উৎসবে। নতুন সাজে, নতুন পোশাকে। হয় ধর্মীয় নানান নিয়ম নীতির পালন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দেবনাথ জানান, এ বছর প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে কলাপাড়ার ২০টি রাখাইন বৌদ্ধবিহারে ৫০০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়েছে।
×